দৈনিকবার্তা-ঢাকা,২২ সেপ্টেম্বর: বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা আইন প্রণেতাদের হাতে ফিরিয়ে দিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন বিলে সম্মতি দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ৷দশম জাতীয় সংসদের তৃতীয় অধিবেশনে পাস হওয়া ৪টি বিলে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সম্মতি জানান৷ রোবাবর সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়৷ ডিঅঙ্রিাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) বিল ২০১৪, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ (সংশোধন) বিল ২০১৪, ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ বিল, ২০১৪ এবং সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) বিল ২০১৪৷
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন বিলের বিরোধিতায় বিএনপি নেতৃত্বাধীনেেজাটের হরতাল এবং পুনর্বিবেচনার জন্য সংসদে ফেরত পাঠানোর আহ্বানের মধ্যেই সোমবার রাষ্ট্রপতি এই বিলে সই করেন৷সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানান, রাষ্ট্রপতির সম্মতি পাওয়ায় এখন গেজেট প্রকাশের প্রক্রিয়া চলছে৷গেজেট প্রকাশিত হলেই শেষ হবে সংবিধান ( ষোড়শ সংশোধন) বিল-২০১৪’ এর আইনে পরিণত হওয়ার আনুষ্ঠানিকতা৷ এ আইনের ফলে অসদাচরণ ও অসামথ্যের’ অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিচারপতিদের অপসারণ করতে পারবে সংসদ, যে ক্ষমতা স্বাধীনতার পর চার বছর পর্যন্ত আইন প্রণেতাদের হাতেই ছিল৷এর ফলে বিচারপতি অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিষয়টি আর থাকছে না৷
ষোড়শ সংশোধনী অনুযায়ী বিচারপতি অপসারণের ক্ষেত্রে তাদের ‘অসামথর্্য ও অসদাচরণের’ তদন্ত ও প্রমাণের বিষয়ে আলাদা একটি আইন হবে, যা আগামী তিন মাসেই করা হবে বলে আইনমন্ত্রী ইতোমধ্যে জানিয়েছেন৷সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি এবং জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের বিরোধিতার মধ্যে গত ১৭ সেপ্টেম্বর সংসদে সর্বসম্মত ভোটে বিলটি পাস হয়৷
বিএনপি বলে আসছে, বিচার বিভাগের ওপর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী লীগ সংবিধান সংশোধন করেছে৷ক্ষমতায় ফিরলে আওয়ামী লীগ আমলে আনা সংশোধনীগুলো বাতিলের ঘোষণাও দিয়েছে দলটি৷অন্যদিকে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের সন্দেহ, ভালোমতো যাচাই না করে এই মুহূর্তে প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও তড়িঘড়ি করে এ আইন পাসের ক্ষেত্রে অন্য কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে৷
তবে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বারবার বলে আসছেন, বিএনপি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা না বুঝেই সমালোচনা করছেন৷আমরা শুধু বাহাত্তরের অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন করছি৷ বিচারপতিদের অভিসংশন নয়, বরং অপসারণও করবে না সংসদ৷ তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে সংসদ তা অনুমোদন করবে৷
১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ছিল৷১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর (বাকশাল গঠন) মাধ্যমে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়৷চতুর্থ সংশোধনী বাতিল হলে জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকারের আমলে এক সামরিক আদেশে বিচারপতিদের অভিশংসনের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হয়৷
২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর সময়ে বিচারপতিদের সরানোর ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেয়া নিয়ে আলোচনা ওঠে, যদিও তখন তা করা হয়নি৷ পরে ২০১২ সালে তত্কালীন স্পিকার ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের একটি রুলিংকে কেন্দ্র করে কয়েকজন সংসদ সদস্য হাই কোটের্র একজন বিচারপতিকে অপসারণের দাবি তোলেন৷মূলত সে সময়েই বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনার দাবি জোরালো হয়৷
