দৈনিক বার্তা-ঢাকা,১আগষ্ট : ঈদের পর বিএনপি কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে৷ বিএনপি’র নেতারা বলছেন,এবার অন্যরকম আন্দোলন হবে৷আন্দোলনের রূপরেখা কি হবে তা খোলসা না করলেও নেতারাবলছেন, আন্দোলন পর্যায়ক্রমে তীব্র থেকে তীব্রতর হবে৷তবে আওয়ামীলীগ নেতারা আন্দোলনের বিষয়টিকে পাত্তাই দিচ্ছেন না৷ তারা বলছেন,দলের নেতা-কর্মীদের চাঙা করতে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার এটি একটি কৌশল মাত্র৷ ঈদের দিন দুই নেত্রীর শুভেচ্ছা বিনিময়ের পাশাপাশি দুই দলের মধ্যে কয়েক দফা হুমকিও বিনিময় হয়েছে৷ বিএনপির চেয়ারপারসন ঈদের পর কঠোর আন্দোলন হবে বলে আগাম ঘোষণা দিয়ে সৌদি আরব গিয়েছিলেন ওমরাহ পালন করতে৷ সেখানে সাড়ে চার বছর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা হয়, যিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানও বটে৷ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে,দলের নেতারাও অনেকেই নাকি জানেন না রাজনীতি নিয়ে তাঁদের মধ্যে কী কথা হয়েছে৷
বিএনপির আন্দোলনের হুমকির জবাবে আওয়ামী লীগের নেতারাও পাল্টা রণহুংকার ছেড়েছেন৷ কেউ বলছেন, যত গর্জে তত বর্ষে না৷ বিএনপি পাঁচ বছরে কিছু করতে পারেনি, এখনো পারবে না৷ কেউ বলছেন, বিএনপিকে মাঠেই নামতে দেওয়া হবে না৷দেশের মানুষ কঠোর আন্দোলনের কথা শুনলেই শঙ্কিত হয়৷ ২০১৩ সালটি জুড়ে তারা কঠোর আন্দোলনের স্বরূপ দেখেছে৷ কঠোর আন্দোলন মানে হরতাল-অবরোধ৷ আন্দোলন মানে বাসে- ট্রেনে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা৷ বোমা-ককটেল মেরে মানুষ হত্যা৷
অন্যদিকে আন্দোলন দমনের নামে চলে পুলিশ-র্যাবের ঝটিকা অভিযান৷ব্যাপক ধরপাকড়৷ রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন৷একটি বোমাবাজকে বমাল ধরতে না পারলেও হাজার হাজার মানুষকে আসামি করে মামলা দায়ের৷ গ্রেপ্তার বাণিজ্য৷প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপির সঙ্গে আলোচনার আহ্বান নাকচ করেন দিয়ে বলেছেন, মাঠেই দেখা যাবে, দেখা যাক কে কতটি গোল দিতে পারে৷ সমপ্রতি বিশ্বকাপে ব্রাজিলের সাত গোল খাওয়ার কথাটি মনে রেখেই সম্ভবত শেখ হাসিনা তাঁর প্রতিপক্ষের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন৷
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য দেওয়ার এক ঘন্টার মধ্যে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সাংবাদিকদের ডেকে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি তুমুল যুদ্ধের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন৷ অবশ্য মঙ্গলবার দেশের কূটনীতিক, বিশিষ্ট নাগরিক ও দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবিলম্বে দেশে জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানান৷ হিংসা বিদ্বেষ ভুলে দেশের জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে সবাইকে একত্রে কাজ করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া৷
