দৈনিকবার্তা-ঢাকা,৮অক্টোবর : ব্যাংক ঋণের কারণে সম্পদ,সম্মান সব হারিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন কয়েক প্রজন্ম ধরে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী আবদুর রব৷১৯৯০ সালে বাবার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান আফসার গ্রুপের নামে ২০ কোটি টাকা ব্যাংকঋণ নিয়েছিলেন তিনি৷ এই ঋণ খেলাপি হয়ে সুদাসলে শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়৷ ব্যাংকঋণ পরিশোধে নিজের ১০৫ বিঘা জমি ১২ কোটি টাকায় বিক্রি করে দেন৷ এ সময় প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ওই জমির ক্রেতা রবের গুলশানের বাড়িটির দলিলেও স্বাক্ষর করিয়ে নেয়৷ বাড়ি হারিয়ে ওঠেন বনানীর ফ্ল্যাটে৷ সেখানেই স্ত্রীকে হত্যা করে আত্মহত্যা করেন তিনি৷ ব্যাংক ঋণকেই মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে বনানীর আলোচিত হত্যাকান্ডের মামলার এজাহারে৷
বিষয়টি নিয়ে ভাবার সময় এসেছে৷ ব্যাংক ঋণ ব্যবস্থাপনায় অসঙ্গতি কোথায় তা দ্রুত খুঁজে বের করা প্রয়োজন৷ দেশে ব্যাংক ঋণের কারণে পথে বসা আবদুর রবের সংখ্যা এক নয়, অনেক- হয়তো হাজার ছাড়িয়ে যাবে৷ আর এই ব্যাংক ঋণের মাধ্যমেই হঠাত্ গজিয়ে ওঠা ব্যবসায়ীর (লুটেরা বলাই শ্রেয়) সংখ্যা সহস্রধিক৷ যে ঋণ ব্যবস্থা ব্যবসায়ী পরিবারগুলোকে পথে বসাচ্ছে, সেই ঋণ ব্যবস্থার মাধ্যমেই ব্যাংক লুটে ব্যবসায়ী পরিচয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন অনেক লোক৷বিশ্লেষকদের মতে, মূল অসঙ্গতি দেশের ব্যাংক ব্যবস্থাপনায়৷ বাংলাদেশের মতো অসঙ্গতিপূর্ণ ব্যাংক ব্যবস্থাপনা আধুুনিক বিশ্বের কোথাও খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হবে৷ এখানে বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা একজন উদ্যোক্তা একটি ছোট কারখানা দেয়ার জন্য এক লাখ টাকা ঋণ পান না৷ আবার একজন লুটেরা বিনা বাধায়, বিনা প্রশ্নে হাজার কোটি টাকা আত্মসাত্ করতে পারেন৷ ব্যাংক লুট করে সমাজে প্রতাপের সঙ্গে দিনযাপন করতে পারেন৷
একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি বাকি জীবন নিরাপদে কাটাতে ব্যাংকে আমানত রাখলে মুনাফা পান মূল্যস্ফীতির হারের চেয়েও নিচে৷ মানে তিনি লাভের পরিবর্তে ক্ষতিগ্রস্ত হন৷ আর ব্যাংক একজন উদ্যোক্তার কাছ থেকে ২২-২৩ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নেয়৷ এই মুনাফার বড় অংশই খেয়ে নেয় ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট৷ যে দেশের প্রথম শ্রেণীর একজন (বিসিএস) সরকারি কর্মকর্তা ২০ হাজার টাকার নিচে বেতন পান, সে দেশের মধ্যম গ্রেডের একজন বেসরকারি ব্যাংকার বেতন পান লাখ টাকার ওপরে৷
শীর্ষ পর্যায়ের একজন ব্যাংকারের বেতন হিসেব করা হয় মিলিয়নে (১০ লাখ)৷ পান বাড়ি, গাড়ির সুবিধা৷ আর এদের সহায়তায়ই হাজার কোটি টাকা বেরিয়ে যায় ব্যাংক থেকে, যা কখনো ফিরে আসে না৷ ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে এদের দায়িত্বহীনতার কারণেই আত্মহত্যা করতে হয় আবদুর রবদের৷ পথে বসতে হয় শত বছরের পুরনো ব্যবসায়ী পরিবারগুলোকে৷ নিজেদের উচ্চমানের সুবিধা নিশ্চিত করতেই ঋণে উচ্চহারের সুদ আরোপ করা হয়৷ আর অসহায় আমানতকারীদের করা হয় বঞ্চিত৷
দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি স্থাপিত হয় আর্থিক খাতের ওপর৷বিশ্লেষকরা বলছেন,এই খাতটিকে কখনোই রাজনীতির বাইরে নিয়ে যেতে পারেনি কোন সরকার৷ রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া হয়েছে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বীমার লাইসেন্স৷ এক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হয়নি ব্যক্তির ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা, সুনাম ও দক্ষতাকে৷ এর নজির পৃথিবীতে হয়তো খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হবে৷ ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে৷ বাংলাদেশের আর্থিক খাতে কখনোই শৃঙ্খলা আসেনি৷
