United-Air

দৈনিকবার্তা-ঢাকা,২৪ সেপ্টেম্বর: চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদত্যাগের এক দিনের মাথায় সব ফ্লাইট বন্ধের ঘোষণা দিল ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ৷ এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ হিসেবে অর্থের অভাবকে দেখিয়েছে বাংলাদেশের বেসরকারি এই বিমান সংস্থাটি, যাদের যাত্রীসেবার মান নিয়ে বরাবরই অভিযোগ ছিল৷

অভ্যন্তরীণ রুটের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক কয়েকটি রুটে ফ্লাইট চালিয়ে আসছিল সাত বছর আগে যাত্রা শুরু করা ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ৷ কোম্পানির প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরী মঙ্গলবার পদত্যাগ করলে নতুন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয় মোহাম্মদ মাহাতাবুর রহমানকে৷এর একদিনের মধ্যে বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে ফ্লাইট বন্ধ করার ঘোষণা দিল বিমান সংস্থাটি৷

সংবাদ সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (ফ্লাইট অপারেশন্স) ক্যাপ্টেন এম ইলিয়াস বলেন, ফ্লাইট পরিচালনা করতে যে খরচ হয় এই মুহূর্তে সেই খরচ নির্বাহের অর্থ ইউনাইটেডের নেই৷ এই অবস্থায় ফ্লাইট পরিচালনা করা সম্ভব নয়৷বুধবার তিনটি আন্তর্জাতিক রুট দোহা, মাস্কাট এবং কুয়ালালামপুরে ইউনাইটেডের নির্ধারিত ফ্লাইটও ঢাকা থেকে ওড়েনি৷ইলিয়াসের বক্তব্য অনুযায়ী, বর্তমানে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ কর্তৃপক্ষহীন অবস্থায় রয়েছে৷প্রতিষ্ঠানের নতুন চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে এখনো আমাদের কারো যোগাযোগ হয়নি৷ আমরা জানি, এই পরিস্থিতিতে যাত্রীদের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে৷ কিন্তু বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানে কোনো কর্তৃপক্ষই নেই৷প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রায় এক হাজার কর্মচারীর ভবিষ্যত্‍ও অনিশ্চয়তায় রয়েছে বলে পরিচালক ইলিয়াস জানান৷

এই বিষয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের পরিচালক (ফ্লাইট সেফটি অ্যান্ড রেগুলেশনস) এস এম নাজমুল আনাম বলেন, সমস্যাটি মূলত ইউনাইটেডের কর্মী ও ম্যানেজমেন্টের সমস্যা৷ আমরা তাদের বলেছি, তারা চাইলে ফ্লাইট চালাতে পারে৷তাসবিরুল আহমেদের পদত্যাগের পর ইউনাইটেডের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন শাহিনুর আলম৷ অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার ফেরদৌস ইমামকে প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব দিয়েছে ইউনাইটেড এয়ার বোর্ড৷

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) ২০০৫ সালে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজকে বিমান পরিচালনা করার লাইসেন্স দেয়৷ তার দুই বছর পর যাত্রী পরিবহন শুরু করে তারা৷বকেয়া পাওনা পরিশোধের জন্য বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ সমপ্রতি কয়েক দফা সময় বেঁধে দেয় ইউনাইটেড এয়ারওয়েজকে৷ তারপরও তা পরিশোধ না করায় প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স বাতিলেরও হুমকি দেয়া হয়৷

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ইউনাইটেডের কাছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের মোট পাওনার পরিমাণ ৮৪ কোটি টাকা৷মঙ্গলবার ডিএসইর ওয়েবসাইটে এক নোটিসে জানানো হয়, গত অর্থবছরের জন্য বিনিয়োগকারীদের ১০ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ দেয়ার সুপারিশ করেছে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের পরিচালনা পর্ষদ৷