মঙ্গলবার সারাদেশে পবিত্র ঈদ পালন হয়ে গেছে এখন রয়েছে সারা দেশে ঈদের আনন্দ৷ কিন্তু ঈদের সেই আনন্দ কি বিএনপির আন্দোলনের হুমকির কারণে ঈদের পরের দিনগুলোতে আতঙ্কে পরিণত হতে যাচ্ছে? পুরোনো অভিজ্ঞতা আর বিএনপি নেতাদের বক্তব্য অথবা হুমকি-ধমকি শুনে তো আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হচ্ছে৷ ঈদের পরে আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নেতাকর্মীদের তৈরি হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন৷ এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, সময় আসবে, তৈরি হন৷ সবাই বলছে আন্দোলন, আন্দোলন, আন্দোলন৷ আন্দোলনের কর্মসূচি দেব৷অবশ্য তিনি আশ্বস্ত করেছেন, ঈদের পরে বিএনপির আন্দোলন হবে শান্তিপূর্ণ৷ কিন্তু বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের হুমকি শুনে যেকোনো দুর্বল চিত্তের মানুষের বুকে কাঁপন ধরাই স্বাভাবিক৷ তিনি একধাপ এগিয়ে কঠোর ভাষায় বলেছেন, গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে কী আন্দোলন দেখেছেন? ঈদের পর আন্দোলন হবে উত্তাল, তাতে আপনারা (ক্ষমতাসীন সরকার) ভেসে যাবেন৷
এদিকে, স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, বিএনপি’র গত ৫ জানুয়ারির আগের মতো আন্দোলনের নামে যাত্রীবাহী বাসে আগুন দিলে ও কোনো ধরণের নৈরজ্য সৃষ্টি করার চেষ্টা করলে জনগণের যানমাল রক্ষায় যা যা করা দরকার সরকার সবই করবে৷ তিনি বলেন, আগস্ট মাসের এক তারিখ থেকে পুরো দেশবাসী শোকের মাস হিসেবে পালন করবে৷ আর এই শোকের মাসে বিএনপি আন্দোলন করার কথা বলেছে৷ বিএনপি’র নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন করলে সরকারের কোনো আপত্তি নেই উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী বলেন, আন্দোলনের নামে দেশবাসীর যানমালের কোনো ক্ষতি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷
সূত্র জানায়, লন্ডনে বসে তারেক রহমান সরাসরি আন্দোলনের নেতৃত্বে দেবেন৷ সৌদি আরবে এ বিষয়ে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মধ্যে কথা হয়েছে৷ এরই মধ্যে তৃণমূল নেতাদের কাছে তারেক রহমানের ঈদ শুভেচ্ছা ও চিঠি দিয়ে নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে৷ সৌদি আরবে ওমরাহ পালনের পাশাপাশি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে সাংগঠনিক নানা বিষয় আলোচনা হয়েছে৷ঢাকা মহানগর কমিটি, সামপ্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সাংগঠনিক অবস্থা, আগামী দিনের আন্দোলন নিয়ে দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে আলোচনা হয়েছে৷
সূত্র জানিয়েছে,সৌদি আরব যাওয়ার পর বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা,মা-ছেলের মধ্যে একান্তে একাধিকবার আলোচনা হয়েছে৷ তবে ঠিক কী সিদ্ধান্ত হয়েছে বা সুনির্দিষ্ট কী আলোচনা হয়েছে তাঁদের সঙ্গে সফরে থাকা ব্যক্তি, কর্মকর্তাদের সবাই নিশ্চিত নন৷ সৌদি আরব সফরে খালেদা জিয়ার সঙ্গে থাকা একজন বলেন, ওমরাহ পালনের লক্ষ্যে সৌদি আরব সফরে ধর্মীয় ও পারিবারিক বিষয় মূল ছিল৷ তারেক রহমান বেশি সময় কাটিয়েছেন মসজিদে৷ তবে কিছু রাজনৈতিক আলোচনাও তাঁদের দুজনের মধ্যে হয়েছে৷ এর বাইরে খাওয়ার টেবিলে অনেক সময় রাজনৈতিক আলোচনা হয়েছে৷
খালেদা জিয়ার সফরে থাকা ওই ব্যক্তি বলেন, এমন একটি আলোচনার সময় তিনিও খাওয়ার টেবিলে ছিলেন৷ তখন ঢাকা মহানগর কমিটি নিয়ে আলোচনা ওঠে৷ এ সময় তারেক রহমান বলেন, নতুন কমিটি কি আসলে কিছু করতে পারবে? আন্দোলন, সংগ্রাম কতটুকু সফল করতে পারবে? এক মাসের মধ্যে কি সম্মেলন করা সম্ভব?
