দৈনিক বার্তা –নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের প্রধান আসামি নূর হোসেনের জবানিতে বেরিয়ে এসেছে প্রভাবশালীদের নাম। সাত খুনের আগে গ্রেফতার হওয়া র্যাবের তিন কর্মকর্তার পাশাপাশি নূর হোসেন কথা বলেছিলেন তার প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ‘বড় ভাইয়ের’ সঙ্গে। শুধু তাই নয়, নূর হোসেনের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা নিতেন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপি, উপদেষ্টা এবং প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্যও। কলকাতায় আটকের পর পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার কাছে দেওয়া নূর হোসেনের জবানবন্দিতে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এদিকে আইনি জটিলতার কারণে সহসাই নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছে কলকাতার সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো। জানা গেছে, কলকাতায় আটকের পর ৮ দিনের রিমান্ডে নূরকে ব্যাপক জেরা করে কলকাতা পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থা। জেরার মুখে নূর সাত খুনের আগে ও পরের ঘটনা সম্পর্কে নানা তথ্য প্রকাশ করেছেন। ঘটনার পর তিনি কীভাবে কলকাতায় এলেন, কোথায় ছিলেন- এমন নানা প্রশ্নের জবাব তিনি দিয়েছেন কলকাতা পুলিশের কাছে।কলকাতা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বাংলাদেশের সাত খুনের প্রসঙ্গটি এলেও আদালতে তা উপস্থাপন করা হয়নি।
এ সম্পর্কে কলকাতার সূত্রগুলো বলেছে, বাংলাদেশের বিষয়গুলো নূর হোসেনের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক নয়। ওই ঘটনাটি সেখানে সংঘটিত হয়নি। এ কারণে পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়া ও আদালতের সামনে এ বিষয়গুলো আসেনি।দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, কলকাতায় অবস্থান নেওয়ার পর থেকে তার ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে তাকে আটকের পর উঠেপড়ে লাগে বিভিন্ন সংস্থা। পরে একটি বারে মারামারির ঘটনাকে কেন্দ্র করে নূর হোসেনের বিষয়টি কলকাতা পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার সামনে আসে। এর পরই তাকে আটক করা হয়। পরে তাকে বিভিন্ন সংস্থা দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদে শুধু কলকাতাই নয়, বাংলাদেশ প্রসঙ্গ ছিল অন্যতম বিষয়। সেখানে নূর হোসেন খোলামেলাভাবে মুখ খুলেছেন। বলেছেন তার উত্থান কাহিনী। নূর তার জবানবন্দিতে আরও বলেছেন, একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীপুত্র ছিলেন তার ব্যবসায়িক পার্টনার। নারায়ণগঞ্জ থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত বালুমহাল একতরফাভাবে তারা নিয়ন্ত্রণ করতেন। এর পাশাপাশি ঢাকার পাশের একটি জেলার একজন সংসদ সদস্য, যিনি ধানমন্ডি এলাকায় বসবাস করেন তার সঙ্গেও বিশেষ সখ্য ছিল নূর হোসেনের।
নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমানের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো থাকলেও নিহত সাতজনের একজন সিটি প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক ছিল বলে বিভিন্ন সংস্থার কাছে দাবি করেছেন নূর হোসেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং একজন উপদেষ্টাকে নিয়মিত বড় অঙ্কের মাসহারা দিতেন নূর। এসব কারণে তিনি রাজনৈতিকভাবে বড় ধরনের স্বপ্নের মধ্যে ছিলেন। নূরকে আরও বড় অবস্থানে নিয়ে আসার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন ওই ব্যক্তিরা। জিজ্ঞাসাবাদে নূর আরও দাবি করেছেন, কারান্তরীণ র্যাবের তিন কর্মকর্তা লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর (অব.) আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার (অব.) এম এম রানার সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক ছিল। তবে সরাসরি লেনদেন ছিল মেজর আরিফের সঙ্গে। মেজর আরিফ বিভিন্ন সুবিধা অন্যদের কাছে পৌঁছে দিতেন। বিভিন্ন ইস্যুতে এসব র্যাব কর্মকর্তা (সাবেক) নূর হোসেনকে সহায়তা করতেন। এ কারণে শেষ দিকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ের কারণে নূর নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে মনে করতেন। এদিকে, ভারতের সঙ্গে বন্দীবিনিময় চুক্তি না থাকায় নূর হোসেনের দেশে ফেরা নিয়েও অনিশ্চয়তা কাটেনি। কারণ নূরকে ফেরত পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা থাকলেও রয়েছে আইনগত বাধা। ভারতে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছে কলকাতা পুলিশের একটি সূত্র। তবে এ বিষয়টি নিয়ে এখনো উভয় পক্ষের আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। উল্লেখ্য, ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দনকুমার সরকারসহ সাতজনের অপহরণ ও খুনের ঘটনায় প্রধান আসামি নূর হোসেন এবং তার দুই সহযোগী ওয়াহিদুজ্জামান সেলিম ও খান সুমনকে ১৪ জুন কলকাতার নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসংলগ্ন এলাকা কৈখালির একটি বহুতল আবাসন থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশের দায়ে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৪ বিদেশি নাগরিক আইন (ফরেনারস অ্যাক্ট) লঙ্ঘনের অভিযোগ দায়ের করা হয়। পরদিনই ১৫ জুন পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ জেলা আদালতে তোলা হলে প্রথমে আট দিনের পুলিশি রিমান্ড দেওয়া হয়। পুলিশি রিমান্ড শেষে দ্বিতীয় দফায় ১৪ দিনের হাজতবাসের নির্দেশ দেন আদালত। সেই হাজতবাসের মেয়াদ শেষে ৭ জুলাই আদালতে তোলা হলে ফের ১৪ দিনের হাজতবাসের নির্দেশ দেওয়া তিন অভিযুক্তকেই।কিন্তু এ খুনের মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত খান সুমন মামলার প্রথম দিন থেকেই খুনের ঘটনায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন। নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করে সুমন বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না’। তার অভিযোগ ছিল বৈধ পাসপোর্ট নিয়ে ভারতে প্রবেশ সত্ত্বেও তাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। গতকাল উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা আদালতে খান সুমনের ভারতে প্রবেশের বিস্তারিত তথ্য পেশের সময় বাগুইহাটি থানার পুলিশের তরফে এ মামলার তদন্ত অফিসার প্রভাকর নাথ আদালতকে জানান, সুমনের কাছে ভারতে প্রবেশের কোনো বৈধ কাগজপত্র না থাকায় তাকে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছে।