দৈনিক বার্তা , ঢাকা ২৬ জুলাই : রাজধানীতে দামি গাড়ি-বাড়ি, সুসজ্জিত অফিস, হাতে দামি মোবাইল সেট এবং বিভিন্ন ভাষায় শুদ্ধভাবে কথা বলতে দারুন পারদর্শী মানুষগুলো। দেশে এবং দেশের বাইরে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। কাজের চাপে সারাদিনে কারো সঙ্গে কথা বলার কোনো ফুসরত মিলে না। যদি কারো জন্য একটু সহানুভূতি তৈরি হয় তাহলে কথা বলতে পারেন। তবে আর যার সঙ্গে এই সহানুভূতির পরিচয় দেবে সুদর্শন মানুষগুলো, তার সর্বোচ্চ হাতিয়ে নেবে। এই সুদর্শন মানুষগুলো রয়্যাল চিট ডিপার্টমেন্টের (আরসিডি) সদস্য। এদের কাজেই হলো নিজেদের বড় ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে দেশের উদীয়মান ব্যবসায়ীদের নিঃস্ব করা।ঢাকা মহানগর গোয়েন্দার (ডিবি) একটি সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে। রাজধানীতে আরসিডি কমপক্ষে ১৫টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে কাজ করছে। পুলিশ, সাবেক জেলা জজ, রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার সহাস্রাধিক মানুষ এদের হাতে প্রতারিত হয়েছেন।
গোয়েন্দা সূত্রটি জানায়, প্রথমে চক্রটি রাজধানীর অভিজাত একটি এলাকা নির্বাচন করে। সেখানে একটি অফিস ভাড়া নেয়। অফিস ভাড়া নেওয়ার সময় বাড়িওয়ালার সঙ্গে প্রথমেই তারা জালিয়াতির আশ্রয় নেয়। দক্ষতার সঙ্গে বাড়িওয়ালাকে হাত করে কোনো প্রকার অগ্রিম ও জামানত ছাড়াই বড় অফিস ভাড়া নেয়। বাড়িওয়ালাকে কিছু টাকা দিয়ে উঠেপড়ে বাড়িতে। বাড়ি ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রে নিরীহ এবং সম্ভ্রান্ত বাড়িওয়ালাদের নিরিবিলি বাড়ি বেছে নেয় তারা। যারা কোনো ঝামেলা করতে পারবে না। এসময় বিদেশি ভাষায় কথা বলতে পারদর্শী একজন আরসিডি সদস্য থাকেন। যিনি নিজেকে ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানি এবং অন্যকোনো রাষ্ট্রের নাগরিক বলে দাবি করেন। বাড়িওয়ালাকে তিনি বুঝান বাংলাদেশ এবং ইন্ডিয়ান যৌথ মালিকানায় একটি অফিস হবে। আমাদের ব্যাংক হিসাব খোলা হয়নি। তিনি বিদেশি নাগরিক হওয়ায় যৌথ ব্যাংক হিসাব খুলতে একটু সমস্যা হচ্ছে। আমাদের বসার জায়গা নেই। বাসাটা আমাদের দরকার। অফিস শুরু করতে পারলেই টাকা পাওয়া যাবে। এসব বলে বাড়িওয়ালাকে কিছু টাকা দিয়ে দ্রুত বাড়িতে উঠে পড়ে। এরপর আধুনিকতার ছোয়ায় অফিস ডেকরেশন করা হয়।
সূত্রটি আরো জানায়, অফিস ডেকরেশনের সঙ্গে সঙ্গে চক্রটির মাঠ পর্যায়ের সদস্যরা ক্লায়েন্ট বা মক্কেল ধরতে শুরু করে। প্রতারণার ফাঁদে ফেলতে উদীয়মান ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে। যাদের টাকা আছে এবং ব্যবসা করতে চায় কিন্তু কি ব্যবসা করবে তা বুঝতে পারছেন না। তাদেরকে টার্গেট করে পটিয়ে চাকচিক্য অফিসে নিয়ে আসে। অফিসে আনার পর তাদের বিভিন্ন ব্যবসার কথা বলা হয়। এসময় দু’জন প্রতারক বিদেশি সাজে। অফিসে তাদের সঙ্গে কয়েক দফা কথা হয়। কোনো কোনো ক্লায়েন্টকে ফাইভ স্টার হোটেলে আসতে বলে। সেখানে পার্টিতে তাদের সঙ্গে কথা হয়। সেখানে প্রতারকদের খরচে ক্লায়েন্টের থাকার ব্যবস্থাও করা হয়। এরপর তাদের অফিস দেখানো হয়।