সৌদি আরব পৌঁছানোর পর প্রথম দুই দিনে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মধ্যে একাধিকবার একান্ত কিছু আলোচনা হয়েছে৷ উপস্থিত না থাকলেও এসব বৈঠকে সহায়তা করেছে এমন একটি সূত্র জানিয়েছে, তাঁদের মধ্যে আগামী দিনের আন্দোলনের কৌশল ও রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হয়েছে৷ ঈদের পর এ নিয়ে স্থায়ী কমিটি ও জোটের সভায় এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হবে৷ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ঈদের পর কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন৷ কিন্তু সরকার পতনের আন্দোলনের জন্য যে সাংগঠনিক শক্তির প্রয়োজন তা এই মুহূর্তে নেই বলে মনে করছেন অনেকে৷ আন্দোলনে নামার আগে দল পুনর্গঠনের বিকল্প নেই বলে মনে করেন তারা৷ কিন্তু এখনো পর্যন্ত দল পুনর্গঠনের কাজে এগোতে পারেনি বিএনপি৷
তবে দলীয় সূত্র জানায়, এবার নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী দিনে আন্দোলন গড়ে তুলতে দল গোছানোর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া৷ যার ধারাবাহিকতায় সমপ্রতি দলের বেশ কিছু সাংগঠনিক জেলা কমিটির মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে দিয়ে সেখানে আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে৷ আর সেই আহ্বায়ক কমিটিকে পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে রূপান্তরিত করতে ৪৫ দিনের সময় বেঁধে দেওয়া হয়৷
আন্দোলন প্রসঙ্গে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন প্রভাবশালী নেতা বলেন,দলের চেয়ারপারসনের উচিত হবে দলের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দূর করে হারানো চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনা৷ এরপর যতদ্রুত সম্ভব দলের মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটিগুলো পুনর্গঠন করা৷ আর তাতেই ফিরে আসতে পারে দলের নেতাকর্মীদের হারানো মনোবল৷তিনি বলেন, ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) যদি দল গোছানোর সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেন তবে তা দলের জন্য খারাপ হবে৷ আর এর প্রভাব পড়বে আগামী দিনে সরকার পতন আন্দোলনে৷ কেননা আগের আন্দোলন ছিল একটি সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করা৷ কিন্তু এখন আন্দোলন করতে হবে একটি ক্ষমতাসীন দলকে ( যেভাবেই হউক ক্ষমতায় রয়েছে) ক্ষমতা থেকে সরিয়ে নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায় করা৷
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু বলেন, আন্দোলনের মাধ্যমে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবি আদায় করতে হলে দলকে সুসংগঠিত করার বিকল্প নেই৷ আর এ জন্য রাজধানীসহ সারা দেশে সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করে তুলতে হবে৷ সে ক্ষেত্রে যারা সাংগঠনিকভাবে দক্ষ ও যোগ্য তাদেরই দায়িত্ব দিতে হবে৷ অন্যথায় আন্দোলন শুধু মুখে মুখেই থেকে যাবে৷
তিনি বলেন,দল পুনর্গঠনের বিষয়ে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া অভ্যন্তরীণভাবে স্থায়ী কমিটির একেক জনের সঙ্গে ওয়ান টু ওয়ান কথা বলেছেন৷ তাই আমরা প্রত্যাশা করছি রমজান ঈদের মধ্যে কিংবা তার পরপরেই একটি আশাতীত ফলাফল দেখতে পাবো৷
