দৈনিকবার্তা,২৬আগস্ট: ইন্টারকন্টিনেন্টাল (১৯৬৬–৮৩)আর মাত্র ছয় দিন। এরপর আগামী সোমবার থেকে সংস্কারকাজের জন্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাঁচ তারকা হোটেল রূপসী বাংলা। সেই সঙ্গে নিলামে উঠতে যাচ্ছে হোটেলের মূল্যবান নানা আসবাব।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হবে হোটেলটির সংস্কারকাজ। এর মাধ্যমে নতুন রূপ দেওয়া হবে প্রায় ৪৮ বছরের পুরোনো এই হোটেলকে। বদলে যাবে নাম। ব্যবস্থাপনায় আসবে নতুন কর্তৃপক্ষ। ১৯৮৩ সালে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ছেড়ে যাওয়া ‘ইন্টারকন্টিনেন্টাল’ নামটি আবারও নামফলক হয়ে যুক্ত হচ্ছে হোটেলটির গায়ে।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীনও হোটেলটি চালু ছিল। সে সময় হোটেলটিকে ‘সবুজ এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। হোটেলটিতে অবস্থান করে যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করেছিলেন একদল বিদেশি সাংবাদিক।
রূপসী বাংলা হোটেলের বর্তমান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সংস্কারকাজ শেষে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে নতুন রূপে, নতুন নামে হোটেলটি আবার চালু হবে। তবে সংস্কারকাজে বিলম্ব হলে চালুর প্রক্রিয়াটি হয়তো পিছিয়ে যেতে পারে।
গতকাল সোমবার হোটেলটি সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেল, বন্ধের দিনক্ষণ যতই ঘনিয়ে আসছে, হোটেলটির পরিবেশ ততই নীরব হয়ে যাচ্ছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চোখে-মুখেও একধরনের মলিনতার ছাপ ফুটে উঠেছে। চাকরি হারানোর শঙ্কা আপাতত নেই। তার পরও হতাশা তাঁদের মধ্যে।
এ সময় কথা হয় হোটেলটির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে। তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে এই হোটেলের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। তাঁদেরই একজন কথায় কথায় বললেন, ‘চাকরি থাকবে। মাস শেষে বেতনও হয়তো পাব। কিন্তু দীর্ঘদিনের চেনাজানা কাজের সেই পরিবেশটি আর থাকবে না।’
গতকাল দুপুরে হোটেলটিতে ঢুকতেই লবিতে দেখা গেল, সংস্কার-পরবর্তী ‘ইন্টারকন্টিনেন্টালের’ নতুন রূপসংবলিত বিশাল এক নকশা। সেখানে হোটেলে বাহ্যিক রূপের পাশাপাশি হোটেল কক্ষ, বৈঠকখানা, হলরুমের ভেতরকার নতুন অবয়বের চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে।
রূপসী বাংলার বিপণন ও যোগাযোগ ব্যবস্থাপক সাহিদুস সাদিক দৈনিকবার্তাকে বলেন, শুধু চলতি মাসেই হোটেলটির রাজস্ব আয় হবে ১০ থেকে ১১ কোটি টাকা। গতকাল পর্যন্ত প্রায় নয় কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে।
সাদিক আরও জানান, বন্ধের আগে সর্বশেষ ইউএস এনার্জি অ্যাসোসিয়েশন ও ডি-৮ভুক্ত দেশগুলোর পর্যটন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণে দুটি আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। ৩১ আগস্ট বন্ধের আগের দিন বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানেরও বুকিং রয়েছে।
রূপসী বাংলা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এরই মধ্যে দেশি-বিদেশি নিয়মিত গ্রাহকদের চিঠির মাধ্যমে হোটেলটির বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গতকালও হোটেলটিতে ধারণক্ষমতার ৫৬ শতাংশ পরিপূর্ণ ছিল। বর্তমানে হোটেলটিতে ২৭২টি অতিথিকক্ষ রয়েছে, যেগুলোর ভাড়া ১০০ থেকে ১৫০ ডলার। সোমবার সেখানে ১৫২ জন অতিথি ছিলেন। ৩১ আগস্টের মধ্যে এঁদের বেশির ভাগই হোটেল ছেড়ে যাবেন। যে কয়জন অতিথি থাকবেন, সর্বশেষ সোমবার সকালে তাঁদের আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় দিয়ে হোটেলটির পর্দা নামানো হবে।