ব্যাংকে নগদ ২৭ হাজার কোটি টাকা অলস পড়ে আছে৷ মানুষের হাতেও প্রচুর নগদ অর্থ আছে৷ তবে এই অর্থ বিনিয়োগের না আছে পরিবেশ, না আছে সুযোগ৷ সাধারণ মানুষের বিনিয়োগের একটি নিরাপদ মাধ্যম ছিল পুঁজিবাজার৷ তাও অব্যবস্থাপনার কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে৷ এরপর ব্যাংককে নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিল বিনিয়োগকারীরা৷ আমানতে ১২ শতাংশের ওপরে সুদ পাওয়ায় ব্যাংকে টাকা জমিয়ে নিরাপদে বাকি জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন অনেকে৷ তবে সেই সুদের হার কমাতে কমাতে ৭ শতাংশে নিয়ে আসা হয়েছে৷ অথচ মূল্যস্ফীতি দীর্ঘদিন ধরেই ৭ শতাংশের উপরে৷ এর মানে, যে পরিমাণ মুনাফা পাচ্ছেন দ্রব্যমূল্য তার চেয়ে বেশি বাড়ছে৷ এতে প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বিনিয়োগকারী৷ এই সুযোগে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে যুবক, ডেসটিনির মতো ‘হায় হায়’ কোম্পানি৷ কারণ লাভের পিছে ছুটে যাওয়াই মানুষের ধর্ম৷ বেশি লাভের আশায় আবারও হারাতে পারেন শেষ সম্বলটুকুও৷ তাই এ বিষয়ে এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জোর দাবি উঠেছে সর্বমহলে৷
সুদ-ব্যবস্থা নিয়েও ভাবনার সময় এসেছে৷ সারা পৃথিবীতেই এ নিয়ে ভাবা হচ্ছে৷ তিন হাজার বছরের পুরনো সুদ-ব্যবস্থা বর্তমানে প্রশ্নের মুখে পড়েছে৷ এখন আলোচনা হচ্ছে, ব্যাংক কি নিশ্চিত মুনাফা হিসেবে সুদ নেবে, না দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে লাভ-ক্ষতির অংশ (প্রফিট-লস শেয়ারিং)নেবে৷ আধুনিক অর্থনীতির অন্যতম মূল আলোচ্য বিষয় এটি৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুদের পরিবর্তে লাভ-ক্ষতির অংশ নেয়ার ব্যবস্থা চালু করলে ব্যাংকও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দায়বদ্ধ হবে৷
এক্ষেত্রে ব্যবসায়িক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে ব্যাংক আরও যত্নশীল হবে৷ ব্যবসায়ে লাভের সম্ভাবনা না থাকলে তখন ব্যাংক আর বিনিয়োগ করবে না৷ এখন লাভের সম্ভাবনা না থাকলেও বিনিয়োগ করে মর্টগেজের বিনিময়ে৷ ঋণগ্রহীতা ব্যবসায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ব্যাংকের ক্ষতি নেই৷ কারণ মর্টগেজকৃত সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা তুলে নিচ্ছে৷ বাপ-দাদার সম্পত্তি হারিয়ে পথে বসছেন ব্যবসায়ী৷ এজন্য ব্যাংকের দায় কোন অংশেই কম নয়৷ কারণ প্রকল্প প্রস্তাবনা যাচাই করেই ব্যাংক ঋণ দিচ্ছে৷ ব্যবসায়িক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সব ধরনের সুযোগ ব্যাংকের আছে, যা হয়তো ওই ব্যবসায়ীর নেই৷ ব্যাংকের দায়িত্বহীনতার কারণেই ঋণগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি নিজের সম্পত্তিটুকুও হারাচ্ছেন হাজারো ব্যবসায়ী৷
সুদ হার যৌক্তিকিকরণের দাবি উঠেছে ব্যবসায়ী মহল থেকে৷ এ বিষয়ে গত সপ্তাহে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রীকে একটি চিঠি দেয়া হয়েছে৷ এতে বলা হয়েছে, আমানতের বিপরীতে ৮-৯ শতাংশ সুদ দেয়ার ফলে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্যের সাথে সঙ্গতি রেখে জীবনযাপনে হিমশিম খাচ্ছেন৷ অন্যদিকে ব্যাংকগুলো ঋণের বিপরীতে ১৫-১৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদ আদায় করছে, যা সর্বসাকুল্যে ২০ শতাংশ বা ততোধিক হওয়ায় নতুন বিনিয়োগে চরম স্থবিরতাসহ উত্পাদন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ এতে দেশীয় পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক ধার হ্রাস, প্রতিষ্ঠিত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো দেউলিয়াত্বের সম্মুখীন হচ্ছে৷ কর্মসংস্থান সঙ্কুচিত হওয়ায় বেকারত্ব