সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার৷

দৈনিকবার্তা-ঢাকা : সমপ্রতি পাস হওয়া সমপ্রচার নীতিমালা কন্ঠরোধ করবে বলে মনে করেন দেশের গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও বিশিষ্টজনেরা৷এ জন্য তাঁরা এ নীতিমালাকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, গণমাধ্যম-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই নীতিমালা বা আচরণবিধি প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে পারেন৷ সমপ্রচার নীতিমালার পদে পদে গণমাধ্যমের কন্ঠরোধের বিষয়টিই উঠে এসেছে৷এছাড়া অনলাইন মিডিয়ার উপরও নীতিমালার নামে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা স্বাধীন গণমাধ্যমের পরিপন্থি৷ শনিবার বিকেল পৌনে চারটার দিকে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত ‘গণমাধ্যমের সামনে চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন৷সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও সমকাল-এর সম্পাদক গোলাম সারওয়ার বলেন, এ ধরনের কোনো আচরণবিধি করা যায় কি না, সম্পাদক পরিষদের আগামী সভায় এ বিষয়ে আলোচনা হবে৷

আলোচনা সভায় প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমরা বিপদের মধ্যে আছি৷ এর মধ্যে এ সমপ্রচার নীতিমালা আরেকটি নতুন বিপদ৷এটাকে আপদও বলা যায়৷ আশা করব, সম্পাদক পরিষদ এ চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করবে৷ তিনি বলেন, গণমাধ্যমের ওপর যে আক্রমণ হচ্ছে, এটার একটা বড় কারণ হলো সাংবাদিকদের মধ্যে ঐক্য নেই৷ এই বিভাজন দুঃখজনক৷ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আরও বলেন, এ সমপ্রচার নীতিমালা অপ্রত্যাশিত৷ এটা কন্ঠরোধ করবে৷ এমনিতেই গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত৷ মালিক নিয়ন্ত্রণ করেন, যাঁরা বিজ্ঞাপন দেন তাঁরা নিয়ন্ত্রণ করেন, আবার সরকার আইন-কানুন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে৷ এই নীতিমালা অত্যন্ত ভয়ংকর, এটা প্রত্যাখ্যান করা দরকার৷সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, দেশে সামাজিক, রাজনৈতিক, পরিবেশগত বিপদের পাশাপাশি নতুন বিপদ সমপ্রচারনীতিমালা৷

তিনি বলেন, সমপ্রচার নীতিমালার মাধ্যমে যেভাবে গণমাধ্যমের কন্ঠরোধ করার চেষ্টা চলছে তা অত্যন্ত বিপদজনক৷ এমনিতেই গণমাধ্যমে ভীষণভাবে নিয়ন্ত্রিত৷ সরকারের আইন, বিজ্ঞাপনদাতা, মালিকপক্ষ সব দিক দিয়েই গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত৷ নতুন এই নীতিমালা হচ্ছে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ৷ এতে সৃজনশীল চিন্তা শক্তির উপর আক্রমণ হবে৷ সভায় বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম বলেন, যারা এ নীতিমালা করেছে তারা আসলে সরকারের বন্ধু বা শুভাকাঙ্ক্ষী কিনা, সরকারকে এখনই তা দেখতে হবে৷তিনি বলেন, সরকার মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলছে৷ কিন্তু সমপ্রচার নীতিমালা গণমাধ্যমকে কঠোর জবাবদিহিতার মধ্যে এনেছে যা সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে খর্ব করবে৷

অ্যাসোসিয়েশন অব টিভি চ্যানেল ওনার্সের সাধারণ সম্পাদক ও চ্যানেল আইয়ের পরিচালক শাইখ সিরাজ বলেন, আমরা একটি নীতিমালা চেয়েছিলাম৷ এ চাওয়ার পেছনে কয়েকটি যুক্তিও ছিল৷ যেমন চাইলেই যেন যে কেউ টিভির লাইসেন্স না পায়৷ যোগ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যেন যোগ্যতার ভিত্তিতেই লাইসেন্স পায়৷তিনি বলেন, বর্তমানে যে নীতিমালা করা হযেছে এরকম নীতিমালা আমরা চাইনি৷ ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জন্য সহায়ক নীতিমালা দরকার৷শাইখ সিরাজ বলেন, এ নীতিমালায় হাত পা বেঁধে আমাদের সাঁতার কাটতে বলা হয়েছে৷

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, সাংবাদিকদের চারটি বিষযে সুরক্ষার জন্য নীতিমালা চেযেছিলাম৷ সাংবাদিকতা পেশায় নতুনদের চাকরির নিরাপত্তা, টেলিভিশন চ্যানেগুলোর বেতন বৈষম্য দূর করা, বিনিয়োকারীদের নিরাপত্তা এবং লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি সুরক্ষা চেয়েছিলাম৷ কিন্তু বিদ্যমান নীতিমালায় তার উপস্থিতি নেই৷ তবে অনেকেই না বুঝে নীতিমালা নিয়ে সমালোচনা করছেন৷ এর ইতিবাচক দিকও আছে৷তিনি বলেন, একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, দেশে উজ্জল সাংবাদিকতা যেমন অগ্রসর হচ্ছে, তেমনি অপসাংবাদিকতাও কম নেই৷ এই অপসাংবাদিকতা দূর করতেই নীতিমালা প্রয়োজন৷ বুলবুল বলেন,আমরা চেয়েছিলাম একটি স্বাধীন সমপ্রচার কমিশন৷যে কমিশনের প্রধান হবেন গণমাধ্যমের কেউ৷কোনোভাবেই সামরিক বাহিনীর বা আমলাদের কাউকে এই কমিশনে মেনে নেওয়া হবে না৷

সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, ব্রডকাটিং নীতিমালার একটি গেজেট আমরা হাতে পেয়েছি৷ এ নীতিমালা টেলিভিশনকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে দেওয়া হয়েছে৷ এর ধারাগুলো দেখে আমরা যে ধরনের মনোভাব পাই তা স্বাধীন গণমাধ্যমের পরিপন্থি৷তিনি বলেন, একই সঙ্গে অনলাইন মিডিয়াকেও এখন নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চলছে৷ অথচ এটি এখন একটি দ্রুত বিকাশমান মিডিয়া৷ মাহফুজ আনাম বলেন, নীতিমালার ৫:১:৪ ধারায় বলা হয়েছে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘি্নত হয় এমন ধরনের সামরিক,বেসামরিক বা সরকারি তথ্য প্রচার করা যাবে না৷আমাদের কথা হচ্ছে আমরা সেনাবাহিনী সম্পর্কিত তথ্যের স্পর্শকাতরতার বিষয়ে ভালোভাবেই অবগত৷ কিন্তু বেসামরিক এবং সরকারি তথ্য গণমাধ্যমে প্রচার করা কেন যাবে না? কাজেই এ ধারায় প্রমাণ করে- এ নীতিমালা গণমাধ্যমের ওপর স্তক্ষেপ৷ তিনি বলেন, সমপ্রচার নীতিমালা সম্পাদকদের নিরস্ত্র করার অভিনব প্রয়াস৷ এ নীতিমালা হলে বাংলাদেশের শ্রোতা দর্শক দেশের টিভি-চ্যানেল বাদ দিয়ে অন্য দেশের মিডিয়ার ওপর ঝুঁকবে৷

প্রস্তাবিত সমপ্রচার নীতিমালা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকার এই নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে গেলে তাদের আমলেই করা অনেকগুলো আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে৷তিনি বলেন, এই নীতিমালা হলে মানুষের মৌলিক অধিকার- মানবাধিকার হরণ হবে৷ নীতিমালাটি হলে সীমান্তে মানুষ হত্যা করা হলেও কোনো কথা বলা যাবে না৷ অধ্যাপক গোলাম রহমান বলেন, সাংবাদিকদের দাবির মুখেই নীতিমালা করা হচ্ছে৷ অনেক দিন থেকেই সাংবাদিকরা নিজেদের জন্য একটি নীতিমালা দাবি করে আসছিলেন৷ সেই সুযোগেই তথ্য মন্ত্রণালয় একটি নীতিমালা গণমাধ্যমের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে৷ তবে নীতিমালা চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই৷একাত্তরটেলিভিশনের সিইউও এবং প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু বলেন, সমপ্রচারনীতিমালা একেবারেই অপ্রয়োজনীয়৷ গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতেই এই নীতিমালা৷ অনেকটা ঘোড়ার আগে চাবুক কেনার মতো বিষয়৷ নিউজ টুডের সম্পাদক মো: রিয়াজ উদ্দিন বলেন, এ ধরনের নীতিমালা আগেও করার চেষ্ঠা করা হয়েছে৷ কিন্তু সফল হয়নি৷ এবারও গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রনের অপচেষ্ঠা সফল হবে না৷ আমরা এই নীতিমালকে প্রতিহত করবো৷

অনুষ্ঠানের সভাপতি ও সমকালের সম্পাদক গোলাম সরোয়ার বলেন, তথ্যমন্ত্রী বলেছেন এই্ নীতিমালা একটি গাইড লাইন মাত্র৷ তিনি মন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,এতোসব না বলে সোজা বললেই পারেন যে, বিটিভি যেভাবে চলছে আপনারাও সেভাবেই চলুন৷যোগ্যলোকদের দিয়ে নিজেদের মধ্যে একটি কমিশন গঠনের আহ্বান জানান তিনি৷ অন্যদের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন, অ্যাসোসিয়েশন অব টিভি চ্যানেল ওনার্সের সাধারণ সম্পাদক শাইখ সিরাজ, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের দুই অংশের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল, শওকত মাহমুদ, প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, কালের কন্ঠের সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, নিউএজ সম্পাদক নুরুল কবির ও এটিএন বাংলার সিইও জ ই মামুন ও মাছরাঙ্গা টিভির প্রধান সম্পাদক ফাহিম মুনায়েম প্রমুখ৷সভায় সভাপতিত্ব করেন সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার৷ অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেছেন ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত৷