1407864572.দৈনিকবার্তা: বিশ্বের সর্বোচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে। বিদ্যুতায়নে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়িতে ১২শ’ মেগাওয়াট দক্ষতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ এ বছরই শুরু করা হবে। এর সম্ভাব্য ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৬ হাজার কোটি টাকা। এই প্রকল্পের আওতায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দরও নির্মিত হবে এবং মাতারবাড়ি দ্বীপে একটি ভারী শিল্প এলাকা গড়ে তোলা হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অত্যাধিক জ্বালানি সাশ্রয়ী (আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল) প্রযুক্তিতে নির্মিত হবে। এটি উৎপাদনে গেলে প্রায় ১১ শতাংশ জনগোষ্ঠী নতুন করে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আসবে।
জানা গেছে, কেন্দ্রটির তাপীয় দক্ষতা (থার্মাল এফিসিয়েন্সি) হবে প্রায় সাড়ে ৪১ শতাংশ; যেখানে জাপানের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর গড় তাপীয় দক্ষতা ৪০ শতাংশের কিছু বেশি। তিন ধাপে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০২৩ সালে। প্রথম ধাপের কাজ ২০১৮ সালের মধ্যে শেষ করে বিদ্যুৎ সরবরাহের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রকল্পটিতে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) সহজশর্তে ঋণ প্রদান করবে। এই প্রকল্পে জাইকা সংযুক্ত হতে পেরে উৎফুল্ল বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল (লোটাস কামাল)। দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্পে জাপানকে সংযুক্ত করতে পারাকে পরিকল্পনামন্ত্রীর সাফল্য হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। না হলে এত বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়ত বলে মনে করছেন তারা।
গতকাল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) এই প্রকল্পটি সহ ৩৭ হাজার ৩৩৯ কোটি ৮৩ লাখ টাকার ৫টি প্রকল্প পাস করেছে। শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে একনেক চেয়ারপারসন শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে একনেকের বৈঠকে এ অনুমোদন দেয়া হয়। পাসকৃত ৫টি প্রকল্পের মধ্যে ২টি নতুন এবং ৩টি সংশোধিত প্রকল্প। ২টি নতুন প্রকল্পের একটি মাতারবাড়ি তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র যা বাস্তবায়ন করতে পারলে সরকারের যুগান্তকারী সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হবে।
প্রকল্পে ৬শ’ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি স্টিম টারবাইন, সার্কুলেটিং কুলিং ওয়াটার স্টেশন স্থাপন, ২৭৫ মিটার উচ্চতার দুটি স্টেক, আবাসিক ও সামাজিক এলাকা গঠন, পানি শোধন ব্যবস্থা, সাব-স্টেশন, জেটি, কয়লা সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা, অ্যাশ ডিসপোজাল এরিয়া এবং বাফার জোন নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে বিদেশি অর্থায়ন (জাইকা) ২৮ হাজার ৯৩৯ কোটি, সরকারি খাত থেকে ৪ হাজার ৯২৬ কোটি ৬৬ লাখ এবং সংস্থার নিজস্ব তহবিল থেকে ২ হাজার ১১৮ কোটি ৭৭ লাখ টাকা মেটানো হবে। পরিবেশ দূষন রোধে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সম্পূর্ণভাবে অস্ট্রেলিয়া এবং ইন্দ্রোনেশিয়া থেকে আমদানিকৃত কয়লার ওপর নির্ভরশীল। প্রকল্পের আওতায় ৪ হাজার ৭০০ কেজি স্ট্যান্ডার্ডে প্রয়োজনীয় পরিমাণ কয়লা আমদানি করা হবে। এতে প্রতি টন কয়লার দাম ১০ হাজার ২৫৫ টাকা ৫০ পয়সা ধরা হয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের উদ্যোগে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিএল)।
মাতারবাড়ি কয়লা ভিত্তিক প্রকল্প প্রসঙ্গে একনেক সভায় শেখ হাসিনা বলেন, অর্থমূল্যের দিক থেকে এটাই সর্ববৃহৎ প্রকল্প যা আমরা অনুমোদন দিতে পেরেছি। এই প্রকল্প আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল বিদ্যুৎকেন্দ্র এর ফলে প্রকল্পে ব্যবহৃত কয়লা ও ধোঁয়া দেখা যাবে না। তিনি বলেন, প্রথম পর্যায়ে প্রকল্পের কয়লা ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা হবে। আমাদের দেশের কয়লা গচ্ছিত রাখা হবে। ২০১৮ সালের মধ্যে ২টি ইউনিটের মধ্যে যাতে একটি ইউনিটের উদ্বোধন করা যায় সেই বিষয়ে আগামী মাসে সফরে আসা জাপানের প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানানো হবে। আমার বিশ্বাস তিনি আমাদের কথা রাখবেন।
