দৈনিকবার্তা-ঢাকা,৩ অক্টোবর : কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়ার দর ঢাকায় প্রতি বর্গ ফুট গরুর চামড়ার দাম ৭০ থেকে ৭৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে থেকে আসা চামড়ার দাম পড়বে আরো ১০ টাকা কম নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার আবু তাহের৷মহিষের লবনযুক্ত প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম পড়বে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা এবং খাসির চামড়ার দাম পড়বে ৩০ থেকে ৩৫ ও বকরির প্রতি বর্গফুট ২৫ থেকে ৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি৷
শুক্রবার সকালে ধানমণ্ডিতে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়৷ চামড়া শিল্প সংশ্লিষ্ট সংগঠন বিএফএলএলএফএইএ, বিটিএ এবং বিএইচএসএমএ আয়োজিত যৌথ সংবাদ সম্মেলন হয়৷আবু তাহের বলেন, আন্তর্জাতিক ও দেশি বাজারের প্রকৃত অবস্থার ওপর ভিত্তি করেই এবার চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে৷
ব্যবসায়ীদের দাবি, হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তর না করার অজুহাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশ থেকে চামড়া নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে৷ এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারের গেল কয়েক মাস ধরে চলমান মন্দার কারণে এবার চামড়ার দাম কম নির্ধারণ করা হয়েছে৷তারা বলেন, হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তর না করার কারণে ইউরোপের বড় বড় ব্যান্ডগুলো বাংলাদেশ থেকে চামড়া কেনা বন্ধ করে দিয়েছে৷ এ কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে চামড়ার বাজারে৷
আন্তর্জাতিক বাজারের মন্দাবস্থা এবং পাঁচার রোধে প্রশাসনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থার কারণেই এবার চামড়া পাঁচার হবে না- বলে দাবি করছেন তারা৷যদিও গেল বছর প্রতিবর্গফুট গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকা৷
এবার চামড়ার দাম গত বছরের তুলনায় অনেক কম নির্ধারণ করা হয়েছে৷ এবছর লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ঢাকায় ৭০ থেকে ৭৫ টাকা, ঢাকার বাইরে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা৷ আর খাসি ৩০ থেকে ৩৫, বকরি ২৫ থেকে ৩০ টাকা ও মহিষ ৩৫ থেকে ৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে৷এদিকে গতবছর লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ঢাকায় ছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকা, ঢাকার বাইরে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা৷ আর খাসি ৫০ থেকে ৫৫, বকরি ৪০ থেকে ৪৫ টাকা ও মহিষ ৪০ থেকে ৪৫ টাকা ছিল৷ চামড়া ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তিনটি প্রতিষ্ঠান গতবছর এ দাম নির্ধারণ করে৷
সংবাদ সম্মেলনে বিটিএর চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার মূল্য কমে যাওয়ায় দাম কমানো হয়েছে৷ ক্রেতাদেশগুলোতে অর্ডার কমে যাওয়ায় এখন পর্যন্ত ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকার চামড়া মজুদ রয়েছে৷ এসব কারণে চামড়ার দাম কমাতে হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন৷
বিএফএলএলএফইএ’র চেয়ারম্যান এম আবু তাহের এ সময় বলেন, চায়নাতে (চীন) আমরা প্রচুর চামড়া রপ্তানি করি৷ এখানে সরকার নতুন করে রপ্তানির ওপর ১৭ শতাংশ ভ্যাট বসিয়েছে৷ যে কারণে আমরা একটু সমস্যার মধ্যে আছি৷
তিনি বলেন, বর্তমানে দেশের চামড়া শিল্প এক সঙ্কটময় সময়ের মুখোমুখি৷ নতুন শিল্পনগরীতে কারখানা স্থানান্তরের উদ্দেশে বিপুল বিনিয়োগ, কমপ্লায়েন্ট কারখানা গড়ে তোলার ব্যপারে আন্তর্জাতিক চাপ, রপ্তানি বাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের মূল্যহ্রাস, পরিবেশবান্ধব নয় এমন অজুহাতসহ নানামুখী চাপে চামড়ার বাজার নিয়ে আমরা শঙ্কিত৷ তাই আমরা চেষ্টা করি সবকিছুর সঙ্গে মিল রেখে চামড়ার দাম নির্ধারণ করার৷বিএইচএসএমএ’র সভাপতি আলী হোসেনসহ এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা৷
গত বছর সরকার নির্ধারিত দাম অনুযায়ী ব্যবসায়ীরা ঢাকায় প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়া কেনেন ৮৫-৯০ টাকায়৷ আর ঢাকার বাইরে তা কেনা হয় ৭৫-৮০ টাকায়৷সারাদেশে প্রতি বর্গফুট খাসির চামড়ার দাম গত বছর ছিল ৫০-৫৫ টাকা৷ বকরির চামড়া ৪০-৪৫ টাকা এবং মহিষের চামড়া ৪০-৪৫ টাকায় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল৷গত বছর সরকার দাম ঠিক করে দিলেও এবার বাণিজ্যমন্ত্রীর নির্দেশে চামড়া ব্যবসায়ীদের তিন সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ হাইড মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার,লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এঙ্পোর্টার অ্যাসোসিয়েশন এই মূল্য নির্ধারণ করেছে৷
