খালেদা-হাসিনা1

দৈনিকবার্তা-ঢাকা,২৬অক্টোবর: পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার খাগড়াগড়ে যে বোমা তৈরি হচ্ছিল, সেগুলোর গন্তব্য ছিল বাংলাদেশ৷ দেশটির নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীনের (জেএমবি) সদস্যরাই এই অপকর্মের সঙ্গে জড়িত৷ এদের উদ্দেশ্য ছিল, পশ্চিমবঙ্গের আপাতশান্ত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের শাসক দলকে ব্যতিব্যস্ত করা৷ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থার (এনআইএ) প্রাথমিক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে৷ গত শুক্রবার সারা দিন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী জেলা সফর করেন এনআইএর মহাপরিচালক শরদ কুমার৷ এরপরই এনআইএ এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে৷

নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ(জেএমবি)পশ্চিমবঙ্গকে তাদের ‘নিরাপদ ঘাঁটিতে’পরিণত করে সেখান থেকে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার বিরাট এক জঙ্গি ছক তৈরি করছিল বলে ভারতীয় গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন৷এর মধ্যে বাংলাদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের নেত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ দুই দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে হত্যার পরিকল্পনাও ছিল৷

ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ বিষয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন বাংলাদেশে পাঠানো হবে বলে একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন৷ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা বলেন, তদন্তে প্রতিদিনই আমরা নতুন তথ্য পাচ্ছি৷ আমাদের মনে হচ্ছে এ বিষয়গুলোও প্রতিবেদনে যোগ করা উচিত্‍,কেননা এসব বিষয় আমাদের মতো বাংলাদেশের জন্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ৷ এ কারণে কিছুটা সময় লাগছে৷গত ২ অক্টোবর বর্ধমানে বিস্ফোরণের ঘটনার পর ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থার (এনআইএ) অনুসন্ধানে পশ্চিমবঙ্গে ৫৮টি জঙ্গি ঘাঁটির সন্ধান পাওয়ার তথ্যও ওই প্রতিবেদনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে জানানো হবে৷

ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, এনআইএ এবং গোয়েন্দা সংস্থা র ও ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর সরবরাহ করা তথ্যের ভিত্তিতে ওই প্রতিবেদন তৈরির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে৷এসব বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার জন্য সোমবার কলকাতায় পৌঁছাচ্ছেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল, ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ডস এর প্রধান জেএন চৌধুরী ও ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর প্রধান সৈয়দ আসিফ ইব্রাহিম৷ বর্ধমান বিস্ফোরণের তদন্তে আরো সমন্বয়ের বিষয়েও তারা কথা বলবেন বলে জানা গেছে৷ মমতার তৃণমূল সরকার শুরুতে এ ঘটনায় এনআইএর তদন্তের বিরোধিতা করে বলেছিল, ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী আইন-শৃঙ্খলার বিষয়টি রাজ্য সরকারেরই দেখার কথা৷

কিন্তু বিষয়টি নিছক আইন-শৃঙ্খলার বিষয় নয়৷ এটা এমন নয় যে একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীরা প্রতিপক্ষকে মারবে বলে হাতবোমা বানাচ্ছিল৷এর সঙ্গে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা এবং আমাদের প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র বাংলাদেশের বিষয় জড়িত, বলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা৷ তিনি বলেন, রাজ্য সরকারকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের কাজ করতে হবে৷ যে জঙ্গি পরিকল্পনা আমরা উদঘাটন করেছি তা তাদের গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে৷ভারতের এই কর্মকর্তার দাবি, ইন্ডিয়ান মুজাহিদীন ও কাশ্মিরের জঙ্গিদের সঙ্গে মিলে পশ্চিমবঙ্গে এসব জঙ্গি ঘাঁটি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসএই এর ইন্ধন স্পষ্ট৷

জেএমবি ও পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন আল মুজাহিদীনের নেতাদের মধ্যে অসংখ্য ফেন কল আদানপ্রদান হয়েছে৷ আল মুজাহিদীন আল কায়েদার সহযোগী হলেও আইএসআই তদের গোপনে মদদ দিচ্ছে৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা বলেন, আইএসআই দুবাইয়ের গোপন স্থান থেকে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার এই পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করছিল৷তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে তালেবান স্টাইলের পরিস্থিতি সৃষ্টি করা, যাতে ভারতের বিরুদ্ধে গুপ্ত লড়াই চালানো সম্ভব হয়৷

বর্ধমানের খাগড়াগড়ে সংঘটিত বিস্ফোরণ নিয়ে বাংলাদেশ ভারতের কাছে প্রতিবেদন চেয়েছে৷ এনআইএর এই পট্রাথমিক প্রতিবেদন এখনই অবশ্য বাংলাদেশকে দেওয়া হচ্ছে না৷ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র অনুযায়ী, এনআইএ ছাড়াও আরও কিছু সংস্থা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তদন্ত করছে৷ সবার কাছ থেকে প্রতিবেদন নিয়ে সার্বিকভাবে তা বাংলাদেশকে দেওয়া হবে৷এনআইএর প্রতিবেদন পাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) অজিত দোভাল ঠিক করেছেন, সোমবার তিনি পশ্চিমবঙ্গে যাবেন৷ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রের খবর, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে চান৷এনআইএর প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তদন্তকারী দল রাজ্যের পুলিশ ও প্রশাসনের কাছ থেকে তেমন একটা সহযোগিতা পাচ্ছে না৷ মন্ত্রণালয় সূত্রের খবর, এসব ঘটনার গুরুত্ব এবং তাত্‍পর্য মুখ্যমন্ত্রীকে বোঝাতে চান অজিত দোভাল৷

