gold-2-wb_1

দৈনিক বার্তা  – দুবাই থেকে বিমানে করে গত বছরের ৩০ অক্টোবর ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামেন সোহেল আহমেদ। বিমানবন্দরে তল্লাশিতে ধরা পড়ে, সঙ্গে দুই কেজি ৮৫ গ্রাম ওজনের সোনার বার এনেছেন তিনি। যার তখনকার বাজরমূল্য এক কোটি ২০ লাখ টাকা। শুল্ক কর্তৃপক্ষকে কোনো ঘোষণা না দিয়ে বেআইনিভাবে সোনা আমদানির কারণে শুল্ক বিভাগের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সোহেলের বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় মামলা করেন। তাঁকে গ্রেপ্তর করা হয়। গ্রেপ্তারের পর সোহেল ঘোষণা ছাড়াই সোনা আনার বিষয়ে লিখিত জবানবন্দি দেন। কিন্তু কারাগারে থাকার সময় আইনজীবীর মাধ্যমে আটকাদেশকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন সোহেল। রিটে বলা হয়, তিনি বৈধ মালামাল নিয়ে ঢাকায় নামেন। হয়রানি করতে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। হাইকোর্টে সোহেলের পক্ষে শুনানির সময় লিখিত জবানবন্দির বিষয়টি উল্লেখ না করে তাঁর আইনজীবী কেবল বৈধভাবে আনা জিনিসপত্রের কথা উপস্থাপন করেন। শুনানি শেষে ১৩ ফেব্রুয়ারি সোহেলকে মুক্তির নির্দেশ দেন আদালত।

শুধু সোহেল নয়, জানা যায়, গত ১০ বছরে দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরে সোনার অবৈধ চালান আটকের ঘটনায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে এ পর্যন্ত একজনেরও সাজা হয়নি। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং পুলিশ সূত্র জানায়, গত পাঁচ বছরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দুই লাখ ৬৪ হাজার গ্রাম সোনার বার আটক করা হয়েছে। মামলা হয়েছে ৬৪টি। তবে বেশির ভাগ মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। চার্জশিট কবে হবে কেউ বলতে পারছেন না। অভিযোগ রয়েছে, দুর্বল আইন ও তদন্তের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাচ্ছেন চোরাকারবারিরা। বিমানবন্দরে যাঁদের আটক করা হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা কেবল বাহক হিসেবে কাজ করেন। রাজনৈতিক নেতাদের ছায়া থাকায় চক্রের মূল হোতাদের কাছে পৌঁছানোই যায় না। দেশি পাচারকারীদের সঙ্গে আঁতাত করছে ভিনদেশি কারবারিরাও। কাস্টমস কর্মকর্তারা মামলার তদন্তই করতে পারছেন না। বিভিন্ন বিমানে কর্মরত ক্রু ও পাইলট এবং সিভিল এভিয়েশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও সোনা পাচারের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে শাহজালাল, শাহপরাণ ও ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে সোনার চালান পাচার হচ্ছে। কাস্টমসসহ ১৭টি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা নানা কৌশল নিয়েও চোরাকারবারিদের নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খাচ্ছে। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল দৈনিক বার্তা কে বলেন, সোনা চোরাচালানের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় আমরা উদ্বিগ্ন। চোরাকারবারিরা বাংলাদেশকে ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা চালানগুলো ভারতে পাচার করছে বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। তবে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আশ্রয়-প্রশ্রয়কারীদেরও মামলায় ঢোকানো হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সোনা পাচারের মামলার তদন্ত চলছে। রাঘববোয়ালদের নাম অন্তর্ভুক্ত করে চার্জশিট দেওয়া হবে। এ জন্য কিছুটা সময় লাগছে। তবে আসামিদের জামিনে মুক্ত হওয়ার ব্যাপারে তিনি কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানান।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল খান বলেন, ‘সোনার চালান আটক হচ্ছে। থানায় মামলা হচ্ছে। কিন্তু আমরা নিজস্বভাবে তদন্ত করতে পারছি না। কিছু মামলার তদন্ত র‌্যাবকে দেওয়ার জন্য আমরা মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছি। সোনা পাচারকারীদের ধরা হচ্ছে। তবে আসল কারবারিদের ধরতে একটু সময় লাগছে।’ র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এ টি এম হাবিবুর রহমান বলেন, সোনা পাচারের একটি মামলার তদন্ত চলছে। চোরাকারবারিদের ধরা হয়েছে। দ্রুত চার্জশিট দেওয়া হবে। কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিলে অন্য মামলারও তদন্ত করবে র‌্যাব।