এই চক্রটি সাধারণত আমদানি-রফতানি নির্ভর বড় ব্যবসার কথা বলে প্রতারণা করে থাকে। আলু, সবজি, মাছসহ দেশ থেকে বিভিন্ন পণ্য রফতানি করা হবে বলে প্রথমে টোপ দেয়। এরপর বিদেশি সাজিয়ে এক প্রতারকের সঙ্গে কথা বলানো হয় মক্কেলকে। যিনি বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি করবে। এরপর পণ্য ক্রয়ের জন্য মক্কেলের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়। এরকম কয়েক দফায় পণ্য ক্রয়ের কথা বলে একাধিক লোকের কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। আবার কাউকে স্বর্ণ এবং কেমিক্যাল আমদানি করার কথা বলে ফাঁসানো হয়।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ রাজধানীর ধানমন্ডিতে সাবেক এক জেলাজজের বাসা ভাড়া নেয় চক্রটি। বাসা ভাড়ার অগ্রিম তো দূরের কথা প্রতি মাসের নিয়মিত ভাড়া না দিয়ে একজনের ১৮ লাখ ও ১৫ লাখ, অপর একজনের ১৩ লাখ টাকাসহ কমপক্ষে অর্ধশত লোকের দেড় কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছে। বাড়ি ভাড়া নেওয়ার সময় এই চক্রটি ফার্মাসিটিক্যালের ব্যবসা করার কথা বলেছিল বলে জানিয়েছন সাবেক এই জেলাজজ । চক্রটি পালিয়ে যাওয়ার পর প্রতারিত মানুষ সাবেক জেলাজজের বাড়িতে এসে ভিড় করে চক্রটির ঠিকানা জানার জন্য। কিন্তু জেলাজজ তাদের কোনো ঠিকানা দিতে পারেননি। এতে প্রতারিত মানুষদের সন্দেহ হয়। উপায়ন্তু না পেয়ে সাবেক জেলাজজ পুলিশের দারস্ত হয়েছেন। তার অভিযোগের ভিত্তিতে চক্রটিকে ধরতে গোয়েন্দ পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে।
এছাড়ও রাজধানীর উত্তরা এবং বনানীতে গত মাসে এরকম আরো দুটি ঘটনার তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। এই গ্রুপটিও শতাধিক লোকের কাছ থেকে বিভিন্ন কথা বলে কমপক্ষে তিনকোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছে।
এরা একটি এলাকায় দুই থেকে তিন মাস অবস্থান করে। এরপর আর ওই এলাকা থেকে উধাও। মাঠ পর্যায়ে চক্রটির সুদর্শন প্রতারকরা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে। তারা অর্থশালী লোককে টার্গেট করে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসে।
সূত্রটি আরো জানায়, প্রতারণার জন্য রাজধানীর রামপুরা, উত্তরা, বনানী, ধানমন্ডি এবং মহাখালীতে এরা অফিস নেয়। এই চক্রটির নেতৃত্বে রয়েছে মাদারীপুরের এক ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শহীদ এবং ভোলার মহসীন চেয়ারম্যান। তারা দীর্ঘদিন ধরে এই চক্রের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে।
গোয়েন্দা সূত্রটি জানায়, এই চক্রের সদস্য দিনদিন বাড়ছেই। প্রতারিত ব্যক্তিরাও তাদের সঙ্গে এক সময় যোগ দেয়। কারণ চক্রটি যখন প্রতারিত লোকদের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হয় তখন তাদের ব্যক্তিদের ক্লায়েন্ট দিতে বলে। ক্লায়েন্ট দিতে পারলে তাদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে বলে জানানো হয়। টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য প্রতারিত ব্যক্তিরাও আবার প্রতারণায় জড়িয়ে যায়। এভাবেই চক্রটি বড় হচ্ছে।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিট পুলিশের (ডিএমপি) উপপুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, ‘চক্রটির প্রতারণা সম্পর্কে পুলিশ অবগত হয়েছে। চক্রটিকে ধরার জন্য গোয়েন্দা পুলিশ একাধিক পরিকল্পনা করেছে। শিগগিরই তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে।’
সূত্র: শীর্ষ নিউজ & DMP