দৈনিকবার্তা–ঢাকা,৬ নভেম্বর: সরকারি স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে বছরে নিয়ম বর্হিভূত ৭০.৩ কোটি টাকা আদান প্রদান হয় বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেনসি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদশ (টিআইবি)৷ বৃহস্পতিবার দুপুরে মহাখালির একটি হোটেলে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় এ তথ্য জানানো হয়৷ প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, এডহক চিকিসত্ক, তৃতীয় ও চতুর্থ শেণীর কর্মচারি নিয়োগে এক থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঘুষ আদান প্রদান হয়৷ পাশাপাশি ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর কাছ থেকে চিকিত্সকরা ৩০ থেকে ৫০ ভাগ পর্যন্ত কমিশন নিয়ে থাকেন৷দেশে চিকিত্সা সেবার এ রকম অবস্থার কারণে অনেকেই বিদেশে গিয়ে চিকিত্সা করাতে বাধ্য হচ্ছেন৷প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য খাতে সু-শাসন নিশ্চিত করার স্বার্থে ১৭ দফা সুপারিশের আহ্বান করা হয়েছে৷
মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজামান, উপনির্বাহী পরিচালক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা বিভাগের পরিচালক রফিক হাসান এবং প্রোগ্রাম ম্যানেজার সাহাজাদা এম আকরাম৷ গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন প্রোগ্রাম ম্যানেজার তাসলিমা আকতার৷ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, স্বাস্থ্যখাতে বাংলাদেশ সরকারের অর্জন জাতীয় ও আনত্মর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেও এই খাতের সার্বিক উন্নয়নে বড় বাধা অনিয়ম ও দুর্নীতি৷
স্বাস্থ্যখাতে সার্বিকভাবে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য ও আনত্মর্জাতিকভাবে প্রশংসনীয় স্বীকৃতি অর্জন করেছে৷সুশাসন নিশ্চিত করে কার্যকরভাবে দুর্নীতি ও বহুমুখী অনিয়ম নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে এ খাতে অর্জন ও অগ্রগতি আরো অনেক ভাল হবার সম্ভাবনা রয়েছে,টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এসংবাদ সম্মেলনে একথা বলেন৷টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম. আকরাম স্বাস্থ্যখাতে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এ গবেষণা প্রতিবেদনের সারাংশ উপস্থাপন করেন গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার তাসলিমা আক্তার৷
ড. ইফতেখারম্নজ্জামান স্বাস্থ্যখাতে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই খাতে দূর্নীতি ও অনিয়ম প্রতিরোধে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান৷ তিনি স্থানীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে সংসদ সদস্যদের সক্রিয় উদ্যোগে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলো কার্যকর করার পরামর্শ দেন৷তিনি বলেন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে অর্জিত অগ্রগতির স্থায়ীত্ব ঝুঁকির সম্মুখীন হবে৷
অন্যদিকে স্বাস্থ্যখাতের মত মৌলিক অধিকার খাতে আর্থিক বরাদ্দ খুবই কম; যার প্রভাবে স্বাস্থ্য অবকাঠামো, জনবল ও গুণগত চিকিত্সা সেবায় প্রত্যাশিত মান অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না৷ আর্থিক বরাদ্দ উদ্বেগজনকভাবে নিম্নমুখী৷ এ অবস্থার পরিবর্তনে সরকারের রাজনৈতিক সদিচছা ও সঠিকভাবে জাতীয় প্রাধান্য নির্ধারণ অপরিহার্য৷
উপস্থাপিত গবেষণা প্রতিবেদনে স্বাস্থ্যখাতে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তনের চিত্র তুলে ধরা হয়৷ এরমধ্যে দেশব্যাপি কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম সম্প্রসারণের মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা পেঁৗছে দেয়া; সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে ওষুধ শিল্পকে একটি রপ্তানিমুখী শিল্পে পরিণত করা; পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি প্রচলনে ব্যাপক প্রচারণা, সেবা বৃদ্ধি এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ক্রমান্বয়ে হ্রাস; সব সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রে লালসবুজের বিশেষ মোড়কে ওষুধ সরবরাহ; মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য উন্নয়নে বিশেষ কর্মসূচি; জাতীয় চৰুসেবা কার্যক্রমের আওতায় সাত লৰের বেশি রোগীকে বিনামূল্যে অপারেশন এবং লেন্স সরবরাহ; সকল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ইউনিট স্থাপনের উদ্যোগ, এসএমএস এর মাধ্যমে অভিযোগ-পরামর্শ প্রেরণ ইত্যাদি৷
