more-profit-01-300x158দৈনিকবার্তা-ঢাকা, সেপ্টেম্বর ০৯: বাজারের প্রায় সব ধরনের ফলেই বিষাক্ত রাসায়নিক মেশানো হয়৷ ফলমূল বেশি দিন টিকিয়ে রাখতেই জীবননাশক এই সিদ্ধানত্ম নেন ব্যবসায়ীরা৷ আর এ জন্য মূলত দায়ী পাইকারী ব্যবসায়ীরা৷ তবে খুচরা ব্যবসায়ীরাও এর বাইরে নয়৷ এ জন্য তারা সমানভাবে দায়ী না হলেও এই অনৈতিক, অবৈধ ও অপরাধ কর্মকা-ে তাদেরও অংশগ্রহণ রয়েছে৷

অনেক খুচরা ব্যবসায়ী হয়তো খাদ্যসামগ্রীতে ফরমালিন ও কারবাইড ক্যালসিয়ামের মতো বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করেন না৷ কিন্তু তারা সবাই জানেন কোন পণ্যটি রাসায়নিকযুক্ত এবং কোনটিতে রাসায়নিক নেই৷

বিশেষজ্ঞ এবং নিরাপদ খাদ্য আন্দোলনকারীরা এসবের জন্য পাইকারী ব্যবসায়ীদের ‘অতি মুনাফার লোভ’কেই দায়ী করেছেন৷ আর তারাও বিষয়টি স্বীকার করেছেন৷ সেই সঙ্গে অপর্যাপ্ত সংরৰণাগার (স্টোরেজ) এবং সংরৰণ (প্রিজারভেশন) সুবিধাদির অপ্রতুলতাও এর পেছনে আরেকটি কারণ বলে দাবি করেছেন পাইকারী ব্যবসায়ীরা৷ তারা জানান, ফল রাখার পর্যাপ্ত জায়গা নেই এবং সেগুলো সংরৰণ করারও তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই৷ যে কারণে ফলমূল সংরৰণে এবং লোকসনা ঠেকাতে স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ৰতিকর এবং অনৈতিক কাজটিই করতে হচ্ছে তাদেরকে৷

চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীর ব্যবসায়ীরা আমে বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করেন৷ গাছ থেকে আম আহরণের পর দ্রম্নত তা বাজারে নিতে এবং বেশিদিন টিকিয়ে রাখতেই তারা এই অনৈতিক ও অবৈধ কাজটি করে থাকেন৷

more-profit-02-300x200চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটের ৰুদ্র ব্যবসায়ী মোহাম্মদ লতিফ বলেন, কানসাট ও জেলার রোহানপুর বাজারের ৮০ ভাগ ব্যবসায়ীই আমে ফরমালিন ব্যবহার করেন৷

তারা অমৌসুমে (অফ-সেজন) ফরমালিন ব্যবহার করেন স্বীকার করে লতিফ বলেন, আম উত্‍পাদনের ৰেত্রে চাষীরাও বিভিন্ন ধাপে কীটনাশক, ছত্রাকনাশক ও ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করেন৷

কানসাট হচ্ছে দেশের বৃহত্তম আমের বাজাগুলোর একটি৷ সেখানে প্রায় ২০০ আম ব্যবসায়ী রয়েছেন৷

আমের জন্য আরেকটি বৃহত্তম বাজার হলো রাজশাহীর বানেশ্বর৷ সম্প্রতি ফরমালিন বিরোধী অভিযান চলাকালে সেখানে অনেক ব্যবসায়ীকে আমে বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করতে দেখা গেছে৷

আমের মতোই আরেকটি মৌসুমি ফল হচ্ছে লিচু৷ যা মাত্র কয়েক সপ্তাহ বাজারে পাওয়া যায়৷ এই লিচু ব্যবসায়ীরাও আম ব্যবসায়ীদের মতো একই কাজটি করে থাকেন৷ তারাও লিচুতে বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করেন৷

সুস্বাদু লিচুর জন্য দিনাজপুর বিখ্যাত৷ সেখানকার বেশির ভাগ লিচু বাগানের মালিক গাছ থেকে লিচু সংগ্রহের মাত্র কয়েক দিন আগে তাতে বিষাক্ত রাসায়নিক স্প্রে করেন৷ যাতে করে লিচু বাজারে বেশি দিন রাখলেও নষ্ট না হয়৷

অথচ বিশেষজ্ঞদের মত হলো, গাছ থেকে ফলমূল আহরণের কমপৰে দুই সপ্তাহ আগে তাতে স্প্রে করা বন্ধ উচিত৷

more-profit-04-300x139

২০১২ সালে ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুরে ১৪ জন শিশুর মৃতু্য হয়৷ তারা সবাই প্রায় একই ধরনের লৰণ নিয়ে মারা যায়৷ বিষয়টি অনুসন্ধানের পর বিশেষজ্ঞরা জানান, লিচুতে কীটনাশক ব্যবহারের কারণে এই শিশুদের মৃতু্য হয়ে থাকতে পারে৷

