বেহাল কাজী জাফরের জাপা। এক বছরেও গুছিয়ে উঠতে পারেনি কাজী জাফরের জাতীয় পার্টি। উল্টো এরশাদকে ছেড়ে আসা নেতাদের অনেকেই আবার মূল দলে ফেরার সুযোগ খুঁজছেন।
দৈনিকবার্তা,২৭আগস্ট: গতিহীন হয়ে পড়েছে কাজী জাফরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি। নতুন দল ঘোষণার প্রায় এক বছরের মাথায়ও গুছিয়ে উঠতে পারেনি দলটি। উল্টো এরশাদকে ছেড়ে আসা নেতাদের অনেকেই আবার মূল দলে ফেরার চেষ্টা করছেন। ফলে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক গুরু ও সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের বিরুদ্ধে জিহাদে নামার ঘোষণা দিয়ে নতুন দল গঠন করলেও এখন হালে পানি পাচ্ছেন না এ সময়ের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ কাজী জাফর আহমদ।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পূর্বে বিএনপি জোট ক্ষমতায় যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় এরশাদের দল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন কাজী জাফর। যদিও তার আগে এরশাদেরও বিএনপি জোটে যোগ দেয়ার গুঞ্জন ছিল। কিন্তু নানা নাটকীয়তা শেষে এরশাদ যখন আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন কাজী জাফর তখন এরশাদকে ‘জাতীয় বেইমান’ আখ্যা দেন। এক পর্যায়ে গত বছরের ২৮ নভেম্বর এরশাদ জাতীয় পার্টি থেকে কাজী জাফরকে বহিষ্কার করেন। কিন্তু মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে কাজী জাফরও একইদিন এরশাদকে পাল্টা বহিষ্কারের ঘোষণা দেন এবং নিজেকে জাতীয় পার্টির বৈধ অংশের নেতা দাবি করে নতুন দল করার ঘোষণা দেন। পরে বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতায় ২০ ডিসেম্বর বিশেষ কাউন্সিল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কাজী জাফরের নেতৃত্বে নতুন জাতীয় পার্টির যাত্রা শুরু হয়। এতে কাজী জাফরকে চেয়ারম্যান ও গোলাম মসীহ মহাসচিব নির্বাচিত হন।
কিন্তু প্রায় এক বছর হতে চললেও জাফরের দলের অবস্থা এখনো বেহাল। কারণ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি ছেড়ে যারা কাজী জাফরের সঙ্গে এসেছেন তাদের অনেকেই এখন মূল দলে ফিরে যাওয়ার তদবির করছেন। ইতোমধ্যেই কাজী জাফরকে ছেড়ে চলে গেছেন তার প্রথম মহাসচিব গোলাম মসীহ। আরো যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন প্রায় এক ডজন শীর্ষ নেতা, যাদের সবাই কাজী জাফরের দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য।
জানা গেছে, মূলত নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব আর কোন্দলে বিপর্যস্ত এক বছর আগে গড়া কাজী জাফরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি। এছাড়া চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনিও সঠিকভাবে সময় দিতে পারেননি। দল গড়ার তিন মাসের মাথায় তিনি চিকিৎসার জন্য অস্ট্রেলিয়া যান। এ সময় টিআইএম ফজলে রাবি্বকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও এসএম আলমকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব দেন। তখন থেকেই দলে কোন্দলের সূত্রপাত। এ সময়ই দলে একক কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ হারান কাজী জাফর। আর তার কর্তৃত্বহীনতার সুযোগে দলে দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে।