গবেষণা পর্যবেৰণে আরো বলা হয়, জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০১১, দি মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেগুলেশন) (অর্ডিন্যান্স) ১৯৮২, এবং দি মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস্ অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (অ্যামেন্ডমেন্ট) অর্ডিন্যান্স ১৯৮৪ বলবত্ থাকলেও যুগোপযোগী না হওয়ায় এগুলো কার্যকর হচেছ না৷
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি স্বাস্থ্যখাতে সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৭ দফা সুপারিশ বাসত্মবায়নের আহ্বান জানায়৷ স্বাস্থ্যসেবা খাতে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে টিআইবি চিকিত্সকের অবহেলার কারণে কোনো রোগীর মৃতু্য বা ক্ষতির জন্য চিকিত্সকের শাসত্মির বিধান, বিনানুমতিতে কাজে অনুপস্থিতি ও বিলম্বে উপস্থিতির জন্য শাসত্মির বিধান নিশ্চিতকরণ এবং প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন ও বিদ্যমান আইন সংস্কার করার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন৷
এছাড়াও বিভিন্ন শূন্য পদ পূরণে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ; জনবল নিয়োগে দীর্ঘসূত্রতা দূর করা, পদোন্নতিতে যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচনে যোগ্যতার বিভিন্ন সূচকে স্কোরিং ব্যবস্থা চালু করণ, পেশাজীবী সংগঠনগুলোর দলীয় হসত্মক্ষেপ বন্ধ করা, রোগীর তথ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিটি হাসপাতালে তথ্য ও অনুসন্ধান ডেস্ক কার্যক্রম চালু করা, বিএমডিসি’র ওয়েবসাইটে নিবন্ধিত চিকিত্সকদের ডিগ্রি/যোগ্যতাসহ তালিকা প্রকাশ এবং নিয়মিত হালনাগাদ করা, ক্রয়, মেরামত ও রৰণাবেৰণের ক্ষেত্রে ই-টেন্ডারিং প্রক্রিয়া চালু করা এবং বেসরকারি চিকিত্সাসেবা প্রতিষ্ঠানের মান নিয়ন্ত্রণে তদারকি কার্যক্রম ব্যবস্থা জোরদার করার সুপারিশ করা হয়৷
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অ্যাডহক চিকিত্সক নিয়োগে তিন থেকে পাঁচ লাখ এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগে এক থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেনের অভিযোগ আছে৷ সবচেয়ে বেশি টাকার লেনদেন হয় ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের জেলায় পদায়নের ক্ষেত্রে৷ এ খাতে নিয়মবহির্ভূতভাবে লেনদেন হয় পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত৷ এমনকি চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা সুবিধাজনক জায়গায় দীর্ঘদিন থাকার জন্য আড়াই লাখ বা তার চেয়েও বেশি টাকা দিয়ে থাকেন৷
গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পদোন্নতির ক্ষেত্রে চাকরির অভিজ্ঞতা, জ্যেষ্ঠতা ও উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতাকে বিবেচনা করা হয় না৷ এ ছাড়া প্রকাশনাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন, সিনিয়র স্কেল পরীক্ষায় পাস বা বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন সন্তোষজনক কি না, তা-ও সব ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয় না৷
গবেষক তাসলিমা আক্তার এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, চিকিত্সক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী, পেশাজীবী সংগঠনের প্রতিনিধি ও গণমাধ্যমের কর্মীদের সঙ্গে আলোচনায় তিনি এ তথ্য পান৷ এ ছাড়া ২০১২ সালে টিআইবির জাতীয় খানা জরিপ ২০১২এর তথ্য তিনি ব্যবহার করেছেন৷ ওই জরিপে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারী মোট খানা ছিল ৩ হাজার ২০৮ এবং অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল ১৪ হাজার ২৭৬ জন৷
তাসলিমা বলেন, স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও যন্ত্রপাতি কেনা হয়, যন্ত্রপাতি মেরামতে অনেক ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার ও মেরামতকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়মিত দুর্নীতির আশ্রয় নেয়৷ এ ছাড়া পথ্য সরবরাহে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রভাব দেখা যায়৷ ঠিকাদার বাছাইয়েও অনিয়মের আশ্রয় নিতে দেখা যায় প্রায়ই৷গবেষণা প্রতিবেদনে বিভিন্ন আইনের সীমাবদ্ধতা ও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ যেমন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল আইন প্রয়োগে দুর্বলতার অভিযোগ তোলা হয়৷