asraf-300x188দৈনিকবার্তা-ঢাকা, সেপ্টেম্বর ০৯: জাতীয় পার্টিতে এখন বিরাজ করছে গুমট অবস্থা। আলোচনার এক পর্যায়ে এরশাদ দলের মন্ত্রীদের পদত্যাগের নির্দেশ দেন। বিষয়টি স্পিকার ও প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত গড়িয়েছে। এ নিয়ে নতুন করে দলের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। এ পরিস্থিতির প্রথম বলি হতে যাচ্ছেন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী। পদ হারানোর পাশাপাশি দল থেকেও বহিষ্কৃত হওয়ার আশঙ্কায় আছেন তিনি। সংসদে বিরোধী দল হয়েও সরকারের ক্ষমতার অংশীদার জাতীয় পার্টিতে অভ্যন্তরীণ বিরোধ এবার চরমে পৌঁছেছে। সর্বশেষ সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা নির্বাচন নিয়ে দলটি এরশাদ ও রওশন এই দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।
এদিকে উপনেতা নির্বাচন নিয়ে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন আর দলের চেয়ারম্যান এরশাদ এই দুই পক্ষে চলছে টানাপোড়েন। বিষয়টি নিয়ে স্পিকারের কাছে দু’পক্ষ থেকে পাল্টাপাটি চিঠিও দেয়া হয়েছে। বিরোধীদলীয় নেতা রওশন চাইছেন কাজী ফিরোজ রশীদকে উপনেতা করতে। কিন্তু ফিরোজ আগে থেকেই এরশাদের বিরাগভাজন। এ কারণে দলের মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে এ পদটি দিতে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এরশাদ। মঙ্গলবার রাতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। জানা গেছে, ওই সাক্ষাতের হেতু ছিল এই ইস্যুটিই।

জাপা সূত্রে জানা যায়, সরকারের যোগ দেয়ার পর থেকেই এরশাদ ও রওশন দ্বন্দ্ব অনেকটা প্রকাশ্য রূপ পেলেও গত সোমবার দলের চেয়ারম্যাকে বাদ দিয়ে রওশনের নেতৃত্বে সংসদীয় কমিটির বৈঠক করার কারণেই বিভক্তি চূড়ান্ত রূপ ধারণ করেছে। এ বৈঠকেই বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসেবে কাজী ফিরোজ রশীদের নাম চূড়ান্ত হয়। বৈঠকের পরদিন মঙ্গলবার এই নাম প্রস্তাব করে স্পিকারের কাছে চিঠি দেন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম।

কিন্তু এর বিপরীতে এরশাদের পক্ষে পাল্টা চিঠি দিয়েছেন মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলু। চিঠিতে বলা হয়েছে, কাজী ফিরোজ রশীদকে উপনেতা বানানোর সিদ্ধান্ত দলের নয়।

উপনেতা নির্বাচন নিয়ে বিরোধীদলের চিঠি দেয়া প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু বলেন, ‘দলের সংসদীয় কমিটির কোনো বৈঠক হয়েছে বলে আমার জানা নেই। যেখানে দলের চেয়ারম্যান বৈঠকের বিষয়ে কিছু জানেন না, মহাসচিব হিসেবে আমি কিছু জানি না, দলের সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলামও কিছু জানেন না, তাহলে কীসের বৈঠক? কারা বৈঠক করেছে; কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।’

তিনি বলেন, ‘দলের পক্ষ থেকে সংসদীয় দলের সর্বশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ৩১ আগস্ট। এরপর আর কোনো বৈঠক আহ্বান করা হয়নি। দলের চেয়ারম্যান হিসেবে স্যার (এরশাদ) বৈঠক ডাকতে পারেন। আমরা এখন উপনেতা নির্বাচন নিয়ে ভাবছি না।’

জিয়াউদ্দিনের এই বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া গেছে বৈঠকের দিনই জাপার ঘনিষ্ঠ সূত্রে। সূত্র জানায়, আকস্মিকভাবেই ফোন করে এমপিদের ডেকে বৈঠক করা হয়। উপনেতা মনোনয়নের জন্যই মূলত তড়িঘড়ি করে পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে না জানিয়ে বৈঠকটি ডাকা হয়েছিল।

ওই বৈঠকে এরশাদের বিরুদ্ধে চরম আক্রমণাত্মক কথাও বলেন অনেক এমপি। অথচ রওশন সেসব কথা চুপচাপ শুনে গেছেন। উপরন্তু তাদেরকেই তার একমাত্র অবলম্বন বলে অভিহিত করেছেন।