প্রধানমন্ত্রী আরো জানান, জাপান সরকারের সহায়তায় মাতারবাড়িতে একটি উন্নত মানের আর্টিফিশিয়াল গভীর সমুদ্র বন্দর হবে। জাপানের কাশিমা গভির সমুদ্রবন্দরের আদলে এটি তৈরি করা হবে। মাতারবাড়িতে জাপান বৃহৎ শিল্প গড়ে তুলবে। একই সঙ্গে কক্সবাজার মেইনল্যান্ড থেকে মহেশখালী নদী পর্যন্ত ঝুলন্ত সেতু নির্মাণে প্রধানমন্ত্রী চায়না সরকারকে অনুরোধ করবেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
জাইকার সহজশর্তে ঋণ এবং এ প্রকল্পের কাজ সম্পর্কে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, জাইকা অত্যন্ত খুশি এই প্রকল্পের অংশীদার হতে পেরে। তারা ঋণ চুক্তি সই করার আগেই কাজ শুরু করে দিয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। এমনকি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল এই প্রকল্পের সঙ্গে থাকতে পেরে ইতোমধ্যে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে।
জাইকা’র একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বন্ধুপ্রতীম বাংলাদেশের জন্য এটি জাপানের বন্ধুত্বের নিদর্শন। এ সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশের উন্নয়নে জাপান সব সময়ই পাশে আছে। বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে এটি এ যাবৎকালের সবচে বড় ঋণ। তিনি বলেন, গত ১৬ জুন জাইকার প্রেসিডেন্ট আকিহিকো তানাকার ঢাকা সফরকালে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে বাংলাদেশ সরকারের সাথে জাইকা একটি ঋণচুক্তি সই করে। এ চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতের ৫টি প্রকল্পে ১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান প্রায় ৯ হাজার ১৯৬ কোটি টাকার সহায়তা দিচ্ছে জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (জাইকা)।
একনেক সভায় জানানো হয়, পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান ২০১০ অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৫০শতাংশ বিদ্যুৎ কয়লা থেকে উৎপাদন করা হবে। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী মাতারবাড়িতে ৬০০ মেগাওয়াটের দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে সরকার। এই প্রকল্পে আলট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করা হবে। এ কেন্দ্রের কর্মদক্ষতা হবে ৪১ দশমিক ৩ শতাংশ যা বর্তমানে বাংলাদেশের তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের গড় কর্মদক্ষতা ৩৪ শতাংশ থেকে অনেক বেশি। এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের গড় কর্মদক্ষতা ৩৬ শতাংশ থেকেও বেশি। বেশি কর্মদক্ষতার টেকনোলজি ব্যবহারের ফলে কম পরিমাণ কয়লার প্রয়োজন হবে এবং কম কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত হবে। ফলে বায়ুদুষণসহ পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব একেবারেই কম পড়বে। অধিকন্তু নাইট্রাস অক্সাইড এর পরিমাণ রোধ করার জন্য লোরেট বার্নার স্থাপন করা হবে এবং দুই ধাপে তা প্রজ্বলন করা হবে। সালফার-ডাই অক্সাইড রোধ করার জন্য সাগরের পানিকে ডি-সালফারাইজেসন মেথড ব্যবহার করা হবে। এ্যাশ রোধ বা কমানোর জন্য ইলেকট্রোস্টেটিক প্রিসিপিটেটর এ কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহার করা হবে।
জানা যায়, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি সমৃদ্ধ হওয়ায় মূল বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতির দাম বেশি। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রে সাব-বিটুমিনাস কয়লা ব্যবহার করা হবে। এ কয়লার দাম বিটুমিনাস কয়লা অপেক্ষা কম হওয়ায় বিদ্যুতের দামও কম হবে। এ কয়লা ব্যবহারের কারণে বয়লারের ডিজাইন ভিন্নতর হবে যার জন্য বয়লারের দাম বেশি হবে। তাই এ প্রকল্পের ব্যয়ের সাথে অন্য কোনো প্রকল্পের মেগাওয়াট প্রতি ব্যয় তুলনাযোগ্য নয়।
