দৈনিকবার্তা-ঢাকা,৮অক্টোবর : ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন আর নেই (ইন্না লিল্লাহে রাজেউন)৷ বুধবার সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন৷এর আগে স্ট্রোক হওয়ায় আবদুল মতিনকে গত সোমবার গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় মোহাম্মদপুর সিটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ এসময় চিকিত্সকরা জানান, তার মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছে৷
এরপর মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (বিএসএমএমইউ) মতিনকে নিয়ে যাওয়া হয়৷ সেখানে বুধবার দুপুরে তার মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করেন চিকিত্সকরা৷আবদুল মতিন দুই মেয়ের সঙ্গে মোহাম্মদপুরে থাকতেন৷ তার জন্ম ১৯২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর, সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী উপজেলার ধুবলিয়া গ্রামে৷ ১৯৫২ সালে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে নেতৃত্বের ভূমিকার জন্য তাকে ভাষা মতিন নামেই চিনত সারা বাংলাদেশ৷উল্লেখ, ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন তার মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দান করে গেছেন৷ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় এক চিঠির মাধ্যমে মতিন মরণোত্তর দেহদানের কথা জানান৷ আর চক্ষু দান করার ঘোষণা দিয়েছেন সন্ধানীকে৷
ভাষা মতিনের ওই চিঠিতে বলা হয়, আমি আবদুল মতিন, পিতা-মৃত আবদুল জলিল, মাতা-মৃত আমেনা খাতুন স্বেচ্ছায় শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ অবস্থায় আমার মরণোত্তর দেহ বা লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের শিক্ষার্থীদের এনাটমি ফিজিওলজি ইত্যাদি শেখার কাজে লাগবে জেনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে দেহ সম্পূর্ণ এবং সন্ধানীকে চক্ষু দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷ এ বিষয়ে আমার স্ত্রী ও কন্যাদের সম্মতি রয়েছে৷ কাজেই মৃতু্যর পরে আমার মৃতদেহ কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে অর্পণ করার জন্য আমার স্ত্রী ও কন্যাদের নির্দেশ দিচ্ছি৷ হাসপাতাল সূত্র জানায়, গত ৪ অক্টোবর থেকে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিলো৷ বুধবার সকাল ৯টার দিকে তার লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া হয়৷ ঘোষণা অনুযায়ী বুধবার মৃতু্যর পরপরই তার কর্নিয়া সংগ্রহ করা হয়৷ তারপর মরদেহ রাখা হয় একই হাসপাতালের হিমঘরে৷
গত ১৮ আগস্ট অসুস্থ হয়ে পড়েন ভাষামতিন৷ তাত্ক্ষণিকভাবে তাকে নগরীর সিটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ পরদিন ১৯ আগস্ট তাকে বিএসএমএমইউতে আনা হয়৷ শারীরিক অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেলে চলতি মাসের ৪ তারিখে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয় ভাষা মতিনকে৷ বিএসএমএমইউ এর ১০ তলায় সমপ্রসারিত আধুনিক আইসিইউ কক্ষের ৯ নাম্বার বেডে শিফট অনুযায়ী তার শারীরিক অবস্থা দেখভাল করেন ডাক্তাররা৷অষ্টআশি বছরের জীবনের শেষ পর্যন্ত সাম্যবাদের লড়াই চালিয়ে চিরবিদায় নেন ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক আবদুল মতিন, সারা বাংলাদেশ যাকে চেনে ভাষা মতিন নামে৷ মস্তিষ্কে স্ট্রোক হওয়ায় গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিত্সাধীন ছিলেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির (পুনর্গঠিত) নেতা মতিন৷ গত ৪ অক্টোবর