সাধারণ অতিথিকক্ষের বাইরে হোটেলটিতে রয়েছে সাতটি প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুট, যেগুলোর প্রতিটির আয়তন এক হাজার ৩৫০ বর্গফুট। প্রতিটি স্যুটের সর্বনিম্ন ভাড়া ৫০০ ডলার।
এর আগে গত মে মাসে রূপসী বাংলার সংস্কার কার্যক্রমের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এটির মহাব্যবস্থাপক জেমস পি ম্যাকডোনাল্ডের সঙ্গে কথা হয়। তখন তিনি জানিয়েছিলেন, সংস্কারের মাধ্যমে হোটেলের অতিথিকক্ষের মান উন্নত করার পাশাপাশি আয়তনও বাড়ানো হবে। এর ফলে কক্ষের সংখ্যা কমে আসবে ২২৬টিতে। প্রতিটির আয়তন বেড়ে হবে ৪০ বর্গমিটার। বর্তমানে সাধারণ অতিথিকক্ষের সর্বনিম্ন আয়তন ২৮ বর্গমিটার।
ম্যাকডোনাল্ড জানান, ২০১২ সালে হোটেলটির মালিক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সার্ভিসেস লিমিটেডের (বিএসএল) সঙ্গে ইন্টারকন্টিনেন্টাল গ্রুপের চুক্তি হয়। এই চুক্তির আওতায় সংস্কারকাজ শুরু করা হচ্ছে।
জানা গেছে, ২০১৩ সালের জুলাইয়ে এটির সংস্কার কার্যক্রম শুরুর কথা থাকলেও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বকাপের কারণে সেটি পিছিয়ে যায়।
বর্তমানে হোটেলটিতে স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলিয়ে পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। এঁদের মধ্যে ২৮৫ জনকে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র (বিআইসিসি) এবং ৭০ জনকে বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ বলাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে। বাকিদের যুক্ত করা হবে সংস্কার প্রকল্পে। বলাকা ও বিআইসিসির পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বিএসএল।
জানা গেছে, হোটেলটির সংস্কারকাজের জন্য সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪০০ কোটি টাকা। ব্যাংকঋণের মাধ্যমে বিএসএল এই অর্থের সংস্থান করবে। দীর্ঘদিন ধরেই এই হোটেল লাভজনকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। ২০১০, ২০১১, ২০১২ ও ২০১৩ সালে এটির প্রকৃত মুনাফা ছিল যথাক্রমে সাড়ে ৩৪ কোটি, ৪০ কোটি, সাড়ে ৪৬ কোটি ও ১৯ কোটি টাকার বেশি।
প্রসঙ্গত, রাজধানীর শাহবাগে প্রায় সাড়ে চার একর জমির ওপর অবস্থিত এই হোটেলটি ১৯৬৬ সালে চালু হয়। শুরু থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত এটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল ইন্টারকন্টিনেন্টাল। ১৯৮৪ সালে যুক্ত হয় শেরাটন হোটেল। ২০১১ সালের এপ্রিলে শেরাটন চলে যাওয়ার পর এটি সরকারি উদ্যোগে ‘রূপসী বাংলা’ নামে পরিচালিত হয়ে আসছে।
১ সেপ্টেম্বর বন্ধ হয়ে যাবে রূপসী বাংলার কার্যক্রম। এর পরই সংস্কারকাজ সম্পন্ন করে নতুন রূপ দেওয়া হবে প্রায় ৪৮ বছরের পুরোনো এই হোটেলকে
৩৫৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বিআইসিসি ও বলাকায় স্থানান্তর
নিলামে উঠছে বিপুল আসবাব
দেশি-বিদেশি নিয়মিত গ্রাহকদের হোটেলটির বন্ধ হয়ে যাওয়ার তথ্য জানিয়ে দেওয়া হয়েছে
ইন্টারকন্টিনেন্টাল (১৯৬৬–৮৩)
শেরাটন (জানুয়ারি ১৯৮৪ থেকে এপ্রিল ২০১১)
রূপসী বাংলা (মে ২০১১ থেকে আগস্ট ২০১৪)
ইন্টারকন্টিনেন্টাল (২০১৬ সালে নতুন রূপে)
বন্ধের দিনক্ষণ যতই ঘনিয়ে আসছে, হোটেলটির পরিবেশ ততই নীরব হয়ে যাচ্ছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চোখে-মুখেও একধরনের মলিনতার ছাপ ফুটে উঠেছে