দলটির বেশির ভাগ নেতাকর্মীর মতে, অচিরেই দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিকেও সংস্কার করতে হবে৷ কেননা নির্বাহী কমিটিতে এমন অনেকেই রয়েছেন যারা কেবল আন্দোলন সংগ্রাম নয়, রাজনীতি থেকেই নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখে ব্যবসায়িক কাজে ব্যস্ত রেখেছেন৷বিএনপির দফতর সূত্রে জানা যায়, দলের অনেক নেতাই মনে করেন আগামী দিনের আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালনায় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের পাশাপাশি দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে আন্দোলন সফল করতে মনোনিবেশ করতে হবে৷
তবে তারেক রহমানের দেশে ফিরে আসা নিয়ে নেতাকর্মীদের ভিন্ন মত রয়েছে ৷নাম প্রকাশ না করার শর্তে চেয়ারপারসনের একজন উপদেষ্টা বলেন, এই মুহূর্তে তারেক রহমানের দেশে ফিরে আসাটা সময়োপযোগী হবে না৷
তিনি বলেন, যদিও রাজনীতিতে মামলা,গ্রেফতার, জেল-নির্যাতনে কারো কারো ইমেজও বাড়াতে পারে৷ কিন্তু আওয়ামী সরকারের মতো দানব সরকার হয়তো তারেক রহমানের প্রাণনাশ করতে পারে৷
তবে শীর্ষ পর্যায়ের এই নেতা একথাও বলেন, তারেক রহমান দেশে ফিরে দায়িত্ব গ্রহণের পর দিন থেকেই সারা দেশে বিএনপি আশাতীত চাঙ্গা হয়ে উঠবে৷এদিকে নেত্রকোনা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির প্রভাবশালী এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে যেমন আন্দোলন প্রয়োজন, তেমনি আন্দোলন সফল করতে হলে সাংগঠনিক পুনর্গঠনও প্রয়োজন৷
তিনি বলেন, দল পুনর্গঠনের আগে আন্দোলনে নামলে তা সফল হবে না৷ অথচ আহ্বায়ক কমিটির মেয়াদ প্রায় শেষ হতে চললেও তা পুনগর্ঠনের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না৷তিনি আরো বলেন, দলের এ অবস্থার পরিবর্তন ও দলকে সারা দেশে চাঙ্গা করতে হলে আর সময় নষ্ট না করে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় দক্ষ, যোগ্য ও সক্রিয় লোকদের নিয়োগ দিতে হবে৷
এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া রোজার ঈদের পর কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন৷ যার মূল উদ্দেশ্য হলো আগামী জানুয়ারির মধ্যে মধ্যবর্তী নির্বাচনের টার্গেটে সফল হওয়া৷
কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, এখনো আন্দোলনের মতো উপযোগী করে দলগোছানো দূরের কথা, আন্দোলনের মূল জায়গা ঢাকা মহানগরীতেই কমিটি পুনর্গঠন করা সম্ভব হয়নি৷ যদিও দলের প্রভাবশালী নেতা সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা বাদ দিয়ে আরেক বষর্ীয়ান নেতা মির্জা আব্বাসকে আহবায়ক করে ৫১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে৷
বিএনপিপন্থী রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, সামনে আরো কঠিন বিপদে পড়তে যাচ্ছে বিএনপি ও এর প্রধান বেগম খালেদা জিয়া৷ঈদের পর আন্দোলনের কথা বললেও পুলিশের অনুমতি ছাড়া ঢাকার রাজপথে নামার কোনো সম্ভাবনা নেই বিএনপি নেতাকর্মীদের৷ সে ধরনের কোনো প্রস্তুতি, সাহস কিংবা দক্ষ নেতৃত্বও নেই বিএনপিতে৷
তাদের মতে, দুর্নীতির মামলাগুলোর প্রক্রিয়া চলছে নির্ধারিত গতিতে৷যেগুলোর ভবিষ্যত্ সম্পর্কে সহজেই আঁচ করতে পারছেন অনেক নেতাকর্মী৷ কিন্তু তাদের তেমন কিছু করার নেই৷ অধিকাংশই নেতাই দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার আস্থাহীনতায় কোণঠাসা হয়ে আছেন৷এখন দেখার বিষয় ক্ষমতাসীনদের শত প্রতিকূলতা দূর করে বিএনপি দল গুছিয়ে কীভাবে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছায়?