থেকে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়৷বুধবার সকাল ৯টায় লাইফ সাপোর্ট খুলে নিয়ে সেখানেই তাকে মৃত ঘোষণা করা হয় বলে জানান হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের অধ্যাপক আফজাল হোসেন৷দুই মেয়ের বাবা আবদুল মতিন পরিবারের সঙ্গে থাকতেন ঢাকার মোহাম্মদপুরে৷ তার জন্ম ১৯২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর, সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী উপজেলার ধুবলিয়া গ্রামে৷তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, তার মৃত্যুতে জাতি ভাষা আন্দোলনের একজন জীবন্ত কিংবদন্তীকে হারালো৷ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন মাতৃভাষার অধিকার আদায়ে যে অবদান রেখেছেন জাতি তা চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে৷
শোক জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন,দেশের স্বাধীনতার সোপান রচনা হয় ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে৷ আর ভাষা মতিন সেই আন্দোলনের অন্যতম সংগ্রামী৷ তার মৃতু্য একটি জীবন্ত ইতিহাসের অবসান৷ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিনের মৃতু্যতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর৷
বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ,অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ভাষা মতিনের মৃতু্যতে শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে৷ বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর আহ্বায়ক অভিক ফয়সাল জানান, সবার শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বৃহস্পতিবার বেলা ১২টায় এই ভাষা সৈনিকের মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হবে৷
১৯৫২ সালে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে ভাষার দাবিতে বাঙালির আন্দোলনে নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন আবদুল মতিন৷তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ১৯৪৫ সালে৷ ভাষা আন্দোলনের পর তিনি ছাত্র ইউনিয়ন গঠনে ভূমিকা রাখেন এবং পরে সংগঠনটির সভাপতি হন৷ এরপর কমিউনিস্ট আন্দোলনে সক্রিয় হন৷১৯৫৪ সালে পাবনা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক হন মতিন৷ মওলানা ভাসানী ন্যাপ গঠন করলে তিনি ১৯৫৭ সালে তাতে যোগ দেন৷ ১৯৫৮ সালে মতিন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল ) গঠন করেন৷চীনকে অনুসরণকারী বামপন্থি দলগুলোর নানা বিভাজনের মধ্যেও আবদুল মতিন সক্রিয় ছিলেন রাজনীতিতে৷ ১৯৯২ সালে তিনি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন৷
২০০৬ সালে ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে তিনি পদত্যাগ করেন৷ পরবর্তীকালে ২০০৯ সালে হায়দার আকবর খান রনোর নেতৃত্বে ওয়ার্কার্স পার্টি (পুনর্গঠন) গঠিত হলে আবদুল মতিন তাদের সঙ্গে যোগ দেন৷ হায়দার আকবর খান রনো বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলেও আবদুল মতিন পুনর্গঠিত ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গেই রয়েছেন৷
১৯৩০ সালে গ্রামের বাড়ী যমুনায় বিলীন হলে আব্দুল জলিল জীবিকার সন্ধানে সপরিবারে ভারতের দার্জিলিংয়ে চলে যান৷ সেখানে জালাপাহারের ক্যান্টনমেন্টে সুপারভাইজ স্টাফ হিসেবে চাকরি পান৷ ১৯৩২ সালে দার্জিলিং-এর বাংলা মিডিয়াম স্কুল মহারাণী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণীতে ভর্তি হন৷ শুরু হয় তার শিক্ষাজীবন৷ ১৯৩৩ সালে আব্দুল মতিনের বয়স যখন মাত্র ৮ বছর, তখন তার মায়ের মৃতু্য হয় অ্যাকলামশিয়া রোগে৷মহারানী গার্লস স্কুলে ৪র্থ শ্রেণি পাশ করে ১৯৩৬ সালে দার্জিলিং গভর্মেন্ট হাই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন মতিন৷ ১৯৪৩ সালে এনট্রান্স (ঝবপড়হফধত্ু ঈবত্ঃরভরপধঃব ঊীধসরহধঃরড়হ) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি৷
