পদ্মায় ২৫০ যাত্রী নিয়ে লঞ্চডুবি তীব্র স্রোতে তল্লাশি বাধাগ্রস্ত 
দৈনিক বার্তা- মুন্সিগঞ্জ,৪আগষ্ট : স্বজন হারানোর আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে মাওয়া লঞ্চঘাট এলাকা৷মা খুঁজে বেড়াচ্ছে মেয়েকে,স্বামী খুঁজছে স্ত্রীকে, পিতা খুঁজছে সন্তানকে৷ সোমবার দুপুর পর্যন্ত ৫ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে৷ এখনও কয়েকশ’ যাত্রী নিখোঁজ রয়েছে৷তাদের মধ্যে এক জনের পরিচয় পাওয়া গেছে৷ তার পরিবারের কাছে লাশ ও নগদ ২০ হাজার টাকা হস্তান্তর করা হয়েছে৷ এখন পর্যন্ত ৮৭ জন নিখোঁজের তালিকা করা হয়েছে৷

প্রায় ২৫০যাত্রী নিয়ে মাওয়া-কাওড়াকান্দি নৌরুটের মোড়ে পদ্মা নদীর মাঝখানে এমভি পিনাক-৬ নামের একটি লঞ্চ ডুবে গেছে৷ সোমবার সকাল সোয়া ১১টার দিকে লঞ্চটি ডুবে যায়৷মুন্সিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো.সাইফুল হাসান বাদল জানান, এ পর্যন্ত ৪৪ জন যাত্রীকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে৷এখন পর্যন্ত পাচঁজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে৷বাকি যাত্রীরা এখনো নিখোঁজ রয়েছেন৷উদ্ধারকারী জাহাজ নির্ভীক নারায়ণগঞ্জ থেকে দুর্ঘটনাস্থলে রওনা হয়েছে৷এছাড়া নৌবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে৷ লঞ্চডুবির খবর পেয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন৷

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্ধার কাজে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর নির্দেশ দিলেও তীব্র স্রোত ও ঢেউয়ের কারণে অভিযান বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছেন৷ লৌহজং থানার ওসি তোফাজ্জল হোসেন জানান, সোমবার বেলা ১১টার দিকে কাওড়াকান্দি থেকে মাওয়া যাওয়ার সময় নদীর লৌহজং টার্নিং পয়েন্টে তীব্র স্রোতের মধ্যে ডুবে যায় পিনাক-৬ নামে লঞ্চটি৷

উদ্ধার অভিযান শুরুর পর বেলা সোয়া ১টার দিকে নদী থেকে অজ্ঞাত পরিচয় দুই নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়, যাদের মধ্যে একজনের বয়স আনুমানিক ৫০, অন্যজনের ৩৫ বছর৷মাওয়া ঘাট লঞ্চ মালিক সমিতির নেতা ইকবাল হোসেনকে উদ্ধৃত করে ওসি জানান, লঞ্চটিতে ২৫০ জন যাত্রী ছিলেন৷তবে উদ্ধার পাওয়া এক যাত্রী মাওয়া ঘাটে সাংবাদিকদের বলেন, লঞ্চে যাত্রী ছিলেন তিন শতাধিক৷

দুর্ঘটনার পরপরই ট্রলার ও স্পিডবোট নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা উদ্ধার কাজ শুরু করেন৷ পরে কোস্ট গার্ড ও ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার অভিযানে যোগ দেন৷ মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল হাসান জানান, দুপুর পর্যন্ত নদী থেকে ৫০/৬০ জনকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়৷ তবে ঠিক কতোজন নিখোঁজ রয়েছেন, সে বিষয়ে কোনো তথ্য জেলা প্রশাসন দিতে পারেনি৷ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ঢাকা অঞ্চলের সহকারী পরিচালক মাহফুজুর রহমান আকন্দ ক বলেন, তাদের ডুবুরি দল স্পিড বোট ও ট্রলারে করে নদীতে তল্লাশি চালাচ্ছেন৷ কিন্তু প্রবল স্রোত আর বাতাসের কারণে কাজ চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে৷তীব্র স্রোতের কারণে ডুবে যাওয়া লঞ্চটি বেশি দূর সরে গেলে উদ্ধার অভিযান আরো কঠিন হয়ে পড়বে বলেও উল্লেখ করেন তিনি৷