ঢাকা থেকে আন্তর্জাতিক রুট জেদ্দা, দুবাই, মাস্কাট, কুয়ালালামপুর, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, কাঠমান্ডু, কলকাতা এবং চট্টগ্রাম থেকে মাস্কাট ও কলকাতা রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করে আসছিল ইউনাইটেড এয়ার৷অভ্যন্তরীণ রুটে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, কঙ্বাজার, সিলেট, যশোর, রাজশাহী, সৈয়দপুর, ঈশ্বরদী ও বরিশালে চলছিল ইউনাইটেডের ফ্লাইট৷

ইউনাইটেডের বহরে রয়েছে একটি ড্যাশ-৮, তিনটি এটিআর-৭২, পাঁচটি এমডি-৮৩ এবং দুটি এয়ারবাস-৩১০সহ মোট ১১টি উড়োজাহাজ৷ তিন বিমান সংস্থার কাছে বেসামরিক বিমান (সিভিল এভিয়েশন) কর্তৃপক্ষের বকেয়া পাওনা ৪৫১ কোটি টাকা৷ বারবার তাগাদা দিয়েও কাজ হচ্ছে না৷ এতে আর্থিক সঙ্কটে পড়েছে সরকারি এ সংস্থা৷ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড থেমে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে৷ এমনকি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গত আগস্ট মাসের বেতন এখনো হয়নি৷এমনটাই জানিয়েছে সিভিল এভিয়েশনের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র৷

সূত্র আরো জানায়, ২০০৯ সাল থেকে বিমান বাংলাদেশের কাছে বিমান উড্ডয়ন, অবতরণ, বিদু্যত্‍, পানি, গ্যাস, অফিস ভাড়া, স্ক্যানিং মেশিন ও বোর্ডিং ব্রিজ ব্যবহারসহ অ্যারোনটিক্যাল ও নন-অ্যারোনটিক্যাল খাতে ৩২০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে সিভিল এভিয়েশনের৷ কর্তৃপক্ষ বারবার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও তা পরিশোধ করছেন না বিমান৷

এছাড়া বেসরকারি বিমান সংস্থা রিজেন্ট এয়ারওয়েজের কাছে ১৪ কোটি ৪২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা এবং জিএমজি এয়ারলাইনসের কাছে ১১৭ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে৷ জিএমজি এয়ারলাইনস পাওনা পরিশোধ না করেই ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে৷উড়োজাহাজের জ্বালানি ও ইনফ্লাইট খাবার না থাকাসহ নানা কারণে বৃহস্পতিবার েথেকে আর কোনো ফ্লাইট পরিচালনা করা সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের কর্মীরা৷ বুধবার সন্ধ্যা ৭টায় উত্তরায় এয়ারওয়েজের প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলন একথা জানানো হয়৷

সংবাদ সম্মেলনে এয়ারলাইন্সের হেড অব মার্কেটিং আফতাব, ডিরেক্টর ফ্লাইট অপারেশন ক্যাপ্টেন ইলিয়াস, ক্যাপ্টেন ওয়াহিদ, ডিরেক্টর প্রশাসন উইং কমান্ডার (অব.) ফেরদৌস, ডিরেক্টর কাস্টমার সার্ভিস ফরহাদ, শাহাবসহ উধর্্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন৷ চলমান পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে এরই মধ্যে এয়ারওয়েজের দুই ডিরেক্টর পদত্যাগ করেছেন৷ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরীরর পদত্যাগের জের ধরে এয়ারলাইন্সের চরম অব্যবস্থাপনা তৈরি হয়েছে৷

সংবাদ সম্মেলনে ক্যাপ্টেন ইলিয়াস এয়ারলাইন্স পরিচালনা করতে অনতিবিলম্বে একজন দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিকে সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানান৷ ক্যাপ্টেন ইলিয়াস বলেন, কোম্পানি আইন অনুযায়ী দক্ষ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ পাওয়ার আশা করছি৷ এমনকি পদত্যাগী চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন তাসবিরকে ফিরিয়ে এনেও পরিস্থিতি সামলানো যেতে পারে৷ সোমবার নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান মাহতাবুর রহমান৷ শাহীনুর আলম বুধবার নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করার কথা থাকলেও তিনি যোগ দেননি৷ এ কারণে এয়ারওয়েজের ঊধর্্ব্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সব কর্মীর মধ্যে আরো বেশি অনিশ্চয়তা তৈরি হয়৷