বহিষ্কার হতে পারেন তাজুল
এরশাদকে অমান্য করার কারণে এবার দল থেকে বহিষ্কার হতে পারেন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী। দলের চেয়ারম্যানকে উপেক্ষা করে একের পর এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, প্রকাশ্যে তার বিরোধিতা করা, আনুষ্ঠানিক কোনও সভা না হলেও তা সংসদীয় দলের সভা বলে চালিয়ে দেয়া, তদবির বাণিজ্য, বিভেদ সৃষ্টিসহ একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে তাকে এ পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। এর আগে একই অভিযোগে দপ্তর সম্পাদকের পদটিও হারিয়েছিলেন তিনি।

জাপার একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

দশম সংসদে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ পদে নিয়োগের সময়েও তার বিরোধিতা করেন জাতীয় পার্টির বেশিরভাগ এমপিসহ শীর্ষ নেতারা। মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা, যুদ্ধাপরাধীদের তালিকায় নাম থাকা, বার বার দল বদলানো, দুর্নীতির অভিযোগসহ নানা কারণে তখন তারা তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে এ পদে নিয়োগের বিরোধিতা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি পদটি পেয়েছেন।

জানা গেছে, গত ৩১ আগস্ট জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের সভায় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ সবার উপস্থিতিতে তাজুল ইসলাম চৌধুরীর বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, ‘তুমি দলের ভেতরে থেকে ষড়যন্ত্র করছো’। তিনি তাকে সংযত আচরণের পরামর্শ দেন। পার্টির অধিকাংশ এমপি এসময় এরশাদের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন এবং তাজুল ইসলাম চৌধুরীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান। পরিস্থিতি অনুকূলে নয় বুঝতে পেরে বৈঠকে তাজুল ইসলাম এরশাদের কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চান।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ বাবলু বলেন, ‘৩১ আগস্টের পর জাতীয় পার্টির আর কোনও সংসদীয় দলের সভা অনুষ্ঠিত হয়নি। সোমবার সংসদীয় দলের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে যে খবর প্রচার করা হয়েছে তা ভিত্তিহীন।’ তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘পার্টি চেয়ারম্যান, মহাসচিব, মন্ত্রী ও এমপিদের না জানিয়ে সংসদীয় দলের সভা হয় কীভাবে? বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন। তিনি কেন এটা করেছেন তা জানতে চাওয়া হবে।’

উপনেতা নির্বাচনের দায়িত্ব বিরোধীদলের: স্পিকার
বিরোধীদলীয় উপনেতা নির্বাচন নিয়ে ‘জটিলতা’ রয়েছে বলে স্বীকার করেছেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তবে তিনি বলেছেন, ‘বিরোধীদলীয় উপনেতা নির্বাচনের দায়িত্ব বিরোধীদলকেই নিতে হবে। এখানে স্পিকারের কিছু করার নেই। কার্যপ্রণালী বিধি বিরোধীদলীয় উপনেতা নির্বাচনের এখতিয়ার স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই। একস্থানে বলা আছে, দলটির সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ওপর ভিত্তিতে, অন্যত্র দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে হবে।’

পদত্যাগ করতে নারাজ জাপার মন্ত্রীরা
দলের চেয়ারম্যান এরশাদ নির্দেশ দিলেও এই মুহূর্তে পদত্যাগ করতে নারাজ জাপার তিন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী। উল্টো এরশাদকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর পরামর্শ দেন তারা। এরশাদও বিষয়টি নিয়ে দ্বন্দ্বে ভুগছেন বলে দলের একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে।

জানা গেছে, সংসদ সদস্যদের বেশিরভাগই রওশনপন্থি। রওশন এরশাদও মন্ত্রীদের পদত্যাগে ব্যাপারে একমত নন।

জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, ‘আমরা কেন পদত্যাগ করবো। দলের চেয়ারম্যানও মন্ত্রী পদমর্যাদায় আছেন। আগে তিনি পদত্যাগ করুন। তারপর আমাদের বিষয়টি আলোচনায় আসবে। তাছাড়া আমরা রওশন এরশাদের নেতৃত্বে নির্বাচন করেছি। এখন তিনি আমাদের নেতা। তার পক্ষ থেকে পদত্যাগ করার কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।’

প্রসঙ্গত, প্রথমবারের মতো সংসদে বিরোধীদলের আসন দখল করে জাতীয় পার্টি। দলের চেয়ারম্যানকে বাদ দিয়ে তার স্ত্রী ও সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য রওশনকে বিরোধীদলীয় নেতা বানানো হয়। সর্বশেষ ৩১ আগস্ট জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের কার্যালয়ে জাপায় সংসদীয় দলের বৈঠক আহবান করা হয়। বৈঠকে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল গঠনে একমত পোষণ করেন এরশাদ ও রওশদ দু’জনেই। তাদের দু’জনের পক্ষ থেকে বলা হয়, কার্যকর বিরোধী দল হলে জাতীয় পার্টির জনসমর্থন বাড়বে। বাড়বে ভোট। আগামীতে এককভাবে নির্বাচন করলে জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় আসতে পারবে।