দৈনিকবার্তা নিজস্ব সংবাদদাতা,২৮ আগস্ট: ডেনমার্কের সাথে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বানিজ্যিক সম্পর্কের ধারা সুনিশ্চিত রাখতে কোপেনহেগেনে দূতাবাস প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ইতিমধ্যে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এ লক্ষ্যে ঢাকা থেকে একাধিক টিম চলতি বছর ডেনমার্ক সফরও করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, কোপেনহেগেনে বসবাসরত কিছু বাংলাদেশি যারা নিজেদেরকে ড্যানিশ প্রশাসনের কাছে রোহিঙ্গা পরিচয় দিয়ে রিফিউজি স্টেটাসে দেশটিতে বৈধ হয়েছে, তারা অত্যন্ত সুকৌশলে কাঁটা বিছিয়ে দিচ্ছে দূতাবাস প্রতিষ্ঠার পথে।
নন-প্যাট্রিয়ট সুবিধাবাদী কুলাঙ্গার শ্রেনীর এই বাংলাদেশিরা আশংকায় আছে দূতাবাস স্থাপিত হলে তাদের রোহিঙ্গা স্ট্যাটাস হারাবার মধ্য দিয়ে অবৈধ হয়ে যাবার। শুধু তাই নয়, ডেনমার্কে বাংলাদেশ দূতাবাস প্রতিষ্ঠিত হলে স্বার্থান্বেষী এই গোষ্ঠী তাদের ‘রোহিঙ্গা বিজনেস’ আর ধরে রাখতে পারবে না এমন আশংকা থেকেই এখন চালিয়ে যাচ্ছে নানান কূটচাল। বাংলাদেশ থেকে আসা সার্ভে টিমের সামনে লিগ্যাল স্ট্যাটাস আড়াল করার পাশাপাশি তারা নিজেদেরকে বাংলাদেশি পরিচয় দিয়ে টিমের সদস্যদের ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালায়।
ঢাকা ও কোপেনহেগেনের একাধিক সূত্র এই প্রতিবেদককে জানিয়েছে, ভূয়া রোহিঙ্গারা সার্ভে টিমকে বারবার বোঝাতে চেষ্টা করেছে, ডেনমার্কে বসবাসরত হাজার-পনেরশ’ বাংলাদেশির জন্য আসলে এ্যাম্বেসির তেমন কোন প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থবিরোধী এমন প্রচারণায় সার্ভে টিমের বিজ্ঞ সদস্যরা অবাক হলেও ভদ্রতার খাতিরে তাদের চ্যালেঞ্জ করেননি তখন। কারণ চিহ্নিত এইসব রোহিঙ্গা স্ট্যাটাসধারী বাংলাদেশিদেরই মেহমানদারি গ্রহণ করতে হয় তখন ঢাকা থেকে আসা সার্ভে টিমকে। সুইডেনের বাংলাদেশ দূতাবাসের জনৈক কর্মকর্তা তার ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য ঢাকা থেকে আগত সার্ভে টিমকে ডেনমার্কের এই চক্রের হাতে তুলে দেয় বলে অভিযোগ আছে।
কোপেনহেগেনে বহুদিনের প্রত্যাশিত বাংলাদেশ দূতাবাস প্রতিষ্ঠিত হোক, তা কেন চায় না ভূয়া রোহিঙ্গারা – এর নেপথ্যের কারণ অনুসন্ধানে জানা যায় ভয়াবহ কিছু অপ্রকাশিত সত্য। ডেনমার্কে বর্তমানে যে প্রায় ১৫শ’ বাংলাদেশির বসবাস, তার মধ্যে অন্ততঃ ৩ শতাধিক আছে যারা ড্যানিশ ইমিগ্রেশনের কাছে মিথ্যা তথ্য সহ ভূয়া কাগজপত্র দেখিয়ে নিজেদেরকে রোহিঙ্গা পরিচয় দিয়ে রিফিউজি স্ট্যাটাসে কোনমতে বৈধ হয়েছে। জাতিসংঘের উদ্বাস্তু পাসপোর্ট পকেটে নিয়ে এরা বাংলাদেশে যাওয়া-আসা করতে পারে। বিয়ে করে বাংলাদেশ থেকে স্ত্রীদেরও নিয়ে আসে অনেকে। টোটাল এই ম্যাকানিজমের খুঁটিনাটি ড্যানিশ ইমিগ্রেশন অনেক আগেই সব জেনে গেলেও মূলতঃ মানবিক কারণেই তারা ছিনিয়ে নেয়না বাংলাদেশিদের এই ভূয়া স্ট্যাটাস।
মিথ্যার ওপর বৈধতা হলেও হাই-ইনকামে ডেনমার্কে অর্থনৈতিকভাবে অবশ্য বেশ ভালো আছে ভূয়া রোহিঙ্গারা। তবে সময়ে সময়ে যে কারো লিগ্যাল স্ট্যাটাস বাতিল করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে ড্যানিশ ইমিগ্রেশন। তাছাড়া নতুন আবেদনকারীদের অনেকেই প্রায়শঃই হয়ে যায় টেবিল রিজেক্ট বা ঝুলে থাকে তাদের আবেদন। ড্যানিশ ইমিগ্রেশনের কাছে আগে থেকেই তথ্য থাকে যে, এরা আসলে রোহিঙ্গা নয় এবং মূলতঃ বাংলাদেশ থেকেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশ হয়ে ডেনমার্কে অনুপ্রবেশকারী। সত্যতা যাচাই-বাছাইয়ের পর এদেরকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে প্রয়োজন হয় তখন বাংলাদেশি পাসপোর্ট, যা ইস্যু করার এখতিয়ার পাশের দেশ সুইডেনের বাংলাদেশ দূতাবাসের।