সংবাদ সম্মেলন বলা হয়, নতুন চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাউকে না পাওয়ায় বিগত দুই দিন ধরে ফ্লাইট অপারেশন পরিচালনায় চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়৷ বুধবার ঢাকা-দোহা-মাস্কাট, ঢাকা-কুয়ালালামপুর ফ্লাইটসহ চারটি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বাতিল হয়৷ক্যাপ্টেন ইলিয়াস বলেন, ২২ সেপ্টেম্বরের ১৫ মিনিটের সভায় তিনি পদত্যাগ করেন৷ নতুন পর্ষদ শাহীনুর আলম নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচারক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর বিগত দুই দিনে কেউই ম্যানেজমেন্ট পর্যায়ের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করেননি৷ ফুয়েল নাই, ক্যাটারিং নাই৷ এছাড়াও অনেক খরচের বিষয়টিও জড়িত৷

তিনি বলেন, ডিরেক্টর প্রশাসন উইং কমান্ডার (অব.) ফেরদৌসকে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়৷ দায়িত্ব নেওয়ার ৪ ঘন্টার মধ্যে তিনি পদত্যাগ করেন৷ ডিরেক্টর রেভিনিউ ও কোম্পানি সচিব গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অব.) খোরশেদও পদত্যাগ করেন৷আমি নিজে মাস্কাটে ফ্লাইটে নিয়ে যাই আমি৷ নিয়মানুযায়ী ৮ জন ক্রকে ওখানে রেখে আসার কথা থাকলেও চলমান সংকটের কারণে তাদেরকে পুনরায় ঢাকায় ফিরে আসতে বাধ্য হই৷ সবার মধ্যে চরম আতঙ্ক কাজ করছে৷ তেল নেই৷ নতুন ফ্লাইট চলার সুযোগ নেই৷
বুধবার আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীন রুটের পাঁচটি ফ্লাইট বাতিল করেছে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ৷ এর ফলে গন্তব্যে যেতে না পারা যাত্রীরা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বহির্গমন টার্মিনালে বিক্ষোভ করছেন৷সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক রুটের কাতারগামী একটি ও ওমানগামী একটি ফ্লাইট বাতিল করা হয়৷ একইসঙ্গে বাতিল করা হয় অভ্যন্তরীন রুটে চলাচলকারী তিনটি ফ্লাইটও৷

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ইউনাইটেডের এ সিদ্ধান্তে গন্তব্যে যেতে না পারায় ভোগান্তিতে পড়া যাত্রীরা বিমানবন্দরের বহির্গমন টার্মিনালে বিক্ষোভ শুরু করেন৷বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিরুদ্ধে দুই লাখ ৩০ হাজার ৫২০ লাখ ডলার ক্ষতির অভিযোগ এনেছে উড়োজাহাজে সেবাদ্রব্য উত্‍পাদনকারী প্রতিষ্ঠান ফরমিয়া এয়ারলাইন সাপ্লাইস লিমিটেড৷ দ্রুত বিষয়টির সমাধান না হলে বিমানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে হংকং ভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক লি ওয়াই কুয়েন৷সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ফরমিয়ার আইনি সহায়ক প্রতিষ্ঠান লিগ্যাসি লিগ্যাল করপোরেট (এলএলসি) এর সিনিয়র পার্টনার ব্যারিস্টার জেনিফার আশরাফ৷

জেনিফার আশরাফ বলেন, বিমান পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ২০০৬ সঠিকভাবে অনুসরণ না করার কারণে বিমানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বাজারের বাংলাদেশের সুনাম অক্ষুন্ন রাখার জন্য এই দ্বন্দ্বে আশু সমাধান করার আহ্বান জানাচ্ছি৷তিনি বলেন, হজ ফ্লাইটের দু’দিন আগে শেষ মুহূর্তে তারা অর্ডার বাতিল করে ফরমিয়ার আর্থিক ক্ষতি করেছে৷