এদিকে কাজী জাফরের জাতীয় পার্টি নিজেদের মূল অংশ বলে দাবি করলেও এক বছরেও তারা কোনো স্বতন্ত্র গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করতে পারেননি। এ পর্যন্ত ঠিক হয়নি দলীয় প্রতীক। নিজ দলীয় কোনো কর্মসূচিও তারা পালন করতে পারেননি। শুধু ২০ দলীয় জোটের কর্মসূচিতে অংশ নিয়েই জোটের অংশীদারিত্বের জানান দিচ্ছে তার দল। সর্বশেষ গাজা ইস্যুতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের প্রতিবাদ কর্মসূচিতেও থাকতে পারেননি কাজী জাফর। তার দলের পক্ষে শুধুমাত্র মহাসচিবই উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও ২০ দলীয় জোটে জামায়াতের তোপে পাত্তা মিলছে না জাফরের জাপার। একইসঙ্গে দলের অঙ্গ ও সহযোগী হিসেবে যেসব সংগঠন রয়েছে সেগুলোও একেবারেই নামকাওয়াস্তে। ৫ বার দলবদল করা অন্য এক দলের ছাত্র সংগঠন থেকে ধার করে আনা এক ‘আদুভাই’কে দিয়ে গঠন করা হয়েছে জাতীয় ছাত্র সমাজের কমিটি।
যদিও ইতোমধ্যেই কাউন্সিল করে ১৩টি জেলা ও ঢাকা মহানগরের কমিটি দেয়া হয়েছে বলে দাবি করেন দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য এসএম আলম। তিনি জানান, নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তাদের দল ২১টি জেলা, ৩৫টি উপজেলা কমিটি গঠন করেছে। আরো কয়েকটি কমিটি ঘোষণার প্রক্রিয়া চলছে।
গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ১৯৯ সদস্যের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি গঠনের প্রস্তাবনা রয়েছে। এতে একজন চেয়ারম্যান, ৪১ জন প্রেসিডিয়াম সদস্য, ১ জন মহাসচিব, ৪১ জন ভাইস চেয়ারম্যান, ১৬ জন যুগ্ম মহাসচিব, ৩১ জন সাংগঠনিক সম্পাদক, ২৩ জন বিভাগীয় সম্পাদক, ৩১ জন যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক, ২৩ জন যুগ্ম বিভাগীয় সম্পাদক ও ৯১ জন নির্বাহী সদস্যের পদ রয়েছে। কিন্তু উলি্লখিত পদের অধিকাংশই এখনো শূন্য রয়েছে।
এদিকে ইতোমধ্যে দল ছেড়ে গেছেন প্রথম মহাসচিব গোলাম মসীহ। তিনি এরশাদের সঙ্গে না থাকলেও বিরোধীদলীয় নেতা রওশনের রাজনৈতিক সচিব নিযুক্ত হয়েছেন। এছাড়াও অনেক প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ শীর্ষ নেতারা যে কোনো মুহূর্তে জাফরকে ছেড়ে যেতে পারেন বলে জানা গেছে। এরমধ্যে এরশাদের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ কুষ্টিয়ার এক প্রভাবশালী নেতা মূল জাপায় ফেরার প্রক্রিয়া শেষ করে এনেছেন। আরেক প্রভাবশালী নেতা এসএম আলম নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। আর সিলেটের আতিকুল ইসলাম আতিক, নওয়াব আব্বাস আলী খান, ড. টিআইএম ফজলে রাবি্ব_ এমনকি দলের বর্তমান মহাসচিব মোস্তফা জামাল হায়দারও এরশাদের দলে ফিরে যাওয়ার জন্য এক পা বাড়িয়ে আছেন বলে জানা গেছে। মূলত বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের আন্দোলনের সফলতা নিয়ে সন্দেহ ও আগামীতে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন ধূসর বলে নেতারা এরশাদের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়ার চিন্তা করছেন। তাছাড়া দলের নিবন্ধন না থাকায় কোন দল থেকে নির্বাচন করবেন এ নিয়েও শীর্ষ নেতাদের মধ্যে রয়েছে অস্বস্তি।
জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির মহাসচিব (জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার দৈনিকবার্তাকে বলেন, এরশাদের দলে ফিরে যেতে তাদের দলের কারো কারো হয়তো যোগাযোগ থাকতে পারে, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তার নেই। তিনি বলেন, তাদের দল যেহেতু মাঠের প্রকৃত বিরোধীদলীয় জোটের শরিক, সেহেতু সরকারের দমনপীড়নের কারণে তারা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে পারছেন না। এছাড়া অর্থ সঙ্কটের কারণেও নিয়মিত দলীয় কর্মকা- চালাতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। তবে দলের চেয়ারম্যান সুস্থ হয়ে উঠলে অচিরেই দল গোছানোর পাশাপাশি সরকারবিরোধী আন্দোলনেও কার্যকর ভূমিকা রাখবে।