সোনা আসছে অবাধে, গত পাঁচ বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে আটক বড় চালানগুলোর মধ্যে ২০০৯ সালে পঞ্চগড়ে ধরা পড়ে ২০ কেজি ৮৬ গ্রাম সোনা। গত বছরের ২৪ জুলাই শাহজালালে ১২৪ কেজি সোনার চালান আটক করা হয়। এটি সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বড় চালান। একই বছরের ২২ অক্টোবর বিমানের টয়লেট থেকে ৩০ কেজি ওজনের ২৮০টি সোনার বার, আট দিন পরে টয়লেট থেকেই ১৭ কেজি ওজনের ১৪৭টি বার এবং ২৭ নভেম্বরেও টয়লেট থেকে ২০ কেজি ওজনের ১৬০টি বার আটক করা হয়। গত বছরের ১১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমানের টয়লেট থেকে ১৬ কেজি ওজনের ১৩৮টি সোনার বার জব্দ করা হয়। সর্বশেষ ২৬ এপ্রিল বাংলাদেশ বিমানের টয়লেট থেকে ১০৬ কেজি সোনার বার আটক করা হয়। গত ১৪ মে চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে আটক হয়েছে ১৬ কেজি ওজনের সোনার বার।

জামিনে বেরিয়ে যায় আসামি : চালানের সঙ্গে আটক ব্যক্তিদের বেশির ভাগই জামিনে বেরিয়ে যান। গত ১ জানুয়ারি উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরের একটি বাসা থেকে এক হাজার ৩০০ ভরি সোনাসহ মোহাম্মদ আলী, আসকার লাবু, কামরুল ইসলাম, আবু জাফর ও ভারতীয় নাগরিক জামিলকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। তাঁরা আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। এখনো মামলার তদন্ত চলছে। র‌্যাব বলছে, শিগগির চার্জশিট দেওয়া হবে। চলতি মাসে জামিল ছাড়া বাকিরা জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। মোহাম্মদ আলী একসময় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সুইপারের চাকরি করতেন। গত বছরের ২৫ অক্টোবর শাহজালালে সৌদি আরব ফেরত মো. সুরুজ্জামানের ব্যাগ তল্লাশি করে ১০টি সোনার বার আটক করা হয়। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে সোনার বার পাচারের অভিযোগে সুরুজ্জামানের বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় মামলা হয়। তাঁকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। পরে সুরুজ্জামানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ গত বছরের ১৮ নভেম্বর তাঁকে ছয় মাসের জন্য অন্তর্বর্তী জামিন দেন।

আদালত সূত্র জানায়, রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জনতা হাউজিংয়ের বাসিন্দা কাইয়ুম মিয়া গত বছরের ২৯ জুলাই হংকং থেকে ফেরার সময় বিমানবন্দরে ৫২টি সোনার বারসহ আটক হন। একই দিনে সিঙ্গাপুর থেকে আসা নিউ ইস্কাটন রোডের বাসিন্দা মজিবুর রহমানের কাছ থেকে চারটি সোনার বার উদ্ধার করা হয়। ওই দুই ঘটনায় করা মামলায় কাইয়ুম ১ অক্টোবর ও মজিবুর ১০ অক্টোবর হাইকোর্ট থেকে জামিন পান। ১১ জুন সাত কেজি সোনা চোরাচালান মামলায় হাইকোর্ট থেকে জামিন পান ভাটারা থানার বাসিন্দা মোরশেদ আলম। ১৭টি সোনার বারসহ গত বছর জুলাইয়ে গ্রেপ্তার হওয়া আসামি মিজানুর রহমান হাইকোর্ট থেকে জামিন পান গত বছর ২৭ অক্টোবর। তিন কেজি সোনাসহ আটক নজরুল ইসলামকে গত বছর ১৯ নভেম্বর জামিন দেন হাইকোর্ট। এভাবে গত এক বছরে অন্তত ২০টি সোনা চোরাচালান মামলার আসামির জামিন হয়। আর গত পাঁচ বছরে গ্রেপ্তার করা অধিকাংশ আসামিই এখন জামিনে মুক্ত।