চিঠি আদান-প্রদান সহ স্টকহল্মের বাংলাদেশ দূতাবাসেই নিয়মিত দৌড়ঝাপ করতে হয় ড্যানিশ ইমিগ্রেশনের লোকদের। বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এখন কোপেনহেগেনে দূতাবাস প্রতিষ্ঠিত হলে ড্যানিশ ইমিগ্রেশনের জন্য অনেক সহজ হয়ে যাবে দেশটিতে ‘রোহিঙ্গা কেস’ করা বাংলাদেশিদের আসল পরিচয় জানা এবং ওয়ান-টু’র মধ্যে দূতাবাস থেকে পাসপোর্ট ইস্যু করিয়ে তাদেরকে ডেনমার্ক ছাড়তে বাধ্য করা। দেশটির সাথে বাংলাদেশের বিগ ভলিউম ট্রেড এন্ড কমার্সের বিষয়টি মাথায় রেখে দূতাবাসও এক্ষেত্রে অনেকটা বাধ্য থাকে রোহিঙ্গা পরিচয়দানকারী এইসব বাংলাদেশিদেরকে প্রয়োজনীয় পাসপোর্ট ইস্যু করতে, যেমনটা বিগত দিনে করে আসা হয়েছে সুইডেন থেকে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, কোপেনহেগেনের কুচক্রীদের অবৈধ বানিজ্যটি মূলতঃ এখানেই। চলতি বছর ড্যানিশ ইমিগ্রেশন প্রায় অর্ধশতাধিক ‘ভূয়া রোহিঙ্গা’ তথা বাংলাদেশিদেরকে যখন দেশত্যাগের নির্দেশ দেয়, তখন তাদের নিয়ে ব্যাপক বানিজ্য শুরু করে কোপেনহেগেনের ঐ স্বার্থান্বেষী চক্র। ড্যানিশ ইমিগ্রেশনের তরফ থেকে ঐ অর্ধশতাধিক লোকের নামের তালিকা পাঠানো হয় সুইডেনের বাংলাদেশ দূতাবাসে। এই দূতাবাসেরই জনৈক কর্মকর্তার সাথে যোগসাজশে চরম সুবিধাবাদী এই চক্রটি বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দলের ডেনমার্ক শাখার নাম ভাঙ্গিয়ে বহিষ্কারের মুখোমুখি ঐ বাংলাদেশিদের মাথায় কাঠাঁল ভেঙ্গে খাবার সব আয়োজন সম্পন্ন করে।
অফার দেয়া হয় জনপ্রতি ৫ হাজার ড্যানিশ ক্রোনার করে তাদের কাছে জমা দেয়া হলে তারা সুইডেনের বাংলাদেশ দূতাবাসকে ম্যানেজ করে পাসপোর্ট ইস্যুর ঐ তালিকা থেকে নাম বাদ দেয়ার ব্যবস্থা করবে। ৫ হাজার ক্রোনার করে বেশ ক’জনের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয় তখন। অতীতে এর আগেও বহুবার এভাবে রোহিঙ্গা-বানিজ্যের জমজমাট আসর বসায় তারা। তবে সরকারের চলতি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডেনমার্কে বাংলাদেশ দূতাবাস আলোর মুখ দেখলে অন্ধকার জগতের এই লুটেরাদের রোহিঙ্গা-ধান্ধা বন্ধ হয়ে যাবে, এমন নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে পর্যবেক্ষক মহল থেকে।
এদিকে ঢাকার রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)’র দেয়া তথ্য মোতাবেক, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৬২৩.৮৮ মিলিয়ন ডলারের পন্য ডেনমার্কে রপ্তানি করেছে বাংলাদেশে। এর আগের অর্থবছরে অর্থাৎ ২০১২-১৩ সালে যা ছিল ৫১২.৯৯ মিলিয়ন ইউএস ডলার। বানিজ্য বেড়েছে গত কয়েক বছরের প্রায় ৩শ’ ভাগ। ডেনমার্কে বাংলাদেশের এক্সপোর্ট বাস্কেটের শতকরা ৯২ ভাগ জুড়ে আছে আরএমজি তথা রেডিমেইড গার্মেন্টস। বাংলাদেশে তৈরী সমুদ্রগামী জাহাজও এখন আসছে ডেনমার্কে। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানী হওয়া অন্যান্য পন্যের মধ্যে রয়েছে হিমায়িত খাবার, কৃষি পন্য, পাটজাত দ্রব্যাদি, কেমিক্যাল প্রোডাক্টস, মাছ এবং মাছ ধরার উপকরণ।
অন্যদিকে ডেনমার্ক থেকে বাংলাদেশে যাচ্ছে ফার্মাসিউটিক্যালস, দুগ্ধজাত সামগ্রী এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেশিনারিজ। ৭০টির বেশি ড্যানিশ কোম্পানি ইতিমধ্যে বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগ সহ ব্যবসা-বানিজ্য সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। জাহাজ নির্মাণ শিল্পে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অগ্রগতিতে আরো গতি সঞ্চার করতে বিশেষ সহযোগিতা দিতে আগ্রহী ডেনমার্কের প্রভাবশালী বিনিয়োগকারীরা। তাছাড়া ফিশিং, রিনিউবেল এনার্জি এবং বর্জ্য ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অত্যাধুনিক কারিগরী ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা বাংলাদেশকে দিতে আগ্রহ দেখিয়েছেন ড্যানিশরা। বিশ্লেষকরা বলছেন, দ্বিপাক্ষিক বানিজ্যিক সম্পর্কের নবদিগন্তের এই মাহেন্দ্রক্ষণে কোপেনহেগেনে যত দ্রুততম সময়ের মধ্যে উড়বে লাল-সবুজ পতাকা, ঠিক ততোটাই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।