ec_election

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ৪ নভেম্বর: বহুল সমালোচিত দশম জাতীয় সংসদ ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের পর একেবারে ঝিমিয়ে পড়েছে কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি)৷ একতরফা সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও জাল ভোট, সহিংসতা ও কেন্দ্র দখল ঠেকাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে এ কমিশন৷ সব মিলিয়ে ভাবমূর্তি সঙ্কটও প্রকট৷

ভাবমূর্তি উদ্ধারে কোনো পদক্ষেপ নেই বর্তমান কমিশনের;নেই কোনো আইনি সংস্কার বা নতুন কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন৷ এর আগে কমিশনের আমলে ইসিকে কার্যকর এবং আইন-বিধিমালা সংস্কারের কাজও থমকে আছে৷এখন শুধু প্রতিদিন অফিসে আসা-যাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটির কর্তাব্যক্তিদের কাজ৷ এ অবস্থায় ইউএনডিপিসহ বিদেশি বিভিন্ন দাতা সংস্থাগুলোও আর্থিক সহায়তা কমিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন৷

ইসি কর্মকর্তারা জানান, দশম জাতীয় সংসদ ও সহিংস উপজেলা নির্বাচনের পর বিদেশি দাতা সংস্থাগুলো এরই মধ্যে নতুন করে অর্থ সহায়তা দেয়া বন্ধ করে দিয়ছে৷ সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করতে ব্যর্থ হওয়ায় দাতা সংস্থাগুলো এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে সমপ্রতি ইউএনডিপির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে৷ তারা জানান, বর্তমান কমিশন সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী ও কার্যকর করতে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না৷ বিগত কমিশনের রেখে যাওয়া ইসিকে শক্তিশালীকরণ কর্মপরিকল্পনা থেকেও দূরে সরে গেছে কমিশন৷ শুধু তা-ই নয়, স্বাধীন এ প্রতিষ্ঠানটি কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সরকারের গ্রিন সিগনালের অপেক্ষায় থাকে, যা প্রতিষ্ঠানটির জন্য বড় হুমকি৷

সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমান কমিশন বিগত কমিশনের রেখে যাওয়া সম্ভাবনাময় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) প্রকল্পের অকাল মৃৃতু্য ঘটিয়েছে৷ কোনো ধরনের আলোচনা না করে রকিব কমিশন ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই বন্ধ করে দেয় ইভিএম তৈরি ও ব্যবহার৷ অন্যদিকে প্রায় এক যুগ ধরে বন্ধ থাকা ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনও দিতে পারেনি তারা৷ তাছাড়া তাদের নেই কার্যকর আইন সংশোধনের উদ্যোগ৷ প্রতিদিন ইসিতে গিয়ে চা খাওয়া আর পাঁচ কমিশনার মিলে আড্ডা দিয়ে বাসায় ফেরা রুটিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷

ইসি কর্মকর্তারা অক্ষেপের সুরে বলেন, নিজেদের চেষ্টা ও আন্তরিকতায় নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তিকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন এর আগের এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের কমিশন৷ বর্তমান কমিশন ধরে রাখতে পারেনি সেই ইমেজটুকু৷ শুধু তা-ই নয়, গত আড়াই বছরে নষ্ট করেছেন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সক্রিয়তাও৷ সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা, আইন সংস্কার, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, ইভিএম প্রজেক্টসহ সব প্রকল্পেই চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে এ কমিশন৷ ফলে নির্বাচনে আবারও ফিরে এসেছে পেশিশক্তি, কালো টাকা ও সন্ত্রাসীদের দাপট৷ নানা বিতর্কিত কর্মকান্ডে সাধারণ জনগণের আস্থাও হারিয়েছেন রকিব কমিশন৷ সুশীল সমাজ এ কমিশনকে অথর্ব, আজ্ঞাবহ ও মেরুদন্ডহীন বলে উল্লেখ করেছেন৷

নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মতে, জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচন নিয়ে যে গর্ব ছিল, তা নষ্ট হয়ে গেছে৷ ২০০৭ সাল থেকে বিভিন্ন ইতিবাচক কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশনের যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল, তা-ও চরম বিতর্কিত হয়েছে৷ সমপ্রতি উপজেলা নির্বাচনেও এমন কোনো অনিয়ম নেই, যা হয়নি৷ ভোট কারচুপি, কেন্দ্র দখল, প্রকাশ্যে সিল মারা, ভয়ভীতি ও ব্যাপক সহিংসতা হয় এ নির্বাচনে৷ সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং ভোট জালিয়াতি রোধে সংবিধান ও আইন নির্বাচন কমিশনকে যথেষ্ট ক্ষমতা দিলেও তা প্রয়োগ করেনি ইসি৷ এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে বলার মতো কিছুই নেই৷ এ রকম অথর্ব ও মেরুদন্ডহীন কমিশন বাংলাদেশের ইতিহাসে আর আসেনি৷