প্রকল্পটি সম্পর্কে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ভবিষ্যতে এখানে আরও দুটি পাওয়ার প্ল্যান্ট করা হবে। এলএনজি টার্মিনাল হবে। মহেশখালীকে একটি পূর্ণাঙ্গ টাউনশিপ করা হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর, এনভায়রনমেন্টাল ইমপেক্ট অ্যাসেসমেন্ট সার্টিফিকেট দেয়ায় এর পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্ভাবনা নেই। অপরদিকে এই পাওয়ার প্ল্যান্টটি থার্মাল এফিসিয়েন্সির দিক থেকে পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ মানের। এর থার্মাল এফিসিয়েন্সি ৪১ দশমিক ৩ ভাগ। যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৩৫ ভাগ, ভারতে ২৯ ভাগ, ইউকে, জার্মানী এবং ফ্রান্সে ৩৮ ভাগ, এমনকি খোদ জাপানেও ৪০ ভাগ। আমরা আশা করছি ২০১৮ সালের মধ্যে প্রথম পাওয়ার প্ল্যান্টটি সম্পন্ন হবে। বাকি কাজও এই সময়ে চলবে।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, শোকের মাসকে শক্তিতে পরিণত করবে এই পদক্ষেপ। এই প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে আগামী প্রজন্মের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য চট্রগ্রাম গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম হবে বাংলাদেশের শিল্প এবং বাণিজ্য নগরী। এটা স্বপ্ন নয়; এটা এখন বাস্তব। এই প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
মাতারবাড়ির এই কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্পের বছর ভিত্তিক ব্যয় বিভাজন হলো ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৬৪৫ কোটি ৫০ লাখ, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১০৪ কোটি ২৬ লাখ, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২ হাজার ৯৪১ কোটি ৪০ লাখ, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫ হাজার ৮২৮ কোটি ১৮ লাখ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪ হাজার ৪৮৬ কোটি ৬৬ লাখ, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ হাজার ৭৫৯ কোটি ২ লাখ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪ হাজার ৬৬১ কোটি ৫২ লাখ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬ হাজার ৯৬৭ কোটি ৫২ লাখ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬ হাজার ৫৯০ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
সভায় আরো জানানো হয়, কয়লাভিত্তিক এই তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশে প্রথম কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র। যেখানে কুলিং এবং স্টিম জেনারেশনের জন্য সমুদ্রের সারফেস ওয়াটার ব্যবহার করা হবে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ইউনিটে ৬০০ মেগাওয়াট কুলিং ওয়াটার স্টেশন, ২৭৫ মিটার উচ্চতার ২টি স্টেক, আবাসিক-অনাবাসিক বিভিন্ন ধরনের ভবন নির্মাণসহ টাউনশীপ এলাকা গঠন, পানিশোধন ব্যবস্থাপনা, সাব-স্টেশন জেটি, অ্যাশ ডিসপোজাল এরিয়া, কয়লার বাফার জোন ইত্যাদি নির্মাণ করা হবে।
প্রকল্পটির ব্যয়খাত সম্পর্কে জানা যায়, পাওয়ার প্ল্যান্ট (সিভিল), জেটি ও চ্যানেল নির্মাণ বাবদ ৭ হাজার ৯১ কোটি টাকা ব্যয় হবে। চ্যানেলের দৈর্ঘ্য ২ কিলোমিটার, ২৫০ মি. চওড়া এবং ১৮ মিটার গভীর হবে। পাওয়ার প্ল্যান্ট বয়লার বাবদ ৮ হাজার ৩৭ কোটি টাকা, পাওয়ার প্ল্যান্ট টারবাইন ও জেনারেটর বাবদ ৪ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা, পাওয়ার প্ল্যান্ট-এর কয়লা ও উৎপন্ন অ্যাশ ব্যবস্থাপনা বাবদ ২ হাজার ২২৩ কোটি টাকা, ট্রায়েল রান বাবদ ১ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা ব্যয় হবে। এছাড়াও টাউনশিপ উন্নয়ন বাবদ ২২৫ কোটি, পরামর্শক খাতে ৫০৭ কোটি টাকা, ইনস্যুরেন্স, লোকাল ট্রান্সপোর্ট ও পোর্ট হ্যান্ডেলিং বাবদ ১ হাজার ৭ কোটি টাকা, জমি অধিগ্রহণ রিসেটলমেন্ট প্ল্যান ও ভূমি উন্নয়ন বাবদ ৪০৮ কোটি টাকা, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন বাবদ ১০০ কোটি টাকা, সিডি-ভ্যাট বাবদ ১ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা, ইরেকশন, কমিশনের ওপর ভ্যাট ও আয়কর বাবদ ১ হাজার ১৮২ কোটি টাকা, পল্লী বিদ্যুতায়ন বাবদ ৭১ কোটি টাকা ব্যয় হবে।
সভায় পাসকৃত অপর ৪টি প্রকল্প হলো, ‘হাওর অঞ্চলের বন্যা ব্যবস্থাপনা ও জীবন মান উন্নয়ন’ প্রকল্প। এর প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন থাকবে ২৮৩ কোটি টাকা এবং জাইকার প্রকল্প সাহায্য থাকবে ৫৯৭ কোটি টাকা। নতুন এই প্রকল্পটি স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতায় এলজিইডি বাস্তবায়ন করবে। পরিকল্পনামন্ত্রী এই প্রকল্প সম্পর্কে বলেন, বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলের মানুষ বছরের ৬ মাসই পানির নিচে থাকে। তাই মানুষ যাতে বন্যায় আক্রান্ত না হয় সে জন্যই এই প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বন্যা হতে ফসলের ক্ষতি হ্রাস, যাতায়াত সুবিধা বৃদ্ধি এবং মৎস্য সম্পদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই অঞ্চলের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখা।
