5-Secretary

দৈনিকবার্তা-ঢাকা,২২ সেপ্টেম্বর: দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)তদন্তে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেওয়ার প্রক্রিয়ায় অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ায় চারজন সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করা হয়েছে৷একই অভিযোগে অপরজনের সনদ স্থগিত করা হয়৷ সোমবার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়৷ এর মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁদের নেওয়া সুবিধা পুরোপুরি বাতিল হয়ে গেল৷

যাঁদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল হয়েছে তাঁরা হলেন, স্বাস্থ্যসচিব নিয়াজউদ্দিন মিঞা, সদ্য ওএসডি হওয়া মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী, সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) সচিব এ কে এম আমির হোসেন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (ওএসডি) আবুল কাশেম তালুকদার৷ যাঁর সনদ স্থগিত হয়েছে তিনি হলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান (বর্তমানে প্রতিমন্ত্রী মর্যাদা বেসরকারীকরণ কমিশনের চেয়ারম্যান)৷

এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হোসেন জানান,প্রজ্ঞাপনটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে৷ এ মন্ত্রণালয় এবার এই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনগত বা বিভাগীয় ব্যবস্থা নেবে৷ রাষ্ট্রপতির আদেশে এ প্রজ্ঞাপনে সই করেছেন মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. সলিমুল্লাহ৷মন্ত্রী বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের সুপারিশে ৫ সচিবের মধ্যে মোল্লা ওয়াহিদু্জ্জামান সনদ নেয়ার ৫টি প্রক্রিয়ার মধ্যে ৪টি ধাপ পূরণ করেছেন৷ জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) পক্ষ থেকে তার জন্য সুপারিশ এসেছে৷ এর জন্য তার সনদ স্থগিত করা হয়েছে৷

জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ কাউন্সিলের (জামুকা)বৈঠকে সনদ বাতিলের সিদ্ধান্ত হওয়ার নয় দিন পর মন্ত্রণালয় সোমবার এই গেজেট প্রকাশ করল৷ সনদ বাতিল হওয়া চারজনের মধ্যে স্বাস্থ্য সচিব এম নিয়াজ উদ্দিন মিয়াও আছেন, যিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্র সফরে তার সঙ্গে রয়েছেন৷

বাকি তিনজন হলেন সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি)সচিব একে এম আমির হোসেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী (বর্তমানে ওএসডি) এবং একই মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব (ওএসডি) আবুল কাসেম তালুকদার৷তার সনদ বাতিল না করার ব্যাখ্যা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক নিজের দপ্তরে সাংবাদিকদের বলেন, অতি উত্‍সাহী কর্মকর্তারা শেষ ধাপ না মেনে তার গেজেট প্রকাশ করেন, যা এনএসআইয়ের তদন্তেও বেরিয়ে এসেছে৷ তাই তার সনদ বাতিল না করে স্থগিত করা হয়েছে৷এ বিষয়ে মোল্লা ওয়াহিদুজ্জানকে চিঠি দেয়া হবে জানিয়ে মোজাম্মেল হক বলেন, তাকে শুনানিরও সুযোগ দেয়া হবে৷

সরকারের এই পাঁচ কর্মকর্তা অবৈধ প্রক্রিয়ায় মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেন বলে তদন্তে বেরিয়ে এলে তা বাতিলের সুপারিশ করে দুদক৷ ওই সুপারিশের পর গত ১৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ কাউন্সিলের (জামুকা) বৈঠকে সনদ বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়৷

সরকারের চার কর্মকর্তার সনদ ও গেজেট বাতিলের চিঠি সোমবারই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে জানিয়ে মোজাম্মেল বলেন, আজই তারা চিঠি পেয়ে যাবেন৷জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তাদের বিবেচনা মতো এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে বলে আশা করছি৷ আমরা অপেক্ষা করছি তারা (জনপ্রশাসন) কি করে৷ এ নিয়ে অগ্রিম ভাবব না৷কারণ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ই ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার রাখে৷তবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আশ্বাস দেন, জনপ্রশাসনের এই শীর্ষ কর্মকর্তারা জালিয়াতি করে পার পাবেন না৷

দুদকের সুপারিশের আলোকে চার কর্মকর্তার মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করাকে অগ্রগতি দাবি করে তিনি বলেন, বাকিটুকুও হবে৷ কে কোন পর্যায়ের এটা দিয়ে বিচার করি না৷ কে কি অপরাধ করল সেটাই বিবেচ্য৷ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা না নিলে তখন ভাবব৷ পরবর্তীতে আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলে পদক্ষেপ নেব৷