যদিও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন প্রতিহত করতে গেল বছর ২৪ ডিসেম্বর মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচির ঘোষণা দেন জোট প্রধান বেগম খালেদা জিয়া৷এ ঘোষণার পরপরই অবরুদ্ধ হন তিনি৷ এ দাবিতে দল ও সর্বস্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করতে তত্কালীন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া জোটের প্রথম সারির নেতাদের পাশে পেলেও আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে গা ঢাকা দিয়েছিলেন অনেকেই৷
সামপ্রতিক সময়ে জাতীয় প্রেসক্লাবকেন্দ্রিক ছোটখাটো সভা-সমাবেশ আর সেমিনারে আটকে ছিল বিএনপির কার্যক্রম৷ রমজান উপলক্ষে সাংগঠনিক কার্যক্রমের পরিধি বেড়ে ইফতার পার্টি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে৷ এর বাইরে টেলিভিশনের সামনে কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার বক্তৃতা-বিবৃতি ছাড়া দলটির দৃশ্যমান আর কোনো তত্পরতা নেই৷আবার সাংগঠনিকভাবেও বিএনপি গোছানো আছে বলা যাবে না৷ মূল দল ও অঙ্গ, সহযোগী সংগঠনের কমিটিগুলো পুনর্গঠনের ঘোষণা দিলেও কাজ এগোয়নি৷ এতে আটকে গেছে দল গোছানোর প্রক্রিয়াও৷
দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়,৫জানুয়ারির নির্বাচনের পর দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের বৈঠকে দল পুনর্গঠন এবং শুরুতে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচিতে না গিয়ে জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি দেওয়ার পক্ষে মত দেওয়া হয়৷ কিন্তু গত ছয় মাসে তেমন কোনো কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে পারেনি দলটি৷ গত মে মাসে গুম-খুনের প্রতিবাদে কিছু কর্মসূচি পালন করেছে দলটি৷
তবে কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা এসেছে, এ কথা মানতে রাজি নন দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর৷ তিনি বলেন, বিএনপিতে স্থবিরতা এসেছে, তা কিছুতেই বলা যাবে না৷ কিছুদিন আগে জয়পুরহাটে বিএনপি চেয়ারপারসন সমাবেশে করেছেন৷এরপর ফেনীতে কর্মসূচি হয়েছে৷ রমজান মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত ইফতারের মাধ্যমে সামাজিক কর্মসূচিতে ছিল বিএনপি৷ এর মাধ্যমে সারা দেশে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডও চলবে৷
গত জুন মাসে মাঠে বিএনপির কোনো কর্মসূচি ছিল না বললেই চলে৷ তবে এ সময়ে জাতীয় প্রেসক্লাবে অন্তত ১৭টি আলোচনা বা প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনসহ আরও কিছু ‘নামসর্বস্ব’ সংগঠন৷ এসব অনুষ্ঠানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বা দলের স্থায়ী কমিটির কোনো না কোনো সদস্য বক্তব্য দিয়েছেন৷ জনগণকে সম্পৃক্ত করে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে আন্দোলন শুরু করা হবে এবং সে আন্দোলনে ঢাকা মহানগর বিএনপিকে সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর৷
