দৈনিকবার্তা-ঢাকা,৬ নভেম্বর: বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে ফাঁসির আদেশের আবারো তীব্র বিরোধীতা করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)৷সেই সঙ্গে অপেক্ষমান সব দণ্ড মুলতবি করারও আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি৷বৃহস্পতিবার সংস্থার ঢাকা অফিস থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ কথা জানানো হয়৷
এর আগে বুধবার রাজধানীতে এক সংবাদ সম্মেলনেও এর বিরোধীতা করে রায় পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানান বাংলাদেশে নিযুক্ত সংস্থার নতুন রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াডুন৷ তবে ইইউ মানবতাবিরোধী বিচারের বিপক্ষে নয় বলেও এ সময় মন্তব্য করেন তিনি৷বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো ওই বিবৃতিতে ইইউ জানায়, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন পর্যবেক্ষণে রেখেছে৷
বাংলাদেশের বিচার প্রক্রিয়ার ওপর নিবিড় নজর রাখছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)৷ কার্যকর করা হয় নি এমন সব মৃতু্যদন্ড স্থগিত করতে বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে তারা৷ বৃহস্পতিবার ইইউ এমন আহ্বান জানিয়ে বলেছে, মৃতু্যদন্ড বাতিল করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মৃতু্যদন্ডের শাস্তি শিথিল করতে হবে৷সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃতু্যদন্ডের শাস্তি বহাল রাখেন৷
এরপরই ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ আহ্বান জানালো৷ এ খবর দিয়েছে কুয়েতি বার্তা সংস্থা কুনা৷ এতে বলা হয়, রোববার বাংলাদেশের বিশেষ আদালত জামায়াতে ইসলামীর আরেক সিনিয়র নেতা মীর কাসেম আলীকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদ- দিয়েছে৷
গত সপ্তাহে ওই আদালত দলের আমীর মতিউর রহমান নিজামীকেও মৃত্যুদণ্ড দেয়৷ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তারা যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের হাই রিপ্রেজেন্টেচিভ ফেদেরিকা মোঘেরিনি এক বিবৃতিতে বলেছেন, বাংলাদেশে বিচার প্রক্রিয়ার ওপর আমরা নিবিড় নজর রাখছি৷ যেকোন অবস্থায় এবং যেকোন মামলায় আমরা শাস্তি হিসেবে মৃতু্যদণ্ডের বিরোধী- ইউরোপীয় ইউনিয়ন আবারো জোর দিয়ে সে কথা বলছে৷
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনালে বিচারাধীন এসব অপরাধের সম্ভাব্য ফাঁসির দণ্ড নিয়ে শুরু থেকেই উদ্বেগ জানিয়ে আসছে ইইউ৷ এটি অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং অমানবিক৷বিশ্বব্যাপী মৃতু্যদণ্ড বিলোপে ইইউ’র যে ভূমিকা রয়েছে তার বাস্তবায়ন দেখতে সংস্থার বাংলাদেশি কর্মকর্তারাও কাজ করছে উল্লেখ করে ওই বিজ্ঞপ্তিতে এ রায় রহিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়৷
মৃতু্যদণ্ডের বিরোধিতা করে বিবৃতি দিলেও এটাকে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে অবস্থান না ভাবার আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নতুন দূত পিয়েরে মায়ইউদো৷যুদ্ধাপরাধে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের রায়ের পর মৃতু্যদণ্ডের বিরোধিতা করে ইইউ’র বিবৃতিতে সরকারি পর্যায়ে সমালোচনার প্রেক্ষাপটে এই আহ্বান জানান তিনি৷
ঢাকায় ইইউ’র আবাসিক প্রতিনিধি হিসেবে এসে রাষ্ট্রপতির কাছে পরিচয়পত্র জমা দেওয়ার পর দুদিন পর বৃহস্পতিবার প্রথম সংবাদ সম্মেলনে এসে মায়ইউদো বলেন, বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার বিষয়ক বক্তব্যে মৃতু্যদণ্ডের বিলোপ তাদের আলোচ্য সূচির শীর্ষে রয়েছে৷দয়া করে এ বিভ্রান্তি ছড়াবেন না যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন অপরাধীদের পক্ষ নিচ্ছে, বিশেষত যুদ্ধাপরাধীদের৷ এ বিষয়টি (বিবৃতি) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনাল সম্পর্কিত নয়৷গত ২৯ অক্টোবর ট্রাইবু্যনালের এক রায়ে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর মৃতু্যদণ্ড ঘোষণার পর উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷
বিভিন্ন মহল থেকে তাদের এ অবস্থানের সমালোচনা হয়৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এর সমালোচনা করে মানবাধিকার প্রশ্নে পশ্চিমাদের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন৷ইউরোপের দেশগুলো মৃতু্যদণ্ডের বিরোধী৷ তবে বাংলাদেশের আইনে মৃতু্যদণ্ডের বিধান রয়েছে৷
শুধু যুদ্ধাপরাধীদের মৃতু্যদণ্ডের পর বিবৃতি দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে ইইউ রাষ্ট্রদূত বলেন, বিশ্বের যে কোনও জায়গায় মৃতূ্যদণ্ডের বিষয় নজরে এলে তারা বিবৃতি দেন৷
ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবাধিকারের তালিকায় মৃতু্যদণ্ড বিলোপের বিষয়টি শীর্ষে রয়েছে এবং এটা শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নয়৷এটা আইসিটি (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনাল) সম্পর্কিত বিষয় নয়৷ আইসিটির বিষয়ে আমাদের কোনও আপত্তি নেই৷একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে বাংলাদেশে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনালকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন স্বীকৃতি দিয়েছে বলেও জানান তিনি৷ট্রাইবু্যনালের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে আমাদের বলার কিছু নেই, বলেন এই কূটনীতিক৷