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহিন আহমেদ বলেন, যারা মৌসুমি ভিত্তিতে এলাকায় এলাকায় ঘুরে চামড়া সংগ্রহ করেন, তাদের প্রতি অনুরোধ- বেশি দামে চামড়া কিনবেন না৷ তা না হলে লোকসানে পড়তে হতে পারে৷ কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের ৬ ঘন্টার মধ্যে লবণ দেওয়ার জন্য মৌসুমি ব্যবসায়ীদের পরামর্শ দেন আবু তাহের৷
অন্যদের মধ্যে হাইড মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান আলী হোসেনও সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিট্যোনারি মালিকরা সারা বছরই কম- বেশি চামড়া সংগ্রহ করলেও কোরবানির ঈদেই একসঙ্গে সবচেয়ে বেশি চামড়া কেনার সুযোগ হয় তাদের৷ সারা বছর দেশে যে পরিমাণ কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা হয়, তার ৪৮ শতাংশই সংগ্রহ করা হয় এ সময়টায়৷
সাধারণত মৌসুমি ব্যবসায়ী ও ফড়িয়াদের হাত ঘুরে কোরবানির কাঁচা চামড়া ট্যানারি ব্যবসায়ীদের হাতে আসে৷ পরে প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি হয় বিভিন্ন পণ্য৷এ বছর কোরবানিতে সারা দেশ থেকে ৭০ থেকে ৭৫ লাখ চামড়া সংগ্রহ হবে বলে ব্যবসায়ীরা মনে করছেন৷এবার কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার বিরোধিতা করে বাজার পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে চামড়া সংগ্রহের আগ্রহের কথা বলেছিলেন ট্যানারি ও চামড়া ব্যবসায়ীরা৷
তাদের যুক্তি ছিল, চামড়ার ব্যবসায় সরকারি প্রণোদনা উঠে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে রয়েছেন৷ এই অবস্থায় দাম বেঁধে দিলে তারা আরো বিপড়ে পড়বেন৷তবে গত ৩০ সেপ্টেম্বর এ খাতের তিন সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, আমরা সরকার থেকে চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করতে চাই না৷জনগণ যাতে উপযুক্ত মূল্য পায়, আপনাদেরও (ব্যবসায়ী) যাতে সুবিধা হয় সে দিকে খেয়াল েেরখে মূল্য নির্ধারণ করবেন৷
কোরবানির চামড়া বিক্রির টাকা এতিমখানাসহ গরিব মানুষকে দেয়া হয় উল্লেখ করে তোফায়েল বলেন, চামড়ার ন্যায্য মূল্য মানুষ যাতে পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে৷ঈদের পর ৩০ দিন যাতে চামড়া পাচার না হয় সে ব্যাপারে সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী সেদিন বলেন, শুক্রবারের মধ্যে চামড়ার দাম নির্ধারণ করে তা মোবাইলে এসএমএস করে মাঠ পর্যায়ের ক্রেতাদেরও জানিয়ে দিতে হবে৷
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কত কমেছে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের শাহিন আহমেদ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, দাম ২০/২৫ সেন্ট কমে গেছে৷ পাশাপাশি দেশে ডলারের দামও পড়ে গেছে৷অবশ্য আইএমএফের প্রাথমিক পণ্যের মাসিক দাম পর্যালোচনায় দেখা যায়, সামপ্রতিক মাসগুলোতে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম বেড়েছে৷
শাহিন বলেন, চীন সরকার চামড়াপণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করায় সেখানে বাংলাদেশ থেকে চামড়া রপ্তানি কমে গেছে৷ রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে হংকংয়েও রপ্তানির আদেশ কমেছে৷চামড়া কেনার জন্য সরকারি ব্যাংকগুলোর ৫০২ কোটি টাকার ঋণ বিতরণের যে তথ্য গণমাধ্যমে এসেছে, তা শুভঙ্করের ফাঁকি বলে মন্তব্য করেন এই ব্যবসায়ীনেতা৷ তার দাবি, পুরনো ঋণের তথ্য ঢুকিয়ে হিসাব বড় দেখানো হচ্ছে৷ আবু তাহের দাম কমার পেছনে বাংলাদেশ থেকে চামড়া কেনার বিষয়ে বড় ব্র্যান্ডগুলোর অনীহার কথা বলেন৷
চামড়া প্রক্রিয়াজাত করবার প্রক্রিয়া পরিবেশ সম্মত না হওয়ার কথা বলে অনেক ব্র্যান্ড বাংলাদেশ থেকে চামড়া কেনা বন্ধ করে দিয়েছে৷ সমপ্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার ক্রেতারাও বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে৷প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর কোরবানিতে সারা দেশে ৬৫ লাখ ৩৯ হাজার ২০৮টি পশু জবাই হয়৷এর মধ্যে গরু ছিল ৩৩ লাখ ১২ হাজার ৮৫১টি, ছাগল ২২ লাখ ৪৬ হাজার ৮৮৬টি এবং অন্যান্য পশু ৩৮ হাজার ৩৭টি৷তবে ব্যবসায়ীদের হিসাবে কোরবানির পশুর সংখ্যা ছিল অন্তত ৭০ লাখ৷