দায়সারা তদন্ত : ২০১২ সালে সাড়ে ১৩ কেজি সোনা পাঁচারকালে মনোয়ারুল হক নামের একজন পাঁচারকারী গ্রেপ্তার হন শাহজালালে। মনোয়ারের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত অন্যদের গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, ঘটনার সঙ্গে শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তাদের জড়িত। কিন্তু তদন্তে শুল্ক বিভাগের দুই কর্মকর্তাকে বাদ দিয়ে চার্জশিট দেওয়া হয়। এ ছাড়া চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত মিজান, নীপু, কবির, সেলু ও মিরাজের নাম-ঠিকানা পাওয়া যায়নি বলে মামলা থেকে তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়। এভাবে চোরাচালানের মূল হোতাদের বাদ দিয়েই দেওয়া হয় চার্জশিট। বিমানের সন্দেহভাজন কয়েকজন কর্মচারীকে এসব মামলায় গ্রেপ্তার করেই বেশির ভাগ মামলার তদন্ত শেষ করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।

একজনেরও সাজা হয়নি : সোনা চোরাচালান মামলায় গত ১০ বছরে একজনেরও সাজা হয়নি। এর অন্যতম কারণ দুর্বল মামলা ও তদন্ত। গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর সাড়ে ১৩ কেজি স্বর্ণ পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকায় একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা আজিজ শাহ ও শাহজালাল বিমানবন্দরের কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ মামলার চার্জশিট হলেও কবে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হবে কেউ বলতে পারছেন না। কিছুদিন আগে শাহজালালে চার কোটি টাকা মূল্যের ৪০টি স্বর্ণের বার আটক করে এপিবিএন। এ ঘটনায় সিভিল এভিয়েশনের নিরাপত্তাকর্মী কবির আহমেদ, চোরাকারবারি মোরশেদ আলম ও তাঁর গাড়িচালক হেলাল মিয়া গ্রেপ্তার হন। দুই মাস আগে রাজধানীর রামপুরা থানায় সোনার বার গায়েব করার অভিযোগে থানার ওসি কৃপা সিন্ধু বালা, পরিদর্শক (তদন্ত) নাসিম আহমেদ, সাব ইন্সপেক্টর মঞ্জুরুল ইসলাম ও সহকারী সাব ইন্সপেক্টর রফিকুল ইসলামকে প্রত্যাহার করা হয়। এবং ভারতীয় নাগরিক সমীর, মাহিন, এসআই মঞ্জুরুলসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায় ডিএমপির রমনা জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) শিবলী নোমান জড়িত আছেন বলে অভিযোগ ওঠে। এখনো মামলার তদন্ত চলছে।

পারিবারিক সিন্ডিকেট : গত ২১ এপ্রিল শাহজালালে ২০ কেজি সোনার বারসহ গ্রেপ্তার হন একই পরিবারের তিন সদস্য- মা শাহনেওয়াজ হোসেন, মেয়ে আনজিলা হোসেন ও জামাতা নাবিল ইবনে ইকরাম। তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে সোনা পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে শুল্ক গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছেন। বিমানবন্দর থানায় তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। কিন্তু পরে তাঁরা জামিনে বের হয়ে যান। এমনকি তাঁদের আটক করায় শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ক্ষমতাসীন দলের এক প্রভাবশালী নেতা হুমকি-ধমকি দিয়েছেন।

ক্রু-পাইলটকে তলব : গত বছরের ২৪ জুলাই ১২৪ কেজি সোনা উদ্ধারের পরপরই পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ক্যাপ্টেন মাহতাব, ক্যাপ্টেন জাকির, পার্সার নেওয়াজ হোসেন, চিফ পার্সার তালুকদার, পাইলট নাদিম, পাইলট ফারহানা এ্যানী, পার্সার ইলোরা, তাসফিয়া ফয়সল, সুমন, নিরাপত্তা কর্মকর্তা কামরুল আহসান ও হাসান পারভেজ হাবিবকে জিজ্ঞাসাবাদ করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এ প্রসঙ্গে এক কাস্টমস কর্মকর্তা বলেন, তাঁদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।