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এখন যারা ক্ষমতা দখল করে আছে তারা অনৈতিক ও অবৈধ সরকারে পরিণত হয়েছে৷ তারা যে নির্বাচন দেখিয়েছে তা সাধারণ জনগণ ও গণতান্ত্রিক বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি৷তাই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেথেকেই আমরা আন্দোলনের কথা বলে আসছিলাম৷ আমাদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তারাও সে সময় বলেছিল,এটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নির্বাচন৷ দ্রুতই আরেকটি নির্বাচন দেবে৷কিন্তু এখন সে কথা তারা বলছে না৷ বরং বলছে আগামী পাঁচ বছর তারা দেশ শাসন করবে৷ এ ধরনের কথাবার্তা বলে তারা (সরকার) মূলত দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে৷ এ অবস্থায় জনগণের সামনে আন্দোলন ছাড়া আর কোনো পথ নেই-বলেন ফখরুল৷ঈদের পর বিএনপির আন্দোলন সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, মানুষ পিছনে থাকলে আন্দোলন হয়, না থাকলে আন্দোলন হয় না৷
মুহিত বলেন,বর্তমান আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষেই আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব নয়৷ মানুষ থাকলেই আন্দোলন হয়, না থাকলে কোনো আন্দোলন হয় না৷
বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়ে মুহিত বলেন, এখন মানুষ ও স্টেক হোল্ডারের সংখ্যা এত বেড়েছে যে, সবাই এখন কর্মব্যস্ত৷ স্টেক হোল্ডাররা এখন নিজেদের স্বার্থেই কোনো আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন দেবে না৷
খালেদা জিয়া ঈদের পর সরকার পতন আন্দোলনের যে ডাক দিয়েছে তা যদি অতীতের মত সহিংস রুপ নেয় তাহলে সরকার তা কঠোর হস্তে দমন করবে বলে মন্তব্য করেছেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের৷
সব নেতাকর্মী জেলে গেলেও ২০ দলের আন্দোলন থামবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগর বিএনপির নবনির্বাচিত আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস৷তিনি আরও বলেন, অনেক কথাই বলা হবে৷ আন্দোলনে বাধা দেওয়ার কথা বলা হবে, নেতাকর্মীদের জেলে ভরা হবে৷ কিন্তু সব নেতাকর্মী জেলে গেলেও আন্দোলন থেমে থাকবে না৷আব্বাস বলেন, সরকার যদি আন্দোলনে বাধা দেয় তাহলে জবাব জনগণই দেবে৷ আর সেই জবাব তারা কীভাবে দেবে তা আমরা জানি না৷এই আন্দোলনে সরকার সমর্থন ও সম্মান দেখাবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি৷
এ বিষয়ে বিএনপি’র চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও নগর বিএনপির সভাপতি আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, জনগন রাষ্ট্রিয় সন্ত্রাস থেকে মুক্তি চায়৷মানুষের মনের মধ্যে যে ক্ষোভ, যন্ত্রণা আছে তার বহি:প্রকাশ ঘটবে৷ এবার হবে অন্যরকম আন্দোলন৷ আন্দোলনের কোনও রূপরেখা বা আলটিমেটাম আছে কি না এরকম প্রশ্নে আমির খসরু বলেন, পর্যায়ক্রমে আন্দোলন তীব্র হবে৷ রাষ্ট্রিয় সন্ত্রাসীরা আর রেহাই পাবে না৷ তাদের সহযোগীদেরও আইনের আওতায় এনে বিচার করা হবে৷দেশের জনগন আর সময় দেবে না৷
আপনারা আন্দোলনে ব্যর্থ বলে মনে করেন অনেকে, এরকম প্রশ্নে আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, কে বলেছে আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে৷ বিএনপি আন্দোলনে সফল৷ সরকারের প্রহসনের নির্বাচনে দেশের আপামর জনগন অংশ নেয়নি৷ জনগন প্রমাণ দিয়েছে তারা বিএনপির সঙ্গে আছে৷ তিনি যোগ করে বলেন, এখন যে সরকার দেখছেন তা তো রাষ্ট্রিয় সন্ত্রাসীদের ক্ষমতা দখল৷ এটি কোনও বৈধ সরকার নয়৷
