দৈনিকবার্তা-ঢাকা,২৬অক্টোবর: পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলায় দুদকের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে সাত আসামির সবাইকে অব্যাহতি দিয়েছে আদালত৷বিশ্ব ব্যাংকের চাপে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত শুরুর ২২ মাস পর আদালতের এই আদেশের মধ্য দিয়ে মামলাটির সমাপ্তি ঘটল৷ ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ জহুরুল হক রোববার বিকাল সোয়া ৪টায় দুদকের আবেদন মঞ্জুর করে এই আদেশ দেন৷এর আগে গত ১৭ সেপ্টেম্বর আদালতে জমা দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে দুদকের পক্ষে বলা হয়, পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতি বা ষড়যন্ত্রের কোনো প্রমাণ তারা পায়নি৷পদ্মা সেতুর দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মামলায় এজাহারভুক্ত সাত জন আসামির কেউই দুর্নীতির সাথে জড়িত নন মর্মে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতোপূর্বে আদালতে একটি চূড়ানত্ম প্রতিবেদন দাখিল করে৷আদালত সূত্রে জানা গেছে , এ মামলার তদনত্ম কর্মকর্তা ও দুদকের উপ-পরিচালক মির্জা জাহিদুল আলম চলতি বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে মামলার চূড়ানত্ম প্রতিবেদন দাখিল করেন৷
প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত গত ২২ সেপ্টেম্বর অব্যাহতির শুনানির জন্য ২৬ অক্টোবর রোববার দিন ধার্য করে এবং প্রতিবেদনটি ঢাকা সিএমএম আদালত থেকে সিনিয়র বিশেষ জজ আদালতে পাঠানো হয়৷ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. জহুরুল হক রোববার শুনানি শেষে দুদকের চূড়ানত্ম প্রতিবেদন গ্রহণ করেন এবং সাত আসামির সকলকেই অব্যাহতির আদেশ দেন৷মামলার দায় থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্তরা হলেন : সাবেক সেতু সচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া, কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস, সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল ও আনত্মর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহা, সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য সচিব কাজী ফেরদৌস, সড়ক ও জনপথের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী রিয়াজ আহমেদ জাবের ও এসএনসি-লাভালিনের স্থানীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ারিংঅ্যান্ড পস্ন্যানিং কনসালট্যান্ট কোম্পানি লিমিটেডের উপ-মহাব্যবস্থাপকমো. মোসত্মফা৷এছাড়া সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীর বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে আদালত জানান৷
৩ সেপ্টেম্বর দুদক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থারচেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান বলেন, মামলার মেরিট না থাকায়, তদন্তে পর্যাপ্ত তথ্য ও সাক্ষী না পাওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিবেদনের জন্য মামলাটি নথিভুক্ত করা হয়েছে৷ দেড় বছরের বেশি সময় ধরে তদন্তে মামলাটিকে এগিয়ে নেওয়ার মতো তথ্য পাওয়া যায়নি৷ তাই আদালতে চার্জশিট পেশ করা সম্ভব হচ্ছে না৷দুর্নীতির ওই ষড়যন্ত্রে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে পদত্যাগে বাধ্য হন সেই সময়ের যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেন৷ অভিযোগ ছিল সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীর বিরুদ্ধেও৷ তবে তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে সেদিন জানান দুদক কমিশনার সাহাবুদ্দিন চুপপু৷দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে দীর্ঘ টানাপড়েন শেষে গত বছর জানুয়ারিতে দেশের সবচেয়ে বড় এ অবকাঠামো প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে ১২০কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল হয়ে যায়৷এর আগে বিশ্ব ব্যাংকের তাগিদে ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে দুদকের উপ পরিচালক আবদুল্লাহ আল জাহিদ ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর বনানী থানায় এই মামলা দায়ের করেন, যাতে সাতজনকে আসামি করা হয়৷
মামলায় প্রধান আসামি করা হয় সেতু বিভাগের তখনকার সচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে৷ তাকে গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি সরকারি চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান৷ গত বছর জুনে বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করে তাকে চাকরিও ফিরিয়ে দেওয়া হয়৷
বাকি ছয়জন হলেন- সেতু কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (নদী শাসন) কাজী মো. ফেরদৌস, সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী রিয়াজ আহমেদ জাবের, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড প্ল্যানিং কনসালটেন্ট লিমিটেডের উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশে কানাডীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনের স্থানীয় প্রতিনিধি মোহাম্মদ মোস্তফা, এসএনসি-লাভালিনের সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল, এই সংস্থার আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ সাহ ও সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস৷দুদকের আবেদনে আদালত তাদের সবাইকে অব্যাহতি দিয়েছে৷মামলার এজাহারে বলা হয়েছিল- এই আসামিরা পারস্পরিক যোগসাজশে ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্র করার মাধ্যমে পদ্মা সেতু প্রকল্পের তদারকি পরামর্শকের কাজ এর অন্যতম দরদাতা এসএনসি লাভালিন ইন্টারন্যাশনালকে পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে৷ এর মধ্য দিয়ে তারা দণ্ডবিধির ১৬১ এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে অপরাধ করেছেন, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷এসএনসি লাভালিন ওই কার্যাদেশ পেলে ‘ঘুষ লেনদেন সম্পন্ন হতো বলেও এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছিল৷
দেড় বছরেরও বেশি সময় তদন্ত চালানোর পর ৩ সেপ্টেম্বর দুদকের সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার চেয়ারম্যান বলেন, প্রাথমিক তথ্য ও চূড়ান্ত সত্যতা এক নয়৷প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তি ছিল পত্রিকায় প্রকাশিত খবর ও বিশ্ব ব্যাংকের অভিযোগ৷২০১১ সালে পদ্মা সেতু নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে আমরা এই দুর্নীতির তথ্য সম্পর্কে জানতে পারি৷ এরপর বিশ্ব ব্যাংকের অনুরোধে আমরা একটি টিম গঠন করি৷ এর মধ্যে বিশ্ব ব্যাংকের টিম একাধিকবার বাংলাদেশে আসে এবং আমাদের সঙ্গে তাদের কয়েক দফা বৈঠক হয়৷ দুদক টিম দীর্ঘদিন এই অভিযোগ অনুসন্ধান করে৷সেই অনুসন্ধান শেষেই ২০১২ সালে দুদক মামলা দায়ের করে, যা ছিল মূলত ‘দুর্নীতির ষড়যন্ত্রেও মামলা৷বদিউজ্জামান বলেন, বিশ্ব ব্যাংকের আশ্বাসের ভিত্তিতে মামলা দায়ের করা হলেও মামলা চালানোর জন্য দাতাসংস্থা ও কানাডা থেকে পর্যাপ্ত তথ্য উপাত্ত পাওয়া যায়নি৷
বিশ্ব ব্যাংকের অনুরোধে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে কানাডায় এসএনসি লাভালিনের কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠানটির আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ সাহ ও সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ এরপর টরোন্টোতে তাদের বিচারও শুরু হয়৷ ওই সময় রমেশ সাহের কাছ থেকে কানাডীয় পুলিশের জব্দ করা একটি ডায়েরি নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়, যাতে কাকে কতো শতাংশ ঘুষ দেয়া হবে তার সাংকেতিক বিবরণ ছিল বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়৷ এসব প্রতিবেদনে বলা হয়, এসএনসি-লাভালিনকে পদ্মা সেতুর পরামর্শকের কাজ পাইয়ে দিলে প্রকল্প ব্যয়ের চার শতাংশ আবুল হোসেনকে এবং আরো কয়েকজন কর্মকর্তাকে আরো ছয় শতাংশ দেয়ার কথা ছিল৷ প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা মসিউর রহমান, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী কায়সার এবং সেতু সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার নামও তাতে উঠে আসে৷
সাহবুদ্দিন চুপপু এ বিষয়ে পরে সাংবদিকদের বলেন, বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে ডায়েরি শব্দটি ছিল, কানাডার আদালতে যাকে বলা হয়েছে নোটবুক৷ আমরা ওই নোটবুকের কপি পর্যালোচনা করেছি৷ তাতে কোনো আসামিকেই দোষী সাব্যস্ত করা যায় না৷বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের পর নিজস্ব অর্থায়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয় সরকার৷ ১২ হাজার কোটি টাকায় চার বছরের মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণে চীনা কোম্পানি মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তিও করা হয়৷ জমি অধিগ্রহণ করে সেতুর অবকাঠামো নির্মাণের কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে৷
কানাডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনকে পদ্মা সেতুর পরামর্শকের কাজ পাইয়ে দিতে ঘুষ লেনদেন ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর সাবেক সেতুসচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগে দরপত্র মূল্যায়নে গঠিত কমিটির সদস্য সচিব কাজী ফেরদাউস, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী রিয়াজ আহমেদ জাবের, এসএনসি-লাভালিনের সে সময়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস, পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল ও আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহ এবং তাঁদের স্থানীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড প্ল্যানিং কনসালট্যান্ট কোম্পানি লিমিটেডের উপমহাব্যবস্থাপক মো. মোস্তফার বিরুদ্ধে বনানী থানায় মামলা করে দুদক৷
মামলার এজাহারে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা না করা হলেও তাঁদের তদন্তের আওতায় রাখা হয়৷ কিন্তু তাঁদের অব্যাহতি দেয় দুদক দেশের দীর্ঘতম পদ্মা সেতু নির্মাণে ২৯১ কোটি ডলারের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি ডলার দেওয়ার কথা ছিল৷ তবে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তারা অর্থায়ন স্থগিত এবং পরে তা বাতিলও করে৷ একপর্যায়ে সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় বিশ্বব্যাংক ফিরলেও দুদকের তদন্তের ফলাফলে তারা অসন্তুষ্টি জানায়৷ এরপর সরকার দাতাদের কাছ থেকে অর্থ নেবে না বলে নিজেরাই জানিয়ে দেয়৷ এখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ সরকার৷