দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১২ অক্টোবর ২০১৪ : মন্ত্রিসভা থেকে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীকে অপসারণ করা হয়েছে৷ অপসারণ সংক্রান্ত ফাইলে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ সই করার পর রোববার দুপুরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রজ্ঞাপন জারি করে৷নিউ ইয়র্কে প্রবাসীদের এক অনুষ্ঠানে হজ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করার ১৫ দিনের মাথায় আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিল সরকার৷মন্ত্রি পরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন৷
তিনি বলেন, মন্ত্রী হিসেবে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর নিয়োগের অবসান হয়েছে মর্মে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে৷বিকেলের মধ্যে বিজি প্রেসে এটি ছাপা হবে৷তিনি আরও বলেন, সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদের(২) দফা অনুযায়ী লতিফ সিদ্দিকীর মন্ত্রী পদে নিয়োগের অবসান ঘটানোর জন্য রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী৷ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী ৫৮ অনুচ্চেদের(১) দফার গ উপদফা অনুসিরে মন্ত্রী পদের নিয়োগের অবসান ঘটানোর নির্দেশ প্রদান করেন৷ তার ভিত্তিতে এ প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে৷
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী গত ২৯ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের পালকি পার্টি সেন্টারে যুক্তরাষ্ট্রের টাঙ্গাইল জেলা সমিতির মতবিনিময় অনুষ্ঠানে ইসলাম ধর্মের অন্যতম স্তম্ভ পবিত্র হজ, তাবলিগ জামাত, প্রধানমন্ত্রীর ছেলে তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সজীব ওয়াজেদ জয় এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিয়ে কটূক্তি করেন৷এ নিয়ে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ঝড় ওঠে৷ একইসময় যুক্তরাষ্ট্র সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে মন্ত্রিপরিষদ থেকে নিজে পদত্যাগ না করলে অপসারণ করা হবে বলে ঘোষণা দেন৷
পরে প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরলেও রাষ্ট্রপতি এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব হজ পালনে সৌদিতে অবস্থান করায় ওই ঘোষণাটি বাস্তবায়ন করা যাচ্ছিল না৷ শুক্রবার রাতে তারা দেশে ফেরেন ৷ রোববার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করার পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসেন ভূইঞা সচিবালয়ে এক সংবাদ ব্রিফিং করেন ৷
এ বিষয়ে জারি করা প্রজ্ঞাপন পড়ে শুনিয়ে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদের ১ দফার গ উপধারা অনুসারে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর মন্ত্রী পদে নিয়োগের অবসান ঘটানোর নির্দেশ দিয়েছেন৷ কেন লতিফের মন্ত্রিত্বের অবসান ঘটানো হলো- সে বিষয়টি অবশ্য প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়নি৷ মন্ত্রিপরিষদ সচিবও এর বাইরে কিছু বলেননি৷ এই অবসানের অর্থ অপসারণ না অব্যাহতি- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, দুটো একই বিষয়৷ মিনিং একই৷ আমরা সংবিধানের ভাষা ব্যবহার করেছি৷
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লতিফ সিদ্দিকী ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন৷ওই পদে নতুন কেউ নিয়োগ না পাওয়া পর্যন্ত এ মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকবে বলে জানান সচিব৷ আওয়ামী লীগে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকও রোববার বসছে৷ এই বৈঠকেও দলের বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা লতিফ সিদ্দিকীর বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে ইঙ্গিত মিলেছে৷
প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সফরে থাকার সময় গত ২৮ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে লতিফ সিদ্দিকী হজ নিয়ে মন্তব্য করেন৷ এরপর তা নিয়ে শুরু হয় তুমুল আলোচনা-সমালোচনা৷লতিফ সিদ্দিকী সেদিন বলেছিলেন, আমি কিন্তু হজ আর তাবলিগ জামাতের ঘোরতর বিরোধী৷ আমি জামায়াতে ইসলামীরও বিরোধী৷এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, বিপুল সংখ্যক মানুষ হজে যাওয়ায় দেশের অর্থ আর শ্রম শক্তির অপচয় হয়৷তার ওই বক্তব্যের ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়লে কয়েকটি ইসলামী দল আন্দোলনের হুমকি দেয়৷ তাকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়ার পাশাপাশি গ্রেপ্তারের দাবিও তোলে বিএনপি৷ লতিফ সিদ্দিকী ঈদ করার পর এখনও নিউ ইয়র্কে রয়েছেন৷ এর মধ্যেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ দেওয়ার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন জেলায় অন্তত দুই ডজন মামলা হয়েছে৷