তবে সোনার ব্যবহার করে পানির নিচে লঞ্চটি সনাক্ত করার চেষ্টা চলছে জানিয়ে বিআইডবি্লউটিএর উপ পরিচালক আজগর আলী বলেন, আশা করা যায় সন্ধ্যার আগেই লঞ্চটির অবস্থান চিহ্নিত করা সম্ভব হবে৷
লঞ্চডুবির খবর পেয়েই নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান মাওয়ায় ছুটে আসেন৷ তিনি নিজেই উদ্ধার অভিযানের তদারকি করছেন৷ মাওয়া ঘাটে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি৷ দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে দুটি তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে৷

পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজে ওই এলাকায় থাকা সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্ট ইউনিটের সদস্য, নৌবাহিনীর ডুবুরি দল, কোস্ট গার্ড, র্যাবের হেলিকপ্টার, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঘটনাস্থলে তৈরি থাকলেও উদ্ধারকারী জাহাজ না পৌঁছানোয় তল্লাশি ও উদ্ধার অভিযান গতি পাচ্ছে না৷মন্ত্রী জানান, দুর্ঘটনার খবর পেয়েই উদ্ধারকারী জাহাজ এমভি রুস্তম ও প্রত্যয়কে ঘটনাস্থলে আসতে বলা হয়৷ আসার পথে রুস্তম প্রবল ঘূর্ণি স্রোতে পড়ায় দেরি হওয়ার আশঙ্কায় নারায়ণগঞ্জ থেকে তলব করা হয় আরেক উদ্ধারকারী জাহাজ এমভি নির্ভিককে৷

ডুবে যাওয়া লঞ্চ থেকে উদ্ধার পাওয়া মিমজাল ইসলাম নামের এক যাত্রী মাওয়া ঘাটে বলেন, মাওয়ার কাছাকাছি এসে লঞ্চটি হঠাত্‍ করে কাত হতে যায় এবং অল্প সময়ের মধ্যে সেটি ডুবে যায়৷ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহনের কারণেই লঞ্চটি ডুবে গেছে বলে উদ্ধার পাওয়া আরেক যাত্রী বলেন৷

লঞ্চডুবির সময় পাশ দিয়ে যাওয়া একটি ফেরি থেকে মোবাইল ফোনে এক ব্যক্তি একটি ভিডিও ধারণ করেন, যা পরে গণমাধ্যমকর্মীদের হাতে আসে৷ওই ভিডিওতে দেখা যায়, মাঝারি আকৃতির দ্বিতল লঞ্চটি এক দিকে কাত হয়ে যায় এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে প্রবল ঢেউয়ের মধ্যে তলিয়ে যায়৷

এদিকে দুর্ঘটনার খবর পেয়েই মাওয়া ও কাওড়াকান্দি ঘাটে ভিড় করেন পিনাক-৬ লঞ্চের যাত্রীদের স্বজনেরা৷ তাদের কান্নায় পদ্মার তীরে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে৷দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্ত ও নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় দুটি তদন্ত কমিটি করেছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল হাসান৷

তিনি জানান, সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের চার সদস্যের তদন্ত কমিটির নেতৃত্বে আছেন সংস্থার প্রকৌশলী (শিপ সার্ভেয়ার) নাজমুল হক৷ আর নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাত সদস্যের কমিটির প্রধান করা হয়েছে যুগ্ম সচিব নুরুর রহমানকে৷

লঞ্চ ডুবির ঘটনায় প্রত্যেক নিহতের জন্য তাদের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়৷ সোমবার লঞ্চডুবির ঘটনায় গঠিত মুন্সীগঞ্জে পুলিশের অস্থায়ী ক্যাম্প থেকে লৌহজং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তোফাজ্জল হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেন৷

তিনি বলেন,এখন পর্যন্ত যে দুইজনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে তাদের মধ্যে এক জনের পরিচয় পাওয়া গেছে৷ তার পরিবারের কাছে লাশ ও নগদ ২০ হাজার টাকা হস্তান্তর করা হয়েছে৷ এখন পর্যন্ত ৮৭ জন নিখোঁজের তালিকা তারা হাতে পেয়েছেন বলেও জানান ওসি৷

এর আগে গত ৩১ জুলাই সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলায় যমুনা নদীতে নৌকাডুবে আট জনের মৃতু্য হয়৷ তার দুই দিন আগেই কুষ্টিয়ার পদ্মা নদীতে নৌভ্রমণে গিয়ে দুর্ঘটনায় প্রাণ যায় ১১ জনের৷এছাড়া গত ১৫ মে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার দৌলতপুরের কাছে মেঘনা নদীতে ঝড়ের কবলে পড়ে এমভি মিরাজ-৪ নামে একটি লঞ্চ ডুবে যায়৷ ওই ঘটনায় নদী থেকে মোট ৫৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়৷

সকাল সোয়া ১১টার দিকে মাওয়া-কাওড়াকান্দি নৌরুটের মাওয়া ঘাটের কাছে পদ্মা নদীতে লঞ্চডুবির ঘটনায় বেঁচে গেছেন বিউটি বেগম নামে এক নারী৷ কিন্তু এখনো নিখোঁজ রয়েছে তার ৮ম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে মীম (১৩)৷তাকে ফিরে পাওয়া না পাওয়ার আশা-নিরাশায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন বিউটি৷ঈদ শেষে ফরিদপুর থেকে ঢাকার ডেমরা এলাকার কোনাপাড়ায় যাচ্ছিলেন তারা৷বিউটির মতো নিখোঁজ অনেক যাত্রীর স্বজনদের আহাজারিতে পদ্মা পাড়ের আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে৷

বিউটি বেগমের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি আমার মারে (মীম) বাঁচাইতে পারলা না, কথা কইয়া কি অইবো বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন৷

লঞ্চ থেকে বেঁচে যাওয়া আরেক যাত্রী শওকত হোসেন বলেন, স্ত্রী শেফালী, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে ফরিদপুর থেকে মুন্সীগঞ্জের তন্তর গ্রামে বেড়াতে যাচ্ছিলাম৷ মাওয়া ঘাটের কাছে এসে লঞ্চটি ডুবে গেলে ভাগ্যক্রমে স্ত্রী সন্তানসহ পরিবারের ছয় সদস্য সাঁতরে তীরে উঠতে পেরেছি৷মাদারীপুরের ঘুরাইল খালিশীকান্দি এলাকার রাশিদা বেগম জানান, বাবার বাড়িতে ঈদ করে ঢাকা ফেরার পথে এ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে তার পরিবার৷ তার চার ছেলেমেয়ের মধ্যে দুই মেয়ে ইমা (১৮) ও আফরোজা (১৬) নিখোঁজ রয়েছে৷ তারা দুইজনই মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী৷

আনু বেগম জানা, স্বামী রবিউলের সঙ্গে তিনি ঢাকায় আসছিলেন৷ লঞ্চ ডুবির পর তিনি সাঁতরে তীরে আসতে পারলেও তার স্বামীকে খুঁজে পাচ্ছেন না৷কামরুল জানান, স্ত্রী তাসলিমা বেগমকে নিয়ে ঢাকায় আসছিলেন৷ কিন্তু তিনি সাঁতরে তীরে এলেও স্ত্রীকে খুঁজে পাচ্ছেন না৷

এদিকে,লঞ্চ ডুবির খবর পেয়ে নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান, এবং বিআইডবি্লউটিসি ও বিআইডবি্লউটিএ-এর ঊধর্্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে রয়েছেন৷সেনা বাহিনী, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দলের সদস্যসহ বিভিন্ন দফতরের লোকজন উদ্ধার কাজে অংশ নিয়েছেন৷ পদ্মায় লঞ্চটি ডোবার এক ঘন্টার মধ্যেই নৌবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে সড়ক পথে ডুবুরি দলটি ঘটনাস্থলে পৌঁছে কাজ শুরু করে৷

নৌবাহিনীর পরিচালক(গোয়েন্দা) কমোডর এম রাশেদ আলী বলেন, নৌবাহিনীর অত্যাধুনিক সাইট স্কানার সোনার সরঞ্জাম দিয়েই লঞ্চ শনাক্ত করণের কাজ চলছে৷ এই মুহূর্তে ১২ জন ডুবুরি দল কাজ করলেও প্রয়োজনে এই সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে৷ তিনি আরো জানান, অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের উদ্ধারকারী জাহাজই লঞ্চ উদ্ধারে প্রধানত কাজ করবে৷ এই জাহাজকে সব ধরনের কারিগরি সহায়তা দিতে ২৪ ঘন্টাই সক্রিয় থাকবে নৌবাহিনী৷ এজন্য নৌবাহিনীর আলাদা কোনো জাহাজ থাকবে না৷