ইসির সামপ্রতিক কর্মকান্ড সম্পর্কে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হাফিজ বলেন, ইসি বসে নেই৷ রুটিনমাফিক সব কাজ চালিয়ে যাচ্ছে৷ এ মুহূর্তে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কাজ চলমান রয়েছে৷ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যে কাজ করা প্রয়োজন, তা-ই করছে৷ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে একপ্রকার অসহায় হয়ে পড়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)৷ স্বাধীন প্রতিষ্ঠানটির নিরবতার কারণে নানা অনিয়ম করেও পার পেয়ে যাচ্ছে দলগুলো৷ এ সুযোগে আইন-কানুনকে পাত্তাই দিচ্ছে না দলগুলো৷ আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হওয়া, সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী চলা ও নানা বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেয়ায় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটিকে আজ্ঞাবহ বলে সমালোচনা করে যাচ্ছে রাজনৈতিক নেতা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা৷

ইসির দুর্বলতার সুযোগে আওয়ামী লীগ-বিএনপির পাশাপাশি সর্বশেষ নিবন্ধিত ও বহুল বিতর্কিত বিএনএফও ইসিকে বৃদ্ধাগুলি দেখিয়ে যাচ্ছে৷ কিছুই করতে পারছেনা ইসি৷এছাড়া রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কাউন্সিলও করছে না৷ আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে দল পরিচালনা করছে বছরের পর বছর৷ এছাড়া দশকের পর দশক জুড়ে দলীয় প্রধানের পদে কোনো পরিবর্তন না আনলেও ইসি এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেনা৷

নিবন্ধন বিধিমালা অনুযায়ী দলীয় গঠনতন্ত্র মোতাবেক দলগুলোর কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না৷ কাউন্সিল পরবর্তী নতুন কমিটির তালিকা ইসিকে সরবরাহ করার কথা থাকলেও তা করছে না দলগুলো৷ আইনে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য না থাকায় রাজনৈতিক দলগুলো পরিচালিত হচ্ছে দলীয় প্রধানের ইচ্ছায়৷ ইসি দল পরিচালনায় কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছেনা৷

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসির একজন উপ-সচিব জানান, রাজনৈতিক দলগুলো নিবন্ধনের সময় ইসিতে যে গঠনতন্ত্র জমা দিয়েছে সেই অনুযায়ী তাদের কাউন্সিল করতে হবে৷ গঠনতন্ত্রে এক বছর বা তিন বছর পর কাউন্সিলের কথা উল্লেখ আছে তা দলের ইচ্ছায়৷ কোনো কারণে কাউন্সিল করতে না পারলে তা কমিশনকে অবগত করতে হবে৷কাউন্সিল না করলে শাস্তি কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কাউন্সিল করা উচিত৷ এ বিষয়ে কমিশন সরাসরি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে না৷ তবে, কেউ যদি ঢালাওভাবে আইন ভঙ্গ করতে থাকে তাহলে কমিশন যথাযথ ব্যবস্থা নেবে৷

রাজনৈতিক দলগুলোর লাগাম ছাড়া অনিয়মে কমিশন এখন নীরব দর্শক হওয়া ছাড়া উপায় নেই৷ এ পরিস্থিতির জন্য খোদ কমিশনই দায়ী বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা৷ কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর আইনগত অভিভাবক হলেও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কমিশনের কোনো সমন্বয় নেই৷ দশম সংসদ ও উপজেলার মতো বড় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পরামর্শ করার প্রয়োজনও মনে করেনি ইসি৷ এড়িয়ে গেছে সুশীল সমাজ, এনজিও সংস্থা ও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে৷ যার কারণে রাজনৈতিক দল ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে ইসির দূরত্ব তৈরি হয়েছে৷ যা নিয়ে গত নির্বাচনের শুরু থেকেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বরাবর ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছেন৷

বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন মহল থেকে নির্বাচন কমিশনের নানা বিতর্কিত সিদ্ধান্তের সমালোচনা ও প্রতিবাদ করলেও সরকারের ইচ্ছায় কমিশন তা বাস্তবায়নে অটল থেকেছে৷ শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন সরকারের একক ইচ্ছায় রাজনৈতিক দল ও ভোটারবিহীন নির্বাচন দিতেও কমিশন পিছপা হয়নি৷ যা দেশে-বিদেশে তুমুল সমালোচনার ঝড় সৃষ্টি তুলেছে৷

বর্তমান সরকারের দুর্বল অবস্থান ও বিরোধী রাজনৈতিক জোটের কঠোর অবস্থান বর্তমান কমিশনকে দুশ্চিতায় ফেলে দিয়েছে৷ ইসির একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, সরকার পতন হলে বা নির্দলীয় সরকার ক্ষমতায় আসলে বর্তমান কমিশন দায়িত্বে থাকবেনা তা নিশ্চিত৷ পাশাপাশি ভোটারবিহীন নির্বাচন করায় তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হয় কি না তা নিয়েও কয়েকজন কমিশনার শঙ্কায় রয়েছেন বলে জানা যায়৷উল্লেখ্য, প্রথমবারের মতো সার্চ কমিটির মাধ্যমে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান ২০১২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদকে প্রধান করে এ নির্বাচন কমিশনকে নিয়োগ দেন৷ কিন্তু দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে একের পর এক বিতর্কিত কর্মকান্ডের জন্ম দেয় রকিব কমিশন৷