নিউ ইয়র্ক থেকে ফিরে গত ৩ অক্টোবরই এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দেন লতিফ সিদ্দিকী আর মন্ত্রিসভায় থাকবেন না৷ তবে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ হজ পালনে সৌদি আরবে থাকায় লতিফকে বাদ দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা ঝুলে থাকে আরো এক সপ্তাহ৷ওই সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, আমি নির্দেশ দিলে রিজাইন (পদত্যাগ) করতে হবে৷ নইলে বিদায় করে দিতে হবে৷ কিন্তু বিদায় দিতে হলে রাষ্ট্রপতির কাছে ফাইল পাঠাতে হবে৷ রাষ্ট্রপতি হজে গেছেন৷ মন্ত্রিপরিষদ সচিবও হজে গেছেন৷ আমি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে ফাইল তৈরি করে রাখতে বলেছি, অফিস খুললে ফাইল চলে আসবে৷
হজ পালনের পর রাষ্ট্রপতি দেশে ফেরেন শুক্রবার৷ মন্ত্রিপরিষদ সচিবও এরইমধ্যে ফিরে আসেন৷ শনিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসেন ভূইঞা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এ বিষয়ে (লতিফ সিদ্দিকীর অপসারণ) একটি ফাইল আসবে৷ আমরা একটি সামারি তৈরি করে তা রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে পাঠাব৷ রাষ্ট্রপতি তাতে সাইন করার পর প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে৷
এরপর রোববার দুপুর ২টায় মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে সঙ্গে নিয়েই বঙ্গভবনে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী৷ তিনি সেখানে বৈঠক করেন পুরো এক ঘন্টা৷এরইমধ্যে রাষ্ট্রপতির সই নিয়ে সচিবালয়ে ফিরে সাংবাদিকদের সামনে আসেন মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসেন ভূইঞা৷তিনি বলেন,প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সংবিধান অনুযায়ী মন্ত্রী পদে লতিফ সিদ্দিকীর নিয়োগের অবসান ঘটানোর নির্দেশ দিয়েছেন৷
লতিফকে দল থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে গত ৩ অক্টোবরের সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হাসিনা বলেন, দল থেকে বাদ দিতে হলে তা নিয়ে দলে আলোচনা করতে হবে৷ অভিযোগ তুলে ধরে আলোচনা করতে হবে৷ ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷
ওয়ার্কিং কমিটি যদি মনে করে তাকে দল থেকে অব্যাহতি দেয়া ভাল- তাহলে অব্যাহতি দিয়ে দেবে৷ রোববার বিকালেই ওয়ার্কিং কমিটির সেই বৈঠক বসছে৷ উল্লেখ্য, গত ২৮ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের একটি হোটেলে সেখানকার টাঙ্গাইলবাসীদের সঙ্গে এক মতবিনিময়কালে মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী হজরত মুহাম্মদ (সা.), পবিত্র হজ, তাবলিগ জামাত, টওধানমন্ত্রিপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়, প্রবাসী বাংলাদেশি ও সাংবাদিকদের বিষয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেন৷
হজ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্যের পর স্থানীয় প্রবাসীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়৷ সংবাদটি দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে৷ ক্ষুব্ধ প্রবাসীরা মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান৷ সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগদানের জন্য নিউইয়র্কেই ছিলেন৷ মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীও প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে নিউইয়র্কে যান৷সেখানে লতিফ সিদ্দিকীর বক্তব্যের ভিডিও রেকর্ড প্রধানমন্ত্রী নিজেই দেখেন এবং ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন৷
তার এ ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যকে কেন্দ্র করে দেশের ভেতরেও তীব্র প্রতিবাদ ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়৷ পরে জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগদান শেষে দেশে ফিরে সিলেটে যাত্রাবিরতিতে বিমানবন্দরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাকে (লতিফ সিদ্দিকী) সরকার ও দল থেকে বহিষ্কার করা হবে৷যা বলেছিলেন লতিফ সিদ্দিকী: গত ২৮ সেপ্টেম্বর বিকেলে নিউইয়কের্র জ্যাকসন হাইটসের একটি হোটেলে নিউইয়র্কে বসবাসরত টাঙ্গাইলবাসীর সঙ্গে মতবিনিময় করেন লতিফ সিদ্দিকী৷
এসময় তিনি বলেন, আব্দুল্লাহর পুত্র মোহাম্মদ চিন্তা করলো এ জাজিরাতুল আরবের লোকেরা কীভাবে চলবে? তারাতো ছিল ডাকাত৷ তখন সে একটা ব্যবস্থা করলো যে আমার অনুসারীরা প্রতিবছর একবার একসঙ্গে মিলিত হবে৷ এর মধ্য দিয়ে একটা আয়-ইনকামের ব্যবস্থা হবে৷
তিনি বলেন, আমি হজ আর তাবলিগ জামাতের ঘোরতর বিরোধী, জামায়াতে ইসলামীরও বিরোধী, তবে তার চেয়েও বেশি হজ ও তাবলিগ জামাতের৷হজ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের এ প্রবীণ নেতা বলেন, ‘হজের জন্য ২০ লাখ লোক সৌদি আরবে গিয়েছে৷ এদের কোনো কাম নাই৷ এদের কোনো প্রডাকশন নাই৷ শুধু রিডাকশন দিচ্ছে৷ শুধু খাচ্ছে আর দেশের টাকা দিয়ে আসছে৷
এ সময় তাবলীগ জামাতের সমালোচনা করে মন্ত্রী বলেন, ‘তাবলিগ জামায়াত প্রতিবছর ২০ লাখ লোকের জমায়েত করে৷নিজেদেরতো কোনো কাজ নেই৷সারা দেশের গাড়িঘোড়া তারা বন্ধ করে দেয়৷’প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়েও সমালোচনাও করেন মন্ত্রী৷ এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কথায় কথায় আপনারা জয়কে টানেন কেন৷জয় ভাই কে? জয় বাংলাদেশ সরকারের কেউ নয়৷ তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ারও কেউ নন৷