01_96409

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১৯ সেপ্টেম্বর: কোরবানির ঈদের পর সরকারবিরোধী আন্দোলন নিয়ে নতুন করে পরিকল্পনা সাজাচ্ছে বিএনপি৷ দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলায় লিভ টু আপিল খারিজ, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলায় চার্জগঠনের প্রেক্ষাপট ও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই বিএনপি তাদের আন্দোলন পরিকল্পনা নিয়ে নতুন করে ভাবছে বলে জানিয়েছেন দলটির একাধিক নীতিনির্ধারক৷

এদিকে,সংলাপের বিষয়ে এখনও হাল ছাড়েনি বিএনপি৷ দলের চেয়ারপারসন থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের নেতারা প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন ফোরাম থেকে সংলাপে বসার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছেন৷ বিএনপি নেতারা বলছেন, ৫ জানুয়ারির আগে সরকারই বলেছিল, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্যই এ নির্বাচন৷সরকার বলেছিল, নির্বাচনের পর এ সংসদ ভেঙে দিয়ে আলোচনা করা হবে৷ আমরা তাদের সে ওয়াদাই পূরণ করতে বলছি৷ কিন্তু আওয়ামী লীগ এ বিষয়ে না সূচক জবাব দিচ্ছে৷এ সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে কোনো সংলাপ নয় বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন শাসক দলের শীর্ষ নেতারা৷

সরকারের না প্রসঙ্গে দলের অবস্থান জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ৫ জানুয়ারির আগে সরকারই বলেছিল, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় তারা ওই নির্বাচন করছে৷ ওটা ছিল সাংবিধানিক অনিবার্যতা৷ নির্বাচনের পর আলোচনা করে সংসদ ভেঙে দেয়া দেয়া হবে৷ আমরা তাদের (সরকার) করা ওয়াদাই পালন করতে বলছি৷ বিএনপির নীতিনির্ধারক মাহবুবুর বলেন, আলোচনাই হলো একমাত্র গণতান্ত্রিক ভাষা৷ আমরা হিংসা-বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহের কথা বলছি না; আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলছি৷ সরকার যতই বলুক সংলাপে বা আলোচনায় বসবে না, কিন্তু সংলাপে তাদের বসতেই হবে৷ তারা বারবার ভুল করলে দেশ, জাতি ও গণতন্ত্রের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হবে- যার দায়ভার তাদেরই বহন করতে হবে৷

সংলাপের ব্যাপারে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের আহ্বানে সরকারের ইতিবাচক সাড়া দেওয়া উচিত বলেও মন্তব করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান৷ জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সমপ্রতি এক বিবৃতিতে সংস্থাটির মহাসচিব বান কি মুন বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সকল রাজনৈতিক দলকে সংলাপে বসার তাগিদ দেন৷

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামের অন্যতম সদস্য নূহ উল আলম লেনিন রোববার বলেন, কাদের সঙ্গে কী নিয়ে সংলাপ হবে? তারা (বিএনপি) কী চায়,সেটাই তো পরিষ্কার নয়৷তাছাড়া সংলাপের কোনো প্রয়োজনীয়তা বা পরিবেশ এখনও তৈরি হয়নি৷ এ সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে সংলাপ হবে কিনা৷ খালেদা জিয়ার আন্দোলনের হুমকি অন্তঃসারশূন্য মন্তব্য করে তিনি বলেন, খালেদা জিয়া বহুবার সংলাপের আহ্বান ও আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন, কিন্তু কিছুই করতে পারেননি৷ খালেদা জিয়ার এ হুমকি মাজাভাঙা বিএনপির লম্ফঝম্প ছাড়া অন্য কিছু নয়৷ এজন্য বিএনপি নেত্রীর এ হুমকিতে আমরা পাত্তা দিচ্ছি না বলে মন্তব্য করেন তিনি৷

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট৷ এর পর থেকেই খালেদা জিয়াসহ বিএনপির শীর্ষ নেতারা নির্দলীয় সরকার গঠন ও মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছেন৷

জানা গেছে, বিভিন্ন সভা-সমাবেশে সংলাপের দাবি জানানোর পাশাপাশি ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগে জোর তত্‍পরতা চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি অংশ৷ শনিবার এক সমাবেশে খালেদা জিয়া আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্দলীয় সরকার কাঠামোর ব্যাপারে সমঝোতায় আসতে আবার ক্ষমতাসীনদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন৷ প্রয়োজনে দাবি আদায়ে রাজপথে আন্দোলনের হুমকিও দিয়েছেন তিনি৷ কিন্তু আওয়ামী লীগের শীর্ষ মহল বিষয়টি আগের মতোই গুরুত্বহীন ভাবে দেখছেন৷