এদিকে বিএনপির আন্দোলনের হুমকিকে পাত্তাই দিচ্ছেন না আওয়ামীলীগ নেতারা৷ তারা বলছেন, যে কোনও দলের নিয়ম তান্ত্রিকভাবে আন্দোলন করার অধিকার রয়েছে৷ কিন্তু আন্দোলনের নামে জ্বালাও পোড়াও ধ্বংসাত্বক কর্মকান্ড চালালে তা কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে৷এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামীলীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, বিএনপির আন্দোলনের কোনও লক্ষন দেখা যাচ্ছে না৷ তাদের আন্দোলনের সঙ্গে জনগনকে সম্পৃক্ত করতে পারবে না৷ তারা অতীতেও ব্যর্থ হয়েছে, আগামীতেও ব্যর্থ হবে৷ আন্দোলনের নামে কোনও ধ্বংসাত্বক কর্মকান্ড ঘটালে আমরাও ঘরে বসে থাকবো না, কঠোরভাবে এর জবাব দেয়া হবে৷ জনগনের জান-মাল রক্ষার দায়িত্ব এ সরকারের রয়েছে৷ জনগনের ক্ষতি হয় এমন কোনও কাজ আমরা করতে দেবো না৷ যোগ করেন তিনি৷
আগামী সপ্তাহে স্থায়ী কমিটি ও বিশ দলীয় জোটের বৈঠকের পর আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে বিএনপি৷ আপাতত সভা,সমাবেশ ও গণসংযোগেই সীমাবদ্ধ থাকার আভাস দিলেও আন্দোলনের পথে সরকারই বড় বাধা বলে মনে করেন দলটির নেতারা৷
পুরো রমজান জুড়ে বিভিন্ন ইফতার মাহফিল ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ঈদের পর কঠোর আন্দোলনের কথা বলেছেন বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও দলটির সিনিয়র নেতারা৷রোজা ও ঈদ পেরিয়ে এবার সে কর্মসূচি দেয়ার পালা৷বার বার কঠোর আন্দোলনের হুশিয়ারী দিলেও নেতাদের অনেকে এখন বলছেন ধীরে চলো নীতির কথা৷ কর্মসূচির আকৃতি বা ধরন যাই হোক আগামী সপ্তাহে তা ঘোষণা করা হবে বলেও জানান তারা৷
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, সভা-সমাবেশ ও গণসংযোগ হবে৷ সহযোগী সংগঠনের সঙ্গে মতবিনিময় করে কর্মসূচি প্রদান করা হবে৷আন্দোলনকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিতে চায় বিএনপি৷ তবে এ ক্ষেত্রে সরকারের নিয়ন্ত্রিত বাহিনীকেই বড় বাধা বলে মনে করেন তারা৷
আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীকে ওয়েলকাম জানাই৷ তিনি মাঠে আসছেন৷খেলতে চান৷তবে কথা হচ্ছে প্রশাসনকে বাইরে রেখে আসেন৷ আগামী সপ্তাহ থেকেই ধারাবাহিক কর্মসূচি শুরু হবে৷তারা এও বলছেন,আন্দোলন ইসু্যতে কৌশল যাই হোক না কেন, সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচন ইস্যুতে মতপার্থক্য কমিয়ে আনাকে গুরুত্ব দেবে বিএনপি৷
বিএনপি’র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেছেন, ঈদের পরে কর্মসূচির অংশ হিসেবে কয়েকদিনের মধ্যে বিএনপি’র নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোট আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে৷ এই কর্মসূচিগুলো হবে গণতন্ত্র স্বীকৃত এবং আইন সঙ্গত৷ সংবিধান স্বীকৃত হচ্ছে-সমাবেশের অধিকার, কথা বলার অধিকার৷ কিন্তু ক্রমাগতভাবে কন্ঠরোধ করে চলেছে এই সরকার এবং গণতন্ত্রে বিরোধী দলের যে অধিকার সেটিকে তারা ভয়াবহভাবে দমন করেছেন, বিরোধী দলের অধিকার হরণ করেছেন৷তিনি বলেন, আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচির উপর গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা করেছে সরকার৷ এখন সরকারের আচরণের উপর নির্ভর করবে এই আন্দোলনের পরবর্তী রূপ কি রকম হবে এবং কতটুকু তীব্র থেকে তীব্রতর হবে৷