13দৈনিক বার্তাঃ চোখের সামনে ট্রেন ছেড়ে চলে গেল। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্য আতিকুর রহমান, তাঁর বোন ও দুই ভাগনি অসহায়ের মতো প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে রইলেন। শেষ পর্যন্ত দুই ভাগনি আর কান্না চেপে রাখতে পারল না। আতিকুর রহমানকে মঙ্গলবারই চট্টগ্রামে তাঁর কর্মস্থলে যোগদান করতে হবে।

উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় পরিবহন ধর্মঘট চলাকালে ট্রেনের টিকিট না পেয়ে এই পরিবারটির মতো অনেকেই ঢাকায় যেতে পারেননি। কেউ কেউ উঠে পড়েছেন ইঞ্জিনের সামনে।

সড়কে অবৈধ যান চলাচল ও চাঁদাবাজি বন্ধসহ ছয় দাবিতে বাস-ট্রাক মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ডাকে গত রোববার থেকে উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬ জেলায় পরিবহন ধর্মঘট শুরু হয়েছে। এ সময় কোথাও দূরপাল্লা বা আন্তজেলায় বাস, ট্রাক, ট্যাঙ্কলরি ও কাভার্ড ভ্যান চলাচল করেনি। ধর্মঘট চলাকালে গাড়ি বের করায় সোমবার শ্রমিকেরা একটি ভটভটি ও একটি পাওয়ার ট্রলিতে অগ্নিসংযোগ করেছেন। আরও অন্তত ১০টি ভটভটি ও একটি ট্রাকে ভাঙচুর চালিয়েছেন।

দূরপাল্লার যাত্রীদের একমাত্র ভরসা ছিল ট্রেন। বিকেলে ঢাকাগামী পদ্মা এক্সপ্রেস ট্রেন ছাড়ার সময় স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, প্লাটফরমে গিজগিজ করছে মানুষ। টিকিট না পেয়ে অনেক যাত্রী যেতে পারেননি। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ১০ কার্টন পিউলি মাছ নিয়ে ঢাকায় যাওয়ার জন্য এসেছিলেন ব্যবসায়ী আবদুল লতিফ। কিন্তু ট্রেনে তাঁর জায়গা হয়নি। তিনি বলেন, এই মাছগুলো স্থানীয় বাজারে বিক্রি করলে তাঁর লোকসান হবে। এ জন্য মাছগুলো ঢাকায় নিয়ে যাওয়া জরুরি ছিল। তাঁর বিরাট ক্ষতি য়ে গেল। চাঁপাইনবাবগঞ্জের স্কুলