দৈনিকবার্তা-নাটোর, ২১অক্টোবর: নাটোরের বড়াইগ্রামে স্মরনকালের ভয়াবহ বাস দুর্ঘটনায় নিহত ৩৩ জনের মধ্যে পরিবারে চলছে শোকের মাতম৷ জানাজা আর দাফনের সময় উপস্থিত স্বজন আর জনতার উচ্চস্বরের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে এলাকার আকাশ বাতাস৷ এর আগে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঘটনাস্থল, হাসপাতাল ও সিধুলী গ্রাম পরিদর্শণ করে নিহতের পরিবারকে এক লাখ করে টাকা অনুদানের ঘোষনা দিয়েছেন৷ ইতোমধ্যে ৩৩টি লাশের দাফন সম্পন্ন হয়েছে৷ এর মধ্যে গুরুদাসপুরের সিধুলী গ্রামে এক পরিবারের ছয় ভাইসহ ১৪জন, শিকারপাড়া ফাজিল মাদরাসার প্রভাষক রেজাউল করিম, বৃ-চাপিলা গ্রামের বাবুল (৪০), আব্দুল আওয়াল (৩০), পাটপাড়া গ্রামের জকের আলী, সোনাবাজু গ্রামের আবু হানিফ, চাঁচকৈড় বাজারের আলহাজ্ব আবুল খায়ের (৬৫), এবং অথৈ পরিবহনের মালিক ও চালক আলম হোসেন (৪০) ও পৌর সদরে এলজিইডির একজনের দাফন হয়েছে৷ অন্য দিকে বড়াইগ্রাম উপজেলার পিঙ্গইনে নিহত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুসের, সংগ্রামপুরে আব্দুর রহমান (৪৫) ও তার স্ত্রী আরিফা বেগমের, একই এলাকার বাজিতপুর গ্রামে আয়নাল হক (৩২) ও কিসমত আলীর (৪৫), জালশুকা গ্রামের মনিরুল ইসলাম ও তার ভাগ্নী সেবা ওরফে মোহনা (৮) এবং তারানগর গ্রামে কলেজ শিক্ষক জামাল হোসেন ও তার মেয়ে জান্নাতী খাতুন (৬) এর জানাজা হয়েছে৷ অন্যদিকে দূর্ঘটনায় নিহত এলজিইডির গুরুদাসপুর উপজেলা প্রকৌশলী হাফিজুর রহমানের (৬০) লাশ রাতেই উপজেলা প্রশাসন তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়াতে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইয়াসমিন আক্তার৷
নাটোরের বড়াইগ্রামে দুই বাসের স্মরনকালের ভয়াবহ সংঘর্ষে নিহত ৩৪ জনের মধ্যে ১২ জনের জানাজা মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় এবং অপর দুজনের জানাজা যোহরের নামাজের পর সিধুলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ স্থানীয় গোরস্থানে একই সাথে ১২টি এবং অন্যপাশে দুটি কবরে পরে তাদের দাফন করা হয়েছে৷ নিহতদের জানাজার জন্য বাড়ি থেকে লাশ গুলো স্কুল মাঠে নেয়ার সময় পুরো সিধুলী গ্রামে কান্নার রোল পড়ে যায়৷ এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখে জানাজায় আগত দুই উপজেলার হাজারো মানুষ তাদের চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি৷ জানাজা পূর্ব সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন স্থানীয় সংসদ সদস্য সাবেক প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস ও উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল আজিজ, গুরুদাসপুর পৌরসভার মেয়র শাহনেওয়াজ মোল্লা৷ জানাজায় এলাকার সব রাজনৈতিক দলের নেতাকমর্ী ও সাধারন মানুষ অংশ নেন৷ এখনো আরো দুজন নিখোঁজ রয়েছে বলে জানিয়েছে গ্রামের সাধারন মানুষ৷
এদিকে, নাটোরের বড়াইগ্রামে দুই বাসের মুখোমুখি ভয়াবহ সংঘর্ষে নিহত ৩৪ জনের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে অনুদান দেয়ার ঘোষনা দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদের ৷ মন্তী রাত একটার দিকে গুরুদাসপুরের সিধুলীূ গ্রামের হতাহতদের দেখতে সেখানে গেলে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারনা হয়৷ মন্ত্রী সেখানে নিহত প্রত্যেককে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে নগদ এক লাখ টাকা করে অনুদান দেয়ার ঘোষনা দেন৷ এর আগে রাত সোয়া ১২টার দিকে তিনি বড়াইগ্রামের বনপাড়া আমিনা হাসপাতাল ও পাটোয়ারী হাসপাতালে গিয়ে আহতদের চিকিত্সার খোঁজ খবর নেন এবং প্রত্যেককের চিকিত্সার ব্যয় সরকার বহন করবে বলে ঘোষনা দেন৷ এর আগে মন্ত্রী বড়াইগ্রামে দুই বাসের মুখোমুখি ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন৷ মন্ত্রীর সাথে এ সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য সাবেক প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস ও নাটোর-১ আসনের সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ, নাটোরের জেলা প্রশাসক মশিউর রহমান, বড়াইগ্রাম এবং গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার যথাক্রমে মোছাঃ শরিফুননেছা ও ইয়াসমিন আক্তার উপস্থিত ছিলেন৷
গ্রামে গ্রামে জানাজা শোকের মাতম: দুই বাসের সংঘর্ষে নিহত ৩৪ জনের মধ্যে গুরুদাসপুরের সিধুলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে সিধুলী গ্রামের একই পরিবারের ছয় ভাইসহ ১২ জনের জানাজা ছাড়াও দূর্ঘটনায় নিহত একই উপজেলার এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী হাফিজুর রহমানের লাশ রাতেই উপজেলা প্রশাসন তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়াতে পাঠিয়েছে আর একই দপ্তরের নিহত অফিস সহকারী রেজাউল করিমের জানাজার নামাজ মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে গুরুদাসপুর শহীদ শামসুজ্জোহা ডিগ্রি কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ সিধুলী গ্রামে আরো দুজনের জানাজার প্রস্তুতি চলছে৷ এ ছাড়া নিহত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুসের জানাজা রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার গ্রামের বাড়ি বড়াইগ্রাম উপজেলার পিঙ্গইনে অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ এ সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য সাবেক প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস ও বড়াইগ্রাম উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোছাঃ শরিফুননেছা৷ সংগ্রামপুরে জানাজা হয়েছে আব্দুর রহমান (৪৫) ও তার স্ত্রী আরিফা বেগমের৷ একই এলাকার বাজিতপুর গ্রামে আয়নাল হক(৩২) ও কিসমত আলী (৪৫) এর জানাজা হয়েছে৷ একই সময়ে পাশর্্ববতি জালশুকা গ্রামের মনিরুল ইসলাম ও তার ভাগ্নী সেবা ওরফে মোহনা (৮) এর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ এ সব জানানার সময় স্বজন ও উপস্থিত লোকজনের কান্নায় এলাকার বাতাস ভারি হয়ে ওঠে৷
অথৈ পরিবহনে যাত্রী হয়ে ওরা অথৈ সাগরে ভাসিয়ে গেলো ৩০টি পরিবার:নাটোরের বড়াইগ্রামে সোমবার বিকেলে দুই বাসের মুখোমুখি ভয়াবহ সংঘর্ষে যে ৩৪জন নিহত হয়েছে তার মধ্যে নাটোর থেকে গুরুদাসপুরগামী যাত্রীবাহী লোকাল বাস অথৈ পরিবহনের মালিক ও চালকসহ যাত্রী ছিল ৩১জন৷ দুইজন শিশুসহ ৩০টি পরিবারের যে ৩১জন এই বাসের যাত্রী মারা গেছে তাদের সকলের বাড়িতে এখন বইছে শোকের মাতম৷ ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা রাজশাহীগামী যাত্রীবাহী কোচ কেয়া পরিবহন ও নাটোর থেকে গুরুদাসপুরগামী যাত্রীবাহী লোকাল বাস অথৈ পরিবহনের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষে জেলার স্মরনকালের বৃহত্তম এই হতাহতের ঘটনা ঘটে৷ ঘরে ফেরার জন্য জেলা শহর থেকে অথৈ পরিবহনের যাত্রী হয়ে গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম উপজেলার নিহতরা হলেন, বড়াইগ্রাম উপজেলার জোনাইল ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক আওয়ামী লীগ নেতা জামাল হোসেন (৪০), তার মেয়ে জান্নাতী (৫), একই উপজেলার বাজিতপুর গ্রামের আলাল উদ্দিন, সংগ্রাম পুরের আব্দুর রহমানের স্ত্রী আতিকা বেগম, খোকসা গ্রামের কৃষ্ণ পদ সরকার (৫৫), ইন্দ্রাপাড়া গ্রামের জান মোহাম্মদ (৪৮), বাজিতপুর গ্রামের কিসমত আলী (৪৫), আব্দুল কুদ্দুস (৬৬), জোনাইলের আব্দুর রহমান, (৫৪), রহমত আ্লী (৫৫), জালশুকা গ্রামের মনিরুল ইসলাম(২৫)গুরুদাসপুর উপজেলা প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান, তার এসও রেজাউল করিম, একই উপজেলার সিধুলী গ্রামের এবাদ আলী (৪৫), শরীফ উদ্দিন (৩০) লাবু, (৩৫), আলাল(৫৫), সোহরাব হোসেন, আয়নাল হক (৩৫),সতের আলী প্রামনিকের দুই ছেলে রব্বেল আলী (৪৫) ও আতাহার আলী (৫০), বৃ-চাপিলা গ্রামের বাবুল (৪০), আব্দুল আওয়াল (৩০), তেলটুপি গ্রামের আবু সাইদের মেয়ে মোহনা খাতুন (৫), পাটপাড়া গ্রামের জকের আলী, সোনাবাজু গ্রামের আবু হানিফ, সিধুলী গ্রামের কহির (৩৫), তোফাজ্জল, চাঁচকৈড় বাজারের আলহাজ্ব আবুল খায়ের (৬৫), এবং অথৈ পরিবহনের মালিক ও চালক আলম হোসেন (৪০)৷ ৩০টি পরিবারেই এখন চলছে শোকের মাতম৷ নাটোরের মানুষের মুখে মুখে এখন একটাই কথা ওরা অথৈ পরিবহনে যাত্রী হয়ে অথৈ সাগরে ভাসিয়ে গেলো ৩০টি পরিবারকে৷