এদিকে, এর আগে সোমবার বাংলাদেশে অব্যাহত মৃতু্যদণ্ডাদেশ দেয়া হচ্ছে বলে আশঙ্কা করে একে গভীর উদ্বেগজনক বিষয় হিসেবে অভিহিত করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল৷ মৃতু্যদণ্ড বাতিল করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে অবিলম্বে ফাঁসির ওপর স্থগিতাদেশ আরোপের আহ্বানও জানিয়েছে সংগঠনটি৷সোমবার সুপ্রিম কোর্ট জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখার প্রেক্ষাপটে অ্যামনেস্টি তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই আহ্বান জানিয়েছে৷
অ্যামনেস্টির বাংলাদেশ গবেষক আব্বাস ফয়েজ বলেন, বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডাদেশ অব্যাহতভাবে আরোপ করা গভীর উদ্বেগজনক৷ গত মৃতু্যদণ্ডাদেশ ঘোষণার নয় মাস বিরতির পর এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে তিনটি ফাঁসির আদেশ ঘোষিত হলো৷অ্যামনেস্টি বলে, বাংলাদেশকে অবশ্যই মৃতু্যদণ্ডাদেশ বাতিল করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে অবিলম্বে ফাঁসির ওপর স্থগিতাদেশ আরোপ করতে হবে এবং এটা নিশ্চিত করতে হবে যে বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতিক হস্ত ক্ষেপ হবে না৷
আব্বাস ফয়েজ বলেন, ফাঁসি স্বাধীনতা যুদ্ধের শিকার লাখ লাখ লোকের জন্য ন্যায়বিচার বয়ে আনার বদলে কেবল সহিংসতার স্থায়ী চক্রই সৃষ্টি করবে৷অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) ২ নভেম্বর আরেক জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়৷ এর আগে ২৯ অক্টোবর জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীকেও মৃতু্যদণ্ডাদেশ দেয়া হয়৷
২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে আইসিটি যে ১২টি আদেশ দিয়েছে, তার সবই বিরোধী দলের সদস্যদের (প্রধানত জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পৃক্তদের) বিরুদ্ধে৷ এগুলোর মধ্যে ৯টি মৃতু্যদণ্ডাদেশ৷
অ্যামনেস্টি জানায়, সংবিধান অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ রিভিউ আবেদন করতে পারে৷ কিন্তু অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য এর বিরুদ্ধে বক্তব্য দেয়ায় রিভিউ আবেদন করার অধিকার দৃশ্যত থাকছে না৷অ্যামনেস্টি জানায়, এখন পর্যন্ত ১৪০টি দেশ মৃতু্যদণ্ড আইনগতভাবে বা প্রথা হিসেবে বাতিল করেছে৷ যে মাত্র নয়টি দেশ ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ফাঁসি কার্যকর করেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম৷ অ্যামনেস্টি সবক্ষেত্রে মৃতু্যদণ্ডের বিরুদ্ধে৷
সর্বোচ্চ আদালত চূড়ান্ত রায়ে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবু্যনালের দেওয়া সাজা বহাল রাখায় একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসিকাষ্ঠে যেতে হবে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ৷ দেশের সর্বোচ্চ আদালতে এ রায়ের মধ্য দিয়ে এই মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হলো৷
সোমবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির বেঞ্চ কামারুজ্জামানের আপিল আংশিক মঞ্জুর করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে এ রায় দেন৷
কামারুজ্জামান বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে আলবদর বাহিনীর প্রধান সংগঠক ছিলেন৷ গত বছরের ৯ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনাল-২ তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃতু্যদণ্ডাদেশ দেন৷ ট্রাইবু্যনালে তাঁর বিরুদ্ধে আনা সাতটির মধ্যে পাঁচটি অভিযোগ (১, ২, ৩, ৪ ও ৭) সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়৷ ট্রাইবু্যনালের দেওয়া দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে ও খালাস চেয়ে গত বছরের ৬ জুন আপিল করেন কামারুজ্জামান৷ তবে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করেনি৷ চলতি বছরের ৫ জুন থেকে আপিলের শুনানি শুরু হয়৷ ১৬তম দিনে ১৭ সেপ্টেম্বর শুনানি শেষ হয়৷ ওই দিন আপিল বিভাগ রায় অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন৷ এর এক মাস ১৬ দিনের মাথায় সোমবার কামারুজ্জামানের করা আপিলের রায় ঘোষণা করা হলো৷ এটি আপিল বিভাগে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার তৃতীয় রায়৷
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর ২০১১ সালের ২৪ জুন থেকে কাশিমপুর কারাগারে বন্দি জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামান৷জাহাঙ্গীর কবির জানান, ফাঁসির দণ্ড পাওয়া কামারুজ্জামান ছাড়াও জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামসহ এ করাগারে মৃতু্যদণ্ডপ্রাপ্ত ১০৪ জন, যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া ৪৪১ জনসহ দুই হাজারের মতো বন্দি রয়েছেন৷