বর্ধমানে বিস্ফোরণ ঘটে ২ অক্টোবর, রাজ্য সরকারের অনিচ্ছাকে উপেক্ষা করে এনআইএ তদন্তভার হাতে নেয় ১১ অক্টোবর৷ বিস্ফোরণের তীব্রতায় ঘটনাস্থলেই মারা যায় দুজন৷ আহত অবস্থায় একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ ধরা হয় হতাহতদের পরিবারকেও৷ অধিকাংশই বাংলাদেশের নাগরিক৷ অবৈধভাবে ভারতে ঢুকে তারা নানাভাবে নাশকতামূলক কাজের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে৷ তদন্তে জানা যায়, বাংলাদেশ সরকারের তাড়া খেয়ে তারা পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী এলাকায় ঘাঁটি গাড়ে৷ রাজ্যের শাসক দলের স্থানীয় নেতাদের প্রশ্রয়ে তারা লালিত হয়৷ বর্ধমানের বিস্ফোরণের পরপরই বিভিন্ন এলাকা থেকে সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা পালিয়ে যায়৷

এনআইএর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে জেএমবির অন্তত ৫৮ জন জঙ্গি বিভিন্ন ধরনের নাশকতার সঙ্গে যুক্ত৷ তারা স্থানীয় মাদ্রাসাগুলোর সাহায্য ও সাহচর্যে জিহাদি তৈরিতে নিবেদিত৷ স্থানীয় লোকজনের মগজ ধোলাই করে তাদের অস্ত্রশিক্ষাও তারা দিয়েছে৷ এ ধরনের বেশ কিছু জঙ্গির খোঁজে এনআইএ হুলিয়া জারি করতে চলেছে৷ তাদের সন্ধান দিতে পারলে নগদ পুরস্কারও দেওয়া হবে৷ সীমান্ত পেরিয়ে এ ধরনের অন্তত ১৮০ জন জেএমবি জঙ্গি বিভিন্ন সময়ে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের জেলাগুলোতে ঘাঁটি গেড়েছে৷ তদন্তে বাংলাদেশের সহযোগিতা পাচ্ছে এনআইএ৷এনআইএ প্রধানত তিনটি বিষয় তদন্ত করছে৷ এক, বিস্ফোরণের সঙ্গে জঙ্গি- যোগ কতখানি নিবিড়৷ দুই, এই জঙ্গিদের সঙ্গে অন্য জঙ্গিসংগঠনগুলোর (হুজি ও সিমি) সংশ্লিষ্টতা কতটা গভীর এবং তিন, জঙ্গিপনা অব্যাহত রাখতে অর্থের জোগান ও তার উত্‍স সন্ধান৷ প্রধানত এই তিন বিষয় নিয়ে তদন্তের মধ্যেই উঠে আসছে জঙ্গিদের রাজনৈতিক মদদের প্রসঙ্গও৷ কাদের মদদে, কীভাবে এবং কোন রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে জঙ্গিরা ভারতে ব্যবহৃত হয়েছে বা হচ্ছে কি না, এনআইএর তদন্তের আওতায় চলে আসছে তা-ও৷ এবং সেখান থেকেই প্রশ্ন উঠছে এই তদন্ত নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের স্পর্শকাতরতা৷

মনে করা হচ্ছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনা হলে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এ প্রসঙ্গের ওপরেই বেশি জোর দেবেন৷ ভারতের পূর্ব প্রান্তের নিরাপত্তা-সংক্রান্ত দুশ্চিন্তা বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকার যে দূর করেছে, কংগ্রেস ও বিজেপি সরকার তা মুক্তকন্ঠে স্বীকার করে৷ সেই নিরাপত্তা কোনোভাবেই বিঘি্নত হোক, ভারত সরকার তা চায় না৷ এ কথা মমতাকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানাতে চান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা৷

অর্থের জোগানের বিষয় তদন্তের ক্ষেত্রে নজরে থাকছে সারদা কেলেঙ্কারি৷ বিস্ফোরণের আগেই তৃণমূল কংেেগ্রসের রাজ্যসভার এক সদস্য বিতর্কের শীর্ষে চলে এসেছিলেন৷ সিবিআই যদিও প্রাথমিক তদন্তে এমন কিছু পায়নি, যা দিয়ে প্রমাণ করা যায় সারদার টাকা বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গিসংগঠনের হাতেও গেছে৷ এনআইএ কিন্তু এই সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দিতে নারাজ৷ তাদের তদন্তের অভিমুখ এই দিকেও ধাবিত৷ সমপ্রতি তেলেঙ্গানার করিমপুরে একটি ব্যাংকে ডাকাতি হয়৷ সেই ব্যাংকের ছাপ মারা কিছু টাকা বর্ধমানকাণ্ডে ধৃতদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে৷