প্রকট আকার ধারণ করছে৷ দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা অলস পড়ে থাকা সত্ত্বেও চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বিনিয়োগের হার পূর্ব বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে৷ আমদানি-রফতানি কার্যক্রম কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনে ব্যর্থ হওয়া, নতুন শিল্পকারখানা স্থাপিত না হওয়া এবং চলমান কারখানাগুলোর সমপ্রসারণ ও উত্পাদন সন্তোষজনক না হওয়ায় কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ ব্যবসা-বাণিজ্যে মারাত্মক স্থবিরতা বিরাজ করছে বলে মনে করেন৷
দেশের অর্থনৈতিক স্থবিরতা নিরসন ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যাংকঋণের সুদের হার যৌক্তিকপর্যায়ে নির্ধারণ করতে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য অর্থমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ জানানো হয় ওই চিঠিতে৷ চিঠিটি দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম৷ খেলাপি ঋণ ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহারের অন্যতম কারণ৷ খেলাপি ঋণ সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারলে অন্তত ২ শতাংশ সুদহার কমবে৷ ঋণের উচ্চ সুদের আরেকটি বড় কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতি৷ এই মূল্যস্ফীতি কমাতে অর্থসরবরাহ কমানোসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হলেও খুব একটা কমেনি৷ ফলে কমছে না সুদহার৷
নীতি-কাঠামোর ত্রুটিতেও ঋণের সুদ হার কমে না৷ আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার নির্ধারণ করে দিত৷ কিন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রবেশের পর ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি নির্দেশনার মাধ্যমে ঋণের সুদ নির্ধারণের দায়িত্ব ব্যাংকগুলোর ওপর ছেড়ে দেয়৷ এরপর থেকেই সিস্টেমের বাইরে চলে যায় আমানত ও ঋণের সুদ হার৷ ব্যাংকগুলো ইচ্ছেমতো আমানতের সুদ হার কমিয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করছে৷ অন্যদিকে ঋণে উচ্চসুদ আরোপ করে মুনাফা লুটছে৷ দেশের মুদ্রাবাজারে প্রতিযোগিতার অভাব ঋণের উচ্চ সুদ ও আমানতে নিম্ন সুদ হারের অন্যতম কারণ৷ ৪০ বছরেও বাংলাদেশের মুদ্রাবাজার প্রকৃত বাজার হয়ে উঠতে পারেনি৷ এখানে প্রতিযোগিতার অভাবে আছে একধরনের একচেটিয়া ব্যবস্থা৷প্রতিযোগিতামূলক বাজার হিসেবে বিকশিত হতে বাংলাদেশ ব্যাংকের দিক থেকে যে ধরনের নীতি কাঠামো, সহায়তা ও হস্তক্ষেপ দরকার, তাও নেই৷
অতিরিক্ত মুনাফার মানসিকতা ও ব্যাংকারদের উচ্চ বেতন-ভাতা আমানতের নিম্ন সুদ ও ঋণে উচ্চ সুদের অন্যতম প্রধান কারণ৷ এমডিদের মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেয়া হয়৷ যেকোনো মূল্যে তাঁরা সেটা অর্জন করতে চান৷ এ জন্যও অনেক সময় ঋণ ভালোভাবে যাচাই-বাছাইও হয় না৷ হল-মার্ক, বিসমিল্লাহ কেলেঙ্কারি, চট্টগ্রামে বাচবিচারহীনভাবে কয়েকটি গ্রুপকে প্রায় ৪০-৫০ হাজার কোটি টাকার আমদানি অর্থায়ন কিংবা গ্রাহকদের ওপর বেশি মাশুল ধার্য করে অতিমুনাফা দেখানো এর বড় উদাহরণ৷আবার পরিচালকেরা ক্ষেত্রবিশেষে ব্যক্তি স্বার্থসংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত দেন৷ পরে সেই ঋণ খেলাপি হয়৷ তাতে বাড়ে ব্যাংকের ঋণের সুদ৷ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর এমডিরা বেতনসহ নগদ পান তিন লাখ টাকা৷ আর বেসরকারি খাতের ব্যাংকের এমডিদের গড় মাসিক বেতন নগদে ৭ থেকে ১৬ লাখ টাকা পর্যন্ত৷ নগদ এই হিসাবের বাইরে কয়েকগুণ পান বোনাস, গাড়ি, টেলিফোন বিল, বিদেশ ভ্রমণসহ আরও সুবিধা৷ শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে সংগতি রেখেই পরের ধাপের বেতন-ভাতা নির্ধারিত হয়৷ এসব খাতে উচ্চ ব্যয় মেটাতে ব্যয় সংকোচন করা হয় আমানতকারীর মুনাফা কমিয়ে, আর ঋণের সুদহার বাড়িয়ে৷