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, খালেদা জিয়ার আন্দোলন করার ক্ষমতা থাকলে করে দেখাক৷ বারবার ঘোষণা দেয়ার কী আছে৷ আগে দেখি উনি আন্দোলন করে এ সরকারের কী করতে পারেন; তারপর না হয় সিদ্ধান্ত নেয়া হবে৷ এখন কীসের সিদ্ধান্ত৷ এখন দেশের মানুষ ভালো আছে, শান্তিতে আছে৷ ব্যবসায়ীরা ভালোভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন৷ বিদেশিরা এদেশে বিনিয়োগের জন্য আসছে৷

তিনি এজন্যই এ পরিবেশের ব্যত্যয় ঘটানোর ষড়যন্ত্র করছেন৷ কিন্তু কোনো লাভ হবে না৷ এ পরিস্থিতির ব্যত্যয় ঘটানোর চেষ্টা করলে এবার জনগণই তাদের টওতিহত করবে৷ নাম টওকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বলেন, কীসের সংলাপ, কার সঙ্গে সংলাপ; কেন খালেদা জিয়ার কথায় সরকারকে সংলাপ করতে হবে? তিনি খালেদা জিয়ার প্রতি শেখ হাসিনার আহ্বানের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, সময়ের কাজ সময়ে না করলে তা পরে করে কোনো লাভ নেই৷ সেটা খালেদা জিয়া ও তার দলের নেতাদের বুঝতে হবে৷ এ নির্বাচনকে সংবিধান রক্ষার নির্বাচন বলেছিলেন এবং নির্বাচনের পর দ্রুত সময়ের মধ্যে সংলাপ করে আরেকটি নির্বাচন দেয়ার কথা জানিয়েছিলেন- বিএনপি নেতারা এমনটা দাবি করেন৷ জবাবে তিনি বলেন, বিএনপি নেতারা কি সরকারের এ বক্তব্য মেনে নিয়ে সেভাবে কাজ করেছেন, নাকি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নির্বাচন ঠেকানোর চেষ্টা করেছেন? ভোট কেন্দ্রে আগুন দিয়েছেন; মানুষ হত্যা করেছেন৷ সব করেও যখন নির্বাচন বানচাল করতে ব্যর্থ হয়েছেন, তখন তারা জনগণকে বিভ্রান্ত করতে এসব কথা বলা শুরু করেছেন৷ কিন্তু মানুষ এখন অনেক সচেতন৷ পুরনো ধাঁচের ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করে এখন আর সুবিধা আদায় করা যাবে না৷

৫ জানুয়ারির ভুলের কারণে খালেদা জিয়া ও বিএনপি জাতীয় রাজনীতি থেকে হারিয়ে যেতে বসেছেন৷ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার শক্তি না থাকায় বিএনপি নেতারা এখন মাঝে মধ্যে এসব কথা বলে নিজের দলের হতাশ নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করার চেষ্টা করছেন৷এসব কথা বলে লাভ নেই৷ কারণ সরকার নির্ধারিত সময়ের একদিন আগেও ক্ষমতা ছাড়বে না৷

অপর একটি সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ এখন উন্নয়নের পাশাপাশি সংগঠনকে ঢেলে সাজানোর দিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে৷ এসব সংলাপ বা আন্দোলন নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় আমাদের নেই৷ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব সব মনোযোগ এখন ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার পেছনে ব্যয় করছে৷ অন্যদিকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, কীসের সংলাপ? দেশে কোনো সঙ্কট তৈরি হয়েছে যে সংলাপে বসতে হবে? যথাসময়ে আগামী নির্বাচন হবে, তখন পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে সরকার যদি মনে করে বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলোচনা করা প্রয়োজন, তখন সেটা নিয়ে ভাবা যাবে৷ এখন কেন? বিএনপির নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থার দাবির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সংবিধানের মধ্যে থেকেই যা করার প্রয়োজন হবে, তা করা হবে৷ কিন্তু সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই৷

বিএনপির নীতিনির্ধারকরা জানান, সরকার রাজপথের আন্দোলন দমনে অতীতের মতো বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলাগুলোকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে৷ সরকার বিএনপির শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পূর্বের অবস্থা সৃষ্টি করতে চাইছে৷ কিন্তু সরকারকে এবার আর এমন সুযোগ দেয়া হবে না৷ কয়েক স্তরে দলীয় নেতাদের দায়িত্ব আগেই ভাগ করে দেয়া হবে৷ শীর্ষ নেতারা কারাগারে থাকলেও যাতে আন্দোলনের ওপর এর কোনো প্রভাব না পড়ে সেজন্যই আগাম সতর্কতামূলক এ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে মানবকন্ঠকে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগরের নবগঠিত কমিটির গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা৷ বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী এক নেতা জানান, অতীতের আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার আর আগাম ঘোষণা দিয়ে রাজধানীতে ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’র মতো কোনো ধরনের কর্মসূচি দেয়া হবে না৷ ক্ষেত্র প্রস্তুত হলে যে কোনো দিন রাজপথে নেমে আসার প্রস্তুতি নেয়া হবে৷

বিএনপির প্রভাবশালী কয়েক নেতার সঙ্গে ঈদ-পরবর্তী আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে জানতে চাইলে তারা বলেন, অক্টোবরের মাঝমাঝি সময় থেকেই একটি গ্রহণযোগ্য সরকারের অধীনে নতুন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একদফা দাবিতে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে৷ প্রাথমিক পর্যায়ে হরতাল অথবা অবরোধ দিয়েই নতুন কর্মসূচি শুরু করার পরিকল্পনা তাদের রয়েছে৷ এরপর ধাপে ধাপে পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে অন্যান্য কর্মসূচি দেয়া হবে৷ স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী এক নেতা জানান, অক্টোবরে মাঝামাঝি প্রথম পর্যায়ের কর্মসূচি ঘোষণা করা হলেও নভেম্বর থেকে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেবেন খালেদা জিয়া৷ ঢাকা মহানগর বিএনপির এক যুগ্ম আহ্বায়ক জানান, অতীতে কঠোর কর্মসূচি চূড়ান্ত করার আগেই তার তথ্য প্রকাশ পাওয়ায় কর্মসূচি বাস্তবায়নে তাদের বেগ পেতে হয়েছে৷ তাই এবার কর্মসূচির ব্যাপারে বিএনপি হাইকমান্ড থেকে কঠোর গোপনীয়তা বজায় রাখার নির্দেশনা রয়েছে৷ ঢাকা মহানগর বিএনপির বর্তমান কমিটির নেতারাও তাই আগামী আন্দোলন ও কর্মসূচি সম্পর্কে খুব একটা মুখ খুলতে চাইছেন না৷

ঈদ-পরবর্তী আন্দোলন কর্মসূচি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য তরিকুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ গভীর সংকটের মধ্যে রয়েছে৷ এটা শুধু কোনো দলের ক্ষমতায় যাওয়ার সংকট নয়৷ দেশে মানুষ পুনরায় গণতন্ত্র, ভোটের অধিকার, বাক স্বাধীনতা ফিরে পাবে কি-না তা নির্ভর করছে সামনের দিনের আন্দোলনের ওপর৷ বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে সেই সংগ্রাম করে যাচ্ছে৷ অতীতের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ঈদের পর নতুন আন্দোলনের কর্মসূচি দেয়া হবে৷ তিনি বলেন, ঘোষণা দিয়ে গণঅভ্যুত্থান হয় না৷ জনগণ জানে কখন কিভাবে স্বৈরাচারী একটি সরকারের পতন ঘটাতে হয়৷

ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, সরকার যদি ভেবে থাকে অতীতের মতো বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কারাগারে পুড়ে আন্দোলন দমন করবে তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বসবাস করছে৷ এবার সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েই আমরা রাজপথে নামব৷ আমাদের নেত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে৷ তিনি বলেন, আমরা আন্দোলনকে সামনে রেখে সাংগঠনিক প্রস্তুতি নিচ্ছি৷