৩৩টি লাশ হস্তান্তর: নাটোরের পুলিশ সুপার বাসুদেব বণিক জানিয়েছেন, নিহতদের প্রায় সকলেই জেলার বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুর উপজেলার অধিবাসী হওয়ায় নিহতের স্বজনদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে বনপাড়া হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি থেকে লাশ গুলো হস্তান্তর করা হয়েছে৷ মঙ্গলবার দুপুরের মধ্যেই ৩৩ টি লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে এবং দূর্ঘটনায় নিহত এলজিইডির গুরুদাসপুর উপজেলা প্রকৌশলী হাফিজুর রহমানের (৬০) লাশ রাতেই উপজেলা প্রশাসন তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়াতে পাঠানো হয়েছে৷
তদন্ত কমিটির কাজ শুরু:নাটোরের জেলা প্রশাসক মশিউর রহমান এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, ঘটনার পরপরই যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নাটোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে যে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল তারা ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছেন৷ তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান নাটোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মোহাম্মদ আলী গত রাত থেকেই কমিটি তাদের তদন্ত কাজ শুরু করেছে স্বীকার করলেও এখনই বিস্তারিত জানাতে রাজি হন নাই৷
মহাসড়কে দ্রুত অভারটেকিং প্রাণ নিয়েছে ৩৩ জনের: নাটোরের বড়াইগ্রামে দুই বাসের মুখোমুখি ভয়াবহ সংঘর্ষে ৩৩জন নিহত ও অর্ধশত আহত হওয়ার ঘটনা অনুসন্ধানে জানা গেছে বাস ট্রাকসহ অন্য যানবাহনের মহাসড়কে দ্রুত অভারটেকিং এর কারনেই প্রাণ গেছে এই ৩৩ জনের৷ দূর্ঘটনা কবলিত ঢাকার কোচ কেয়া পরিবহনের পিছনে প্রাইভেটকার নিয়ে আসা বড়াইগ্রামের ব্যবসায়ী মাজেদুল ইসলাম নয়ন জানিয়েছেন, সোমবার বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা যাত্রীবাহী কোচ কেয়া পরিবহন রাজশাহীর দিকে যাচ্ছিল৷ বাসটির সামনে একই দিকে যাওয়া অপর একটি ট্রাককে অভারটেক করে সামনে যাওয়ার সময় হঠাত্ বিপরীত দিক থেকে আসা অথৈ পরিবহনকে দেখতে পায়৷ পরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কেয়া পরিবহন সজোরে অথৈ পরিবহনকে আঘাত করে৷ এ সময় বিকট শব্দে বাস দুটি মুখোমুখি সংঘর্ষের পর মহাসড়কের দুই পাশের দুটি গর্তে সিটকে পড়ে দুমড়ে মুচড়ে যায়৷ ঘটনার সময় রাস্তা ও আশে পাশে আহত ও নিহতরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে৷ এ সময় আহতদের আর্তচিত্কার ও দূর্ঘটনার শব্দে শত শত এলাকাবাসী উদ্ধার করতে ছুটে আসে৷ খবর পেয়ে নাটোর, লালপুর ও দয়ারামপুর ফায়ার সার্ভিস ও থানা এবং হাইওয়ে পুলিশ এলাকাবাসীর সহায়তায় উদ্ধার তত্পরতা চালায়৷
এদিকে নাটোরের পুলিশ সুপার বাসুদেব বণিক জানিয়েছেন, নিহতের স্বজনদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে বনপাড়া হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি থেকে লাশ গুলো হস্তান্তর করা হচ্ছে৷ মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত ৩৩ টি লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে৷ নাটোরের জেলা প্রশাসক মশিউর রহমান জানিয়েছেন, ঘটনার পরপরই সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নাটোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে যে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল তারা ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছেন৷ তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান নাটোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মোহাম্মদ আলী বলেছেন, গত রাত থেকেই কমিটি তাদের তদন্ত কাজ শুরু করেছে৷ তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি এ বিষয়ে আর কোন মন্তব্য করতে রাজি হন নাই৷