দিনাজপুরের একজন লিচু ব্যবসায়ী আজিবর রহমান৷ তিনি দাবি করেন, ব্যবসায়ীরা সেখান থেকে লিচু নিয়ে জেলার বাইরে গিয়ে তাতে ফরমালিন ব্যবহার করেন৷

তবে আজিবর স্বীকার করেন, এবার কিছু সংখ্যক কৃষক বাগানে লিচুতে রাসায়নিক ব্যবহার করেছেন৷ কারণ, উত্তরাঞ্চলে পরিবহন ধর্মঘটের কারণে গাছ থেকে লিচু সংগ্রহে বিলম্ব হচ্ছিলো৷

তিনি বলেন, রাজধানী ঢাকার শ্যামলী, কাকরাইল ও চট্টগ্রাম, বরিশাল, গাজীপুর এবং টাঙ্গাইলের ব্যবাসয়ীরাই দিনাজপুরের লিচুর প্রধান ব্যবসায়ী৷

শাকসবজিও নিরাপদ নয়: কয়েক বছর আগে বিশেষজ্ঞরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার কাঁচাবাজারের টমেটোতেও ফরমালিনের অসত্মিত্ব পেয়েছেন৷

পঞ্চগড়ের অনেক চাষী টমেটোতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড নামে একটি বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করেন৷ যাতে করে তা লাল ও তাজা দেখায়৷

পঞ্চগড়ের পাইকারী টমেটো ব্যবসায়ী আতাহার আলী৷ তিনি বলেন, যেহেতু গ্রীষ্মকালে টমেটো এমনিতেই পেকে যায়৷ তাই তারা শুধুমাত্র শীতকালে টমেটো পাকানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করেন৷

পঞ্চগড়ে ৮ থেকে ১০ জন টমেটোর পাইকারী ব্যবসায়ী আছেন উলেস্নখ কওে তিন বলেন, যেহেতু শাকসবজি পঁচনশীল এবং জেলায় (ঠাকুরগাঁও) কোনো হিমাগার বা কোল্ডসোরেজ নেই৷ তাই লোকসান এড়াতে পাইকারী ব্যবসায়ীরা শাকসবজিতে ফরমালিন ব্যবহার করেন৷

more-profit-05-300x190পোল্ট্রিতেও বিষ: পোল্ট্রি বা মুরগির মাংসেও বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়৷ বিশেষজ্ঞরা মুরগির মাংস, হাড় ও যকৃতে মাত্রাতিরিক্ত ক্রোমিয়াম পেয়েছেন৷ ক্রোমিয়াম মানুষকে ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধির দিকে ঠেলে দেয়৷

গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব পোল্ট্রি ফার্মে ট্যানারির আবর্জনা থেকে তৈরি খাবার দেওয়া হয়, সেসব ফার্মের মুরগির মাংসে মাত্রাতিরিক্ত ক্রোমিয়াম রয়েছে৷

সম্প্রতি রাজধানীর হাজারীবাগ ট্যানারি শিল্প এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ক্রোমিয়ামযুক্ত পোল্ট্রি খাবার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে চারটি চক্র রয়েছে৷ কিছু ট্যানারি মালিক, অননুমোদিত কয়েকটি হাড়-মাংস উত্‍পাদনকারী কারখানা, অননুমোদিত কয়েকটি পোল্ট্রি খাবার তৈরি প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ী এই চক্রের সঙ্গে জড়িত৷

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সেখানে ৮০টিরও বেশি অননুমোদিত হাড়-মাংস ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে৷

হাড়-মাংস উত্‍পাদনকারী একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক জানান, পোল্ট্রি খাবার তৈরির জন্য চট্টগ্রাম, গাজীপুর ও ঢাকার সাভারের ব্যবসায়ীরা সেখান থেকে হাড়-মাংস কেনেন৷

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, তিনি ট্যানারি থেকে চামরার বর্জ্য কেনেন৷

বিগত কয়েক বছর ধরে ভেজাল বিরোধী খাদ্য অভিযানে নিয়োজিত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার পাশা বলেন, পাইকারী ব্যবসায়ীরা ফলমূলে বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করেন৷ এছাড়া অনেক চাষীও শাকসবজিতে ৰতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করে থাকেন৷

তিনি বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন ফলের দোকানে ফরমালিনযুক্ত আপেল পাওয়া গেছে৷ কিছু কিছু ৰেত্রে দোকানদাররাও এর সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন৷

জাতীয় স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন কমিটির চেয়ারম্যান রাশিদ-ই-মাহবুব বলেন, ফলমূল ও শাকসবজিতে ভেজালের জন্য মূলত পাইকারী ব্যবসায়ীরা দায়ী৷

তিনি বলেন, পঁচনশীল ফলমূল ও শাকসবজি সংরৰণে খুব সীমিত সংখ্যক হিমাগার (কোল্ডস্টোরেজ) রয়েছে৷ এ কারণে পাইকারী ব্যবসায়ীরা ফরমালিন ব্যবহারের মতো অবৈধ ও অনৈতিক কাজটি করে থাকেন৷