দৈনিক বার্তা – তিনি নেই৷ তবুও তিনি রয়ে গিয়েছেন আপামর বিশ্ববাসীর মনে৷ শুক্রবার তার জন্মদিনে মাদিবাকে স্মরণ করল দক্ষিণ আফ্রিকাসহ তামাম বিশ্বের মানুষ৷ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সারম্বরে পালিত হল নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মদিন৷ ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই জন্ম গ্রহণ করেন দেশের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা৷ দক্ষিণ আফ্রিকায় কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও কর্মের মাধ্যমে তিনি সারা বিশ্বের মানুষের নয়নের মনি হতে পেরেছিলেন৷ আফ্রিকানরা তাকে আদর করে মাদিবা নামে ডাকেন৷
নেলসন ম্যান্ডেলার ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া বৃহত্তর স্বার্থে তাঁর ত্যাগই তাঁকে মহান করেছে৷ যাঁর প্রজ্ঞা, রাজনৈতিক অনর্্তর্দৃষ্টি, ক্ষমা, পুনর্মিত্রতা, মহানুভবতা, নিয়মানুবর্তিতা, ধৈর্য এবং সহনশীলতার মতো যাবতীয় মহত্ গুণাবলীর বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর মাঝে কালোত্তীর্ণ এক ঐকতান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নব্য বহুজাতিক দক্ষিণ আফ্রিকা প্রতিষ্ঠায় বিষ্ময়কর অবদান রেখেছে, আর সমানভাবে দেশে-বিদেশে, তথা আন্তর্জাতিক অঙ্গণে তাঁর বহুমাত্রিক প্রতীক নামিদামি, সাধারণ সব ধরণের মানুষের মাঝে জাতিগত ঐকতানের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে৷
সবাইকে নিজেদের তথাকথিত অবস্থান সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছে, সংখ্যালঘু, নির্যাতিত-নিপীড়িত, নিষ্পেষিত জনতার অধিকার এবং মর্যাদাবোধ সম্পর্কে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে এমন এক আবহ তৈরি করতে সাহায্য করেছে, যার উদাহরণ নিকট অতীতে বিরল৷ ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর ক্রান্তিকালে জাতিগত অধিকার এবং সচেতনতা, পারস্পরিক মর্যাদাবোধ নিয়ে বিশ্ব যখন চরম সঙ্কটের মোকাবেলা করছিল, ঠিক তখনই ম্যান্ডেলা নিজের কর্মমহানুভবতার মাধ্যমে সমহিমায় নিজেকে এমনই এক প্রতীকে রূপায়িত করে গেলেন৷
১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ১৮ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ প্রদেশের ট্রান্সকেই অঞ্চলের শাসক থেম্বু রাজবংশের ক্যাডেট শাখায় জন্মগ্রহণ করেন ম্যন্ডেলা৷ তাঁর জন্ম হয় ট্রান্সকেই এর রাজধানী উমতাতার নিকটবর্তী ম্ভেজো গ্রামে৷ ম্যান্ডেলা তাঁর পরিবারের প্রথম সদস্য যিনি স্কুলে পড়াশোনা করেছেন৷ স্কুলে পড়ার সময়ে তাঁর শিক্ষিকা মি্দঙ্গানে তাঁর ইংরেজি নাম রাখেন ‘নেলসন’৷ স্কুল থেকে পাস করার পর ম্যান্ডেলা ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর অফ আর্টস কোর্সে ভর্তি হন৷ পরবর্তীকালে ম্যান্ডেলা বান্টুস্থানের রাজনীতি ও নীতি নির্ধারণে জড়িত হন৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষ শেষে ম্যান্ডেলা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ছাত্র সংসদের ডাকা আন্দোলনে জড়িত হয়ে পড়েন৷
দক্ষিণ আফ্রিকার ১৯৪৮ এর নির্বাচনে আফ্রিকানারদের দল ন্যাশনাল পার্টি জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসার প্রেক্ষাপটে ম্যান্ডেলা সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন৷ তিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ১৯৫২ সালের অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন৷ ১৯৫৫ সালের জনগণের সম্মেলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন৷ এই সম্মেলনে মুক্তি সনদ প্রণয়ন করা হয়, যা ছিল দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের মূল ভিত্তি৷ ম্যান্ডেলার রাজনৈতিক জীবনের প্রথমভাগে তিনি মহাত্মা গান্ধীর দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হন৷ দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী কর্মীরা আন্দোলনের প্রথম দিকে গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের নীতিকে গ্রহণ করে বর্ণবাদের বিরোধিতা করেছিল৷ ম্যান্ডেলাও প্রথম থেকেই অহিংস আন্দোলনের পক্ষপাতী ছিলেন৷
দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ সরকার ১৯৫৬ সালের ৫ই ডিসেম্বর তারিখে ম্যান্ডেলা সহ ১৫০ জন বর্ণবাদ বিরোধী কর্মীকে দেশদ্রোহিতার মামলায় গ্রেপ্তার করে৷ রবেন দ্বীপের কারাগারে ম্যান্ডেলার ২৭ বছরের কারাবাসের প্রথম ১৮ বছর কাটান৷ জেলে থাকার সময়ে বিশ্বজুড়ে তাঁর খ্যাতি বাড়তে থাকে৷ তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃষ্ণাঙ্গ নেতা হিসাবে সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেন৷ ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে ম্যান্ডেলাকে রবেন দ্বীপের কারাগার থেকে পোলস্মুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়৷ ১৯৯০ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি তারিখে দক্ষিণ আফ্রিকার তদানিন্তন রাষ্ট্রপতি এফ ডবি্লউ ডি ক্লার্ক আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসসহ অন্যান্য বর্ণবাদ বিরোধী সংগঠনের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন৷ একই সাথে তিনি ঘোষণা দেন, ম্যান্ডেলাকে অচিরেই মুক্তি দেয়া হবে৷ ভিক্টর ভার্সটার কারাগার থেকে ম্যান্ডেলাকে ১৯৯০ সালের ১১ই তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়৷ ম্যান্ডেলার কারামুক্তির ঘটনাটি সারাবিশ্বে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়৷ বর্ণবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছিলেন৷ জীবনের ২৭টি বছর কাটিয়েছিলেন কারাবাসে৷ ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর জোহানেসবার্গে নিজের বাড়িতেই শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন নেলসন ম্যান্ডেলা৷