এদিকে ঈদের পর সরকারবিরোধী আন্দোলনকে সামনে রেখে দল পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে দুই-একদিনের মধ্য জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হবে৷ইতিমধ্যে সম্ভাব্য পদপ্রত্যাশীদের বায়োডাটা পর্যালোচনা ও প্রার্থীদের সাক্ষাত্‍ নিয়ে ছাত্রদলের নতুন কমিটির একটি খসড়া তালিকা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার কাছে জমা দেয়া হয়েছে৷ ছাত্রদলের নতুন কমিটির বিষয়ে লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মতামত নিতে বিএনপির এক যুগ্ম মহাসচিব সমপ্রতি লন্ডন সফর করে এসেছেন৷ ছাত্রদলের কমিটি গঠনে দায়িত্বপ্রাপ্ত এক নেতা জানান, বিএনপি চেয়ারপার্সন আগামীদিনের আন্দোলন সংগ্রামকে প্রধান বিবেচনায় নিয়েই ছাত্রদলের নতুন কমিটির বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন৷ বিএনপির এক যুগ্ম মহাসচিব জানান, ছাত্রদলের ধারাবাহিকতায় চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়ার আগেই যুবদলসহ অন্যান্য অঙ্গসংগঠনগুলোকেও ঢেলে সাজানো হবে৷ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া সরকারবিরোধী আন্দোলনে ঢাকা মহানগরীকে যুত্‍সইভাবে প্রস্তুত করতে ইতিমধ্যে মহানগর কমিটিকে সার্বিক প্রস্ততি নেয়ার নির্দেশও দেয়া হয়েছে৷ এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে ওয়ার্ড ও থানা পর্যায়ে কমিটি গঠনসহ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে আন্দোলনে সর্বাত্মক ভূমিকা পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন ঢাকা মহানগরের নবগঠিত কমিটির নেতারা৷ গত মঙ্গলবার নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নবগঠিত কমিটির শীর্ষ নেতারা এক জরুরি বৈঠক করেছেন৷

মহানগরের আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসের সভাপতিত্বে ওই বৈঠকে সদস্য সচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল আউয়াল মিন্টু, কাজী আবুল বাশার,এমএ কাইয়ুম, সালাউদ্দিন আহমেদ, আবু সাঈদ খান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, যুগ্ম মহসচিব আমান উল্লাহ আমান, বরকত উল্লাহ বুলু, আবুল খায়ের ভূঁইয়া, যুবদল সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, এসএ খালেকসহ অন্য নেতারা অংশ নেন৷

প্রায় দুই ঘন্টার বৈঠকে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলার বিচার কার্য শুরুসহ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে তারা আলোচনা করেন বলে জানা গেছে৷ অন্যদিকে আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুতে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া নিজেই আবারো গণসংযোগে নামছেন৷ আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জনসভা করবেন৷ এরপর ২৫ সেপ্টেম্বর জামালপুরে আরেকটি জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে ভাষণ দেবেন৷ এ ছাড়া সমপ্রচার নীতিমালা, বিচারপতিদের অভিশংসন আইনের জন্য সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বিরুদ্ধে দল নির্বিশেষে সব পেশাজীবীকে মাঠে নামানোর চেষ্টাও অব্যাহত রাখছে বিএনপি৷

বিএনপি হাইকমান্ড মনে করছে, আন্দোলনের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি না করতে পারলে নতুন একটি জাতীয় নির্বাচন করার বিষয়ে ক্ষমতাসীনরা আলোচনায় রাজি হবে না৷ তাই সংলাপের আশাও একেবারে ছাড়ছে না বিএনপি৷ আন্দোলনের পাশাপাশি সংলাপের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে কূটনৈতিক উদ্যোগও অব্যাহত রাখার পক্ষে বিএনপির অধিকাংশ নেতা৷ কূটনৈতিক তত্‍পরতা বাড়ানোর অংশ হিসেবে আগামী ১৭ সেপ্টেম্বর চীনা কমিউনিস্ট পাটির্র আমন্ত্রণে বেইজিং সফরে গেছেন বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল৷ স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন৷ এ ছাড়া বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা সমপ্রতি নতুন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে ও ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন৷ চেয়ারপার্সনের পররাষ্ট্র বিষয়ক এক উপদেষ্টা জানান, এ ধরনের কূটনৈতিক তত্‍পরতা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে৷