গত ৭ সেপ্টেম্বর সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) বিল-২০১৪’ সংসদে উত্থাপনের পর পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য এক সপ্তাহ সময় দিয়ে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়৷ দুটি বৈঠক করে সংসদীয় কমিটি বিলটি পরীক্ষা করে সুপারিশসহ প্রতিবেদন সংসদে উপস্থাপন করেন৷
সংসদীয় কমিটি বিলের দীর্ঘ প্রস্তাবনা বাদ দেয় এবং উদ্দেশ্যে ও কারণ সম্বলিত বিবৃতিতে কিছু পরিবর্তন আনে৷সংসদে উত্থাপিত প্রস্তাবে,কোনো বিচারপতির অসদাচরণ বা অসামথর্্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণ আইন করে সংসদ নিয়ন্ত্রণ করার শর্ত রাখা হয়৷
সংবিধান সংশোধন বিল পাসের আগে বিলের ওপর দেওয়া জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে পাঠানো এবং সংশোধনী প্রস্তাবগুলো কন্ঠভোটে নাকচ হয়৷এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর সংসদে বিভক্তি ভোটে সর্বসম্মতভাবে বিলটি পাস হয়৷ এখন গেজেট প্রকাশিত হলেই ‘সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) বিল-২০১৪’ এর আইনে পরিণত হওয়ার সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে৷ এই আইনের ফলে অসদাচরণ ও অসামথ্যের্র অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিচারপতিদের অপসারণ করতে পারবে সংসদ, যে ক্ষমতা স্বাধীনতার পর চার বছর পর্যন্ত আইন ট্রণেতাদের হাতেই ছিল৷এর ফলে বিচারপতি অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিষয়টি আর থাকছে না৷
এই বিলে রাষ্ট্রপতি সই করার কয়েক ঘন্টা আগে তা পুনর্বিবেচনার জন্য সংসদে ফেরত পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছিল বিএনপি৷ একজন আইনজীবীও একই আবেদন জানিয়ে রাষ্ট্রপতিকে একটি চিঠি পাঠান৷ সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি এবং জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের বিরোধিতার মধ্যে গত ১৭ সেপ্টেম্বর সংসদে সর্বসম্মত ভোটে বিলটি পাস হয়এর প্রতিবাদে সোমবার দেমব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট৷ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিলে বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের কাছে দেয়ার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য আবারো সংসদে পাঠাতে রাষ্ট্রপতির প্রতি আহ্বান জানান বিএনপি৷
সোমবার সকালে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে হরতালের সার্বিক চিত্র তুলে ধরে দলটির যুগ্ম-সহাসচিব মো. শাহজাহান রাষ্ট্রপতির কাছে এ আহ্বান জানান৷ শাহজাহান বলেন, বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেয়ার বিধান রেখে সংসদে পাস হওয়া বিল রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করলেই তা আইনে পরিণত হবে৷ রাষ্ট্রপতি একজন বিজ্ঞ আইনজীবী৷ আমরা তাকে আহ্বান জানাই, তিনি যেন বিলে স্বাক্ষর না করেন৷ এটি যেন পুনঃবিবেচনার জন্য সংসদের কাছে পাঠান৷
বিএনপির এই নেতা বলেন, তা না হলে আমরা ধরে নেবো ১৯৭৫ সালের সংসদে সব দলকে নিষিদ্ধ করে যেভাবে একদলীয় বাকশাল কায়েম করা হয়েছিল সে পথেই হাঁটছে বর্তমান সরকার৷ শাহজাহান বলেন, দেশের জনগণ বিচারপতিদের ওপর সরকারি হস্তক্ষেপ পচ্ছন্দ করেন না৷ তাই তারা ২০ দলীয় জোটের হরতালকে সমর্থন করেছেন এবং শান্তিপূর্ণভাবে তারা এ কর্মসূচি পালন করছেন৷তিনি বলেন,বিএনপির নেতা কর্মীদের মুক্তির দাবিতে ও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যে আমাদের এই হরতাল নয়৷ এ হরতাল জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার৷