দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২১ সেপ্টেম্বর: র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) মহাপরিচালক মো. মোখলেছুর রহমান বলেছেন, অপরাধে জড়িত কোনো সদস্যের দায়মুক্তি চায় না র্যাব৷ নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনা আগে থেকে জানতো না র্যাব সদর দফতর৷ রোববার বেলা ২টার দিকে র্যাব সদর দফতরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন৷
নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও সিনিয়র আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ সাতজনকে অপহরণের পর হত্যা করে শীতলক্ষ্যা নদীতে লাশ ডুবিয়ে দেওয়া হয়৷ ঘটনার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ র্যাবের শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তার জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে৷ যারা এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে কারাগারে রয়েছেন৷ সাত খুনের নির্দেশনা সদর দফতর থেকে দেওয়া হয়েছিল বলে বিভিন্ন মহল অভিযোগ করে৷ যা গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়৷ তবে প্রথম থেকেই র্যাব এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে৷
রোববার র্যাব মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান দৃঢ়তার সঙ্গে দাবি করেন, নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনা র্যাব সদর দফতর আগে থেকে জানতো না৷তিনি বলেন, ঘটনা জানার পর বরং র্যাব স্বউদ্যোগে তদন্ত শুরু করে এবং জড়িতদের সম্পর্কে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে৷ সেই সঙ্গে র্যাব পুলিশকেও তদন্তে সহায়তা করছে৷তিনি আরো বলেন, র্যাবের কোনো সদস্য অপরাধে জড়িয়ে পড়লে র্যাব তার দায়মুক্তি চায় না৷ অতীতে কোনো র্যাব সদস্যের দায়মুক্তি চাওয়া হয়নি, সরকারের পক্ষ থেকে কাউকে দায়মুক্তি দেওয়াও হয়নি৷
নারায়ণগঞ্জের নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সদর দপ্তর থেকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া-সংক্রান্ত তথ্য সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন সংস্থাটির মহাপরিচালক (ডিজি) মোখলেছুর রহমান৷ মোখলেছুর রহমানের ভাষ্য, সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে ধরার জন্য র্যাব সদর দপ্তর থেকে নির্দেশ দেওয়া হয় না৷ অধিনায়কদের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে তাঁদের নির্দেশনা দেওয়া হয়৷ কাকে ধরা হবে বা হবে না, সেটা অধিনায়কদের বিবেচনা৷ নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের বিষয়ে র্যাবের মহাপরিচালকের দাবি, ঘটনা জানার পরপরই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সব জানিয়েছে র্যাব৷ কোনো কিছুই গোপন করা হয়নি৷ সঠিক তথ্য জেনে সত্য উদঘাটনে সহায়তা করেছে র্যাব৷মোখলেছুর রহমান আরও দাবি করেন, আসামি গ্রেপ্তার এবং মামলাসংশ্লিষ্ট বিষয়ে পুলিশকে সহায়তা করেছে র্যাব৷
ঘটনার জন্য পুরো বাহিনীকে দোষারোপ না করে অপরাধীদের বিষয়ে লেখালেখি করতে গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানান র্যাবের মহাপরিচালক৷ তাঁর মতে, প্রতিষ্ঠান হিসেবে র্যাব ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেশের মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷র্যাবের সদর দপ্তর থেকেই কাউন্সিলর নজরুলকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল৷ র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) কর্নেল জিয়াউল আহসান র্যাব-১১-এর তত্কালীন অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মাদকে এ নির্দেশ দিয়েছিলেন গত মার্চে৷ নজরুলকে অপহরণ ও হত্যা করা হয় পরের মাস এপ্রিলের শেষ দিকে৷ বহুল আলোচিত সাত খুন মামলার অন্যতম আসামি লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মাদ ১৬৪ ধারায় আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এ তথ্য দিয়েছেন বলে তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে৷
একই মামলার আরেক আসামি র্যাব-১১-এর সাবেক উপ-অধিনায়ক মেজর আরিফ হোসেন আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, আটকের পর প্রত্যক্ষদর্শীসহ সাতজনকেই গুম করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তারেক সাঈদ৷ আর নজরুলের বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ র্যাবকে সব ধরনের তথ্য দিয়েছেন আরেক কাউন্সিলর নূর হোসেন৷ মেজর আরিফ আরও দাবি করেছেন, সাতজনকে গুম করার পর তথ্যদাতা নূর হোসেনকেও মেরে ফেলার নির্দেশ দেন র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়া৷ কিন্তু পালিয়ে গিয়ে রক্ষা পান নূর হোসেন৷ অবশ্য তারেক সাঈদের জবানবন্দিতে এ কথার উল্লেখ নেই৷