মন্ত্রী জানান, এ পর্যন্ত চারশ’র মতো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ পাওয়া গেছে৷ জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ কাউন্সিলের বৈঠকে এ দের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে৷সচিবদের ভুয়া সদন পাইয়ে দেয়ার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যেসব কর্মকর্তা জড়িত তাদের বিষয়েও পরে বিবেচনা করা হবে বলে মন্তব্য করেন মন্ত্রী৷স্বাস্থ্যসচিব নিয়াজ উদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী করার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মন্ত্রী বলেন, চূড়ান্ত শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দোষী বলা যায় না৷

এদিকে, নিয়ম লঙ্ঘন করে গেজেট প্রকাশ করায় ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন, বিশেষ গেরিলা বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের দুই হাজার ৩৬৭ জনের তালিকা বাতিল করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়৷ সোমবার চিঠি দিয়ে এ গেজেট বাতিলের বিষয়টি জানিয়ে দেবে মন্ত্রণালয়৷২০১৩ সালের ৪ আগস্ট জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন, ২০০২-এর ৭ ধারা অনুযায়ী এ গেজেট প্রকাশ করা হয়৷ এই গেজেটেই জুড়ে দেওয়া হয়েছিল ওএসডি হওয়া মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সচিব মাসুদ সিদ্দিকীর নাম৷এদিকে চার সচিব ও এক যুগ্ম সচিবের সনদ বাতিলের নথিতে রোববার সই করেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক৷ গত রাতে তিনি জানান, সাময়িক সনদ ও গেজেট বাতিলের চিঠিও প্রস্তুত রয়েছে৷

জামুকার বৈঠকে সনদ বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক সপ্তাহ পার হলেও পাঁচ সচিবের বিরুদ্ধে আইনি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি৷ গত শনিবার বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বিবিসি সংলাপে বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, এঁদের চাকরিচু্যত করা উচিত৷ দুদক এঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছে৷ আশা করি, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেবে৷

মন্ত্রণালয় তো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, উল্টো প্রধানমন্ত্রীর সাবেক সচিব মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানের সনদ বাতিল না করে স্থগিত করা হচ্ছে বলে জানা গেছে৷ আবার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ গ্রহণকারী স্বাস্থ্যসচিব নিয়াজ উদ্দিন মিয়া জাতিসংঘের ৬৯তম সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে যুক্তরাষ্ট্র গেছেন৷

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত বছর জামুকার এক বৈঠকে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন, বিশেষ গেরিলা বাহিনীর চার হাজার ৪৪৫ জনের তালিকা অনুমোদন করা হয়৷ এর মধ্যে দুই হাজার ৩৬৭ জনের নাম জেলা ভাগ করে গেজেটভুক্ত করা হয়৷ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, আলাদা আলাদা আবেদন না করে একসঙ্গে এত মুক্তিযোদ্ধার নাম অনুমোদন করা আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক৷ এ জন্য এ তালিকা বাতিল করা হয়েছে৷ ওএসডি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সচিব তাঁর নাম যুক্ত করতেই তড়িঘড়ি করে এ তালিকা অনুমোদন দিয়েছেন৷ এখন প্রত্যেককে জামুকা আইন অনুযায়ী আলাদা আলাদা আবেদন করতে হবে৷জানা গেছে, মমতাজ আলী নামের এক ব্যক্তি ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন, বিশেষ রেগরিলা বাহিনীর তালিকায় থাকা ২৪ জনের বিরুদ্ধে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার অভিযোগ এনে রিট আবেদন করেন৷ রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৪ জন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত হন৷ ওই ২৪ জনের তালিকাও কাল বাতিল করা হয়৷ এ ছাড়া সামপ্রতিক সময়ে ১৮২ জন সরকারি কর্মকর্তার মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করা হয়েছে৷

এ বি য়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, আমরা সঠিক তালিকাই দিয়েছি৷কোনো ভুল রয়েছে বলে মনে হয় না৷ একই পরিবারের সবাই যুদ্ধ করলে অনেকের নাম থাকতেই পারে৷ তবে তালিকা বাতিলের বিষয়ে আমাদের কিছুই জানানো হয়নি৷