একনেকে পাস হওয়া আরেক প্রকল্প ‘যশোর সফ্্টওয়্যার টেকনোলজি পার্ক (এসটিপি) স্থাপন (১ম সংশোধিত)’ প্রকল্প। ২৪১ কোটি টাকা ব্যয়ে সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের আওতাধীন বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। এই প্রকল্প সম্পর্কে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, আইসিটি খাতের পিরবর্তন এক সময়ে বিশ্বাস হয়নি। সবকিছু সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আইটি উপদেষ্টা আইসিটি বিশেষজ্ঞ সজীব ওয়াজেদ জয়ের কল্যাণে। তাঁর পরিকল্পনায়ই আমরা এগুচ্ছি। দেশের প্রত্যেক জেলায় এই পার্ক স্থাপন করা হবে। একই সঙ্গে এরই অংশ হিসেবে যশোরে এই প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হচ্ছে।
তিনি বলেন, আইসিটি খাত সম্ভাবনার স্থান। আমরা এই খাতে বিপ্লবের কাছাকাছি চলে এসেছি। অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য এই খাতের বিকল্প নেই। তাই অনেক গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা হচ্ছে। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছিল সকল ইউপি কার্যালয়ে তথ্যকেন্দ্র থাকবে। সেখান থেকে সব তথ্য পাওয়া যাবে। প্রথমে তা বিশ্বাষ করা যায়নি। যা এখন সম্ভব হয়েছে।
একনেক সভায় দারিদ্র্য বিমোচন ও নারী অধিকার নিশ্চিতকরনে পাস করা হয়েছে ‘গুচ্ছগ্রাম’ প্রকল্প। এ প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮৭ কোটি টাকা। সরকারি অর্থায়নে ভূমি মন্ত্রণালয় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। পরিকল্পনামন্ত্রী এই প্রকল্প সম্পর্কে বলেন, পল্লী অঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং নদী ভাঙনের ফলে দুর্গত ১০ হাজার ৬৫০টি পরিবারকে স্বাবলম্বী ও কর্মক্ষম করা হবে। তাদেরকে ৪শতাংশ জমি দেয়া হবে। যাতে করে নিজেরাই নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারে। এ পকল্প এলাকায় উন্নততর পরিবশে সৃষ্টি করতে সকল ধরনের সাহায্য করা হবে। তিনি এই পকল্প চলমান রাখবেন বলে উল্লেখ করেন।
এছাড়া একনেকে পাস হওয়া অপর প্রকল্প হলো ‘হাতে-কলমে কারিগরি প্রশিক্ষণে মহিলাদেরকে গুরুত্ব দিয়ে বিটাকের কার্যক্রম সম্প্রসারণপূর্বক আত্ম-কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র বিমোচন’ প্রকল্প। সরকারি অর্থায়নে ৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্র (বিটাক) এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়ন, জ্ঞান ও দক্ষতার উন্নয়ন, অর্থনীতির মূল ধারায় নারীর অংশগ্রহণ, অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নারীর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণ এবং প্রশিক্ষিত জনবলের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও মধ্যম শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে। পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, এখান থেকে ট্রেনিং করে কোন প্রশিক্ষণার্থী বসে নেই। তারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে। বিটাক এই প্রকল্পের মাধ্যমে নারীদেরকে ২ মাস এবং পুরুষদেরকে এক মাসের প্রশিক্ষণ এবং পরবর্তীতে ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের মাদ্যমে বিনিয়োগে উৎসাহী করে তোলে।
প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির চেয়ারপারসন শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহতি, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসনে আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তিমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান, বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনজিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
ইতোপূর্বে গত ৬ মে জাইকার বাংলাদেশ প্রধান মাইকিও হাতেয়দা পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সাথে বৈঠকে বলেছিলেন, আমি বিশ্বাস করি, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে পারবে। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় বেশি লাগে। এতে প্রকল্প খরচ বেড়ে যায়। তিনি ১২০০ প্রকল্পের কথা উল্লেখ করে বলেন, এত বেশি প্রকল্প বাস্তবায়ন অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব হয়ে পড়ে। বাংলাদেশকে তার প্রকল্প নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রাধিকার নির্ধারণ করে এগুতে হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।