সংবিধান অনুযায়ী একাদশ সংসদ নির্বাচন ২০১৯ সালে৷ সরকার দলের নেতারাও প্রতিপক্ষকে এই সময় পর্যন্ত অপেক্ষার প্রহর গুণতে বলেছেন৷ এই সময়ের মধ্যে কোন সংলাপও হবে না৷ কিন্তু ক্ষমতার বাইরে থাকা ২০ দলীয় জোটের প্রধান বিএনপি আগামী বছর অর্থাত্‍ ২০১৫ সালেই নির্বাচন দেখছেন৷ দলটির অর্ধডজন নেতা সভা-সমাবেশে এ নিয়ে স্পষ্ট করেছেন৷ তবে এটি হবে বিদেশীদের দেখানোর কৌশলী নির্বাচন৷ বিএনপি নেতারা আশঙ্কা করছেন, ওই নির্বাচনে তাদের দলের চেয়ারপারসন, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ দুই শতাধিক নেতাকে অযোগ্য করা হতে পারে৷ অবশ্য দলটির হাজার নেতাকে সপ্তাহের পাঁচদিনই আদালত পাড়ায় অবস্থান করতে হয়৷ হাজিরা দিতে হয়৷ কারো বিরুদ্ধে চার্জ গঠন, সাক্ষ্যগ্রহণ এবং কারো রায়ের পালা চলছে৷

আন্দোলন, সংঘাত-সংঘর্ষ এবং হতাহতের মধ্য দিয়ে গত ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ ১৫৪ জনের কোন ভোটের প্রয়োজন হয়নি৷ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিএনপি ও তার মিত্ররা৷ দাতাগোষ্ঠীর কিছু দেশ তাতে অসন্তোষ প্রকাশ না করলেও সন্তুষ্টদের সংখ্যাই বেশি৷ এ পরিস্থিতিতে স্বল্প সময়ের মধ্যে আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এমনটি আশ্বাসও দিয়েছিলো সরকার তরফ থেকে৷ তবে একটি সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী তা নাকচ করে দিয়েছেন৷

সরকার দলীয় নেতারা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আন্দোলনরত বিএনপির উদ্দেশ্যে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই আগামী নির্বাচন হবে, তা হবে ২০১৯ সালে৷ সে নির্বাচনেও জনগণ আওয়ামী লীগকেই ভোট দিবে৷ ভিশন বাস্তবায়ন করতে ২০৪১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগই দেশ পরিচালনা করবে৷কিন্তু সরকারবিরোধী মঞ্চ বিশেষ করে বিএনপির নেতারা বলেছেন, নির্বাচন আগামী বছরের প্রথমদিকেই৷ তবে সেটা হবে বিএনপিকে দুর্বল করে৷ এ ষডযন্ত্র থেকেই দলটির অনেক নেতার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে৷ নেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, মামলায় সাজা দেয়ার মাধ্যমে দলের সিনিয়র নেতাদের নির্বাচনে অযোগ্য করা হতে পারে৷

দলীয় সূত্র জানিয়েছে, বিএনপির ৩৮৬ সদস্যের নির্বাহী কমিটির যারা মারা গেছেন তারা বাদে সবাই কোন না কোন মামলার আসামি৷ এর মধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের স্থায়ী কমিটি, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরাও রয়েছেন৷ এছাড়াও দলের ১১ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারাও রয়েছেন৷দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, বিদেশি প্রভুদের খুশি করতে আওয়ামী লীগ অতিদ্রুত একটি নির্বাচনের পথে এগুচ্ছে৷ আর তা বাস্তবায়ন করতে বিএনপির সম্ভাব্য বিজয়ী প্রার্থীদের তালিকা তৈরি করে মামলা দিয়ে গ্রেফতারের মাধ্যমে জেলে ঢোকানোর ব্যবস্থা করছে৷ তিনি বলেন, ওয়ান-ইলেভেনের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে৷ শুধু কৌশলের পরিবর্তন হয়েছে৷ তাই বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করতে বিচারের নামে প্রহসন করছে সরকার৷

স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আসম হান্নান বলেছেন, চলতি বছরের মধ্যেই সরকার নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে৷ আগামী ২০৪১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন সফল হবে না৷

গত৫সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় সাবেক মন্ত্রী বরকতউল্লাহ বুলু দলের নেতাকর্মীদের প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন৷ বলেছেন, আগামী জানুয়ারিতেই নতুন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে৷ আপনারা এর জন্য প্রস্তুতি নিন৷জিয়া পরিষদের এক সভায় দলের আরেক যুগ্ম-মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনও বলেছেন, সরকার আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে দেশে আরেকটি নীল নকশার নির্বাচনের পাঁয়তারা করছে৷ সেই নির্বাচনে যাতে বিচার বিভাগ কোনো হস্তক্ষেপ করতে না পারে, সেজন্য পুরো বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণে নিতে অভিশংসন আইন করা হচ্ছে৷