গত ৪ জুন আরিফ হোসেন এবং ১৮ জুন তারেক সাঈদ নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম কে এম মহিউদ্দিনের আদালতে ১৬৪ ধারায় এই জবানবন্দি দেন৷আদালত সূত্র জানায়, অপহরণ এবং হত্যার পর গুম করার পুরো কাজটি নিজেই করেছেন বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন আরিফ হোসেন৷ তারেক সাঈদের সরাসরি নির্দেশে এ কাজটি তিনি করেছেন বলেও জানিয়েছেন৷ আর অধিনায়কের বক্তব্য হচ্ছে, গুম করার নির্দেশ তিনি দেননি৷ নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় দুজনসহ মোট ২৬ জন গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে জেলহাজতে আছেন৷ ইতিমধ্যে জবানবন্দি দিয়েছেন ১৪ জন৷
অপহরণের ঘটনা ঘটেছিল গত ২৭ এপ্রিল দুপুরে৷ জবানবন্দি অনুযায়ী, ওই রাতেই সাতজনকে হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যায় ইট বেঁধে ডুবিয়ে দেওয়া হয়৷ তবে এখন পর্যন্ত এই মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি৷ নূর হোসেন কলকাতা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে সেখানেই আছেন৷
প্রসঙ্গত,বৃহস্পতিবার ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে আনা একটি যৌথ প্রস্তাব পাস হয়৷ ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশের মানবাধিকার ও হত্যা-গুম-খুন-লুট এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নামে নাগরিকদের অপহরণ-খুন ও বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক হয়৷ বৃহস্পতিবার এ বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়৷ ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশে মানবাধিকার এবং হত্যা, গুম, খুন, লুট, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নামে নাগরিকদের অপহরণ, খুন, বিনা বিচারে হত্যাকান্ড এই সব বিষয় নিয়ে বির্তক হয়েছে৷
নির্ধারিত ডিবেট এর শিরোনাম ছিলো- হিউম্যান রাইটস ভায়োলেশন ইন বাংলাদেশ (২০১৪/২৮৩৪ (আরএসপি) এবং পার্লামেন্ট ও কমিশনের রম্নল ১৩৫ মোতাবেক ডিবেট অন কেইসেস অব ব্রীচেস অব হিউম্যান রাইটস, ডেমোক্রেসি এন্ড দ্য রুল..(ম্যাঙ্মিাম রুল ১৩৫) অধীনে পার্লামেন্টে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার লঙ্ঘন, আইনের শাসন ভুলুন্ঠিত এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে এলিট ফোর্সর্ র্যাব ও ডিবির নামে রাজনৈতিক নেতা, কর্মী ও সাধারণ নাগরিকদের চোখ মুখ বেধে ধরে নিয়ে পরবর্তীতে পরিবারের কাছে লাশ না দেয়া, র্যাব বিলুপ্তি, ইলিয়াস আলীর সন্ধান ইত্যাদি দাবী নিয়ে পার্লামেন্টে এই নির্ধারিত বিতর্কে সরকারের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে৷ বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বিতর্ক এবং র্যাব বিলুপ্তির দাবি উঠছে ইইউ পার্লামেন্টে৷
ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশে মানবাধিকার ভূলুন্ঠিত এবং হত্যা, গুম, খুন, লুট, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নামে নাগরিকদের অপহরণ, খুন, বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড পার্লামেন্টের নির্ধারিত এজেন্ডায় স্থান পায়৷
নির্ধারিত ডিবেটের শিরোনাম রয়েছে- হিউম্যান রাইটস ভায়োলেশন ইন বাংলাদেশ (২০১৪/২৮৩৪ (আরএসপি) এবং পার্লামেন্ট ও কমিশনের রুল ১৩৫ মোতাবেক ডিবেট অন কেইসেস অব ব্রিচেস অব হিউম্যান রাইটস, ডেমোক্রেসি এন্ড দ্য রুল (ম্যাঙ্মিাম রুল ১৩৫)৷ বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার লঙ্ঘন, আইনের শাসন ভূলুন্ঠিত এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে এলিট ফোর্স র্যাব ও ডিবির নামে রাজনৈতিক নেতা, কর্মী ও সাধারণ নাগরিকদের চোখ মুখ বেঁধে ধরে নিয়ে গুম করে দেয়া, র্যাব বিলুপ্তি, ইলিয়াস আলীর সন্ধান দাবি নিয়ে ইইউ পার্লামেন্টে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হবে৷তাই বাংলাদেশের আইন-শঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে এখন পশ্চিমা বিশ্বে ব্যাপক কৌতুহল দেখা দিয়েছে৷
এদিকে, বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্টে পাস হওয়া যৌথ প্রস্তাবটি বিবেচনায় নিয়ে র্যাবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা৷বিদেশি একটি সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে এ আহ্বান জানান আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ও বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার প্রধান নির্বাহী ব্যারিস্টার সিগমা হুদা৷
সুলতানা কামাল বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রস্তাবে নৈতিক সমর্থন জানিয়ে বলেন, ‘২০০৪ সাল থেকে বলে যাচ্ছি, র্যাব তাদের পরিধির বাইরে গিয়ে অনেক কাজ করেছে৷ এটার একটি বিচার হওয়া উচিত এবং এর শাস্তিও নিশ্চিত করা উচিত৷ আমরাও বার বার দায়মুক্তির বিরোধিতা করেছি৷’ যাদের গুম করা হয়েছে, তাদের ছেড়ে দেয়ার দাবির সঙ্গেও একমত জানান সুলতানা কামাল৷