ছেলে দার্জিলিংয়ে ভাল কোনো কলেজে ভর্তি হোক বাবা তা চাইলেও আব্দুল মতিন ১৯৪৩ সালে রাজশাহী গভর্মেন্ট কলেজে ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষে ভর্তি হন৷ ২ বছর পর ১৯৪৫ সালে তিনি এইচ এস সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে আব্দুল মতিন ব্রিটিশ আর্মির কমিশন্ড র্যাঙ্কে ভর্তিপরীক্ষা দেন৷ দৈহিক আকৃতি, উচ্চতা, আত্মবিশ্বাস আর সাহসিকতার বলে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম থেকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কমিশন পান৷ এরপর তিনি কলকাতা থেকে ব্যাঙ্গালোর যান৷ কিন্তু ততদিনে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে৷ ফলে তিনি একটি সার্টিফিকেট নিয়ে আবার দেশে ফিরে আসেন৷ দেশে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি ১৯৪৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর অব আর্টস (পাশ কোর্স) এ ভর্তি হন৷ ফজলুল হক হলে তাঁর সিট হয়৷ ১৯৪৭ সালে গ্র্যাজুয়েশন কোর্স শেষ করেন এবং পরে মাস্টার্স করেন ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস বিভাগ থেকে৷
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলায় তার অবদান অন্যতম৷ ১৯৫২ সালে আব্দুল মতিনসহ অন্যরা ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন৷ তারই নেতৃত্বে একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সারা বাংলার জন্য আন্দোলনের নানা কর্মসূচি৷তিনি ছিলেন সর্বদলীয় ইমেজের অধিকারী এক অনন্য ব্যক্তিত্ব৷ ভাষা আন্দোলন বিষয়ে তার রচিত বিভিন্ন বইয়ের মধ্যে রয়েছে বাঙালী জাতির উত্স সন্ধান ও ভাষা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন কী এবং কেন’ এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস৷
এছাড়া প্রকাশিত হয়েছে তার আত্মজীবনীমূলক বই জীবন পথের বাঁকে বাঁকে৷ আব্দুল মতিন আরো বেশ ক’টি বইও রচনা করেন৷ এগুলো হলো-ইউরোপের দেশে দেশে (১৯৬০), কাস্তে (১৯৮৭), স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি (১৯৮৯), প্রবাসীর দৃষ্টিতে বাংলাদেশ (১৯৯১), শামসুদ্দিন আবুল কালাম ও তার পত্রাবলী (১৯৯৮), শেখ হাসিনা: একটি রাজনৈতিক আলেখ্য (১৯৯২), আত্মজীবনী স্মৃতিচারণ পাঁচ অধ্যায় (১৯৯৫), জীবনস্মৃতি: একটি বিশেষ অধ্যায় (২০১২), রাজনীতি বিষয়ক জেনেভায় বঙ্গবন্ধু (১৯৮৪), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব: কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বিষয় (১৯৯৩), খালেদা জিয়ার শাসনকাল: একটি পর্যালোচনা (১৯৯৭), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব: মুক্তিযুদ্ধের পর (১৯৯৯), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব: কয়েকটি ঐতিহাসিক দলিল (২০০৮), বিজয় দিবসের পর: বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ (২০০৯), ইতিহাস বিষয়ক রোমের উত্থান ও পতন (১৯৯৫), মহানগরী লন্ডন’ (১৯৯৬), ক্লিওপেট্রা (২০০০), ‘দ্বি-জাতি তত্ত্বের বিষবৃক্ষ (২০০১), ভলতেয়ার: একটি অনন্য জীবনকাহিনী’ (২০০২), কামাল আতাতুর্ক: আধুনিক তুরস্কের জনক (২০০৩), মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি: যুক্তরাজ্য (২০০৫), ইউরোপের কথা ও কাহিনী (২০০৫); ইউরোপের কথা ও কাহিনী (২০০৭), ইউরোপের কথা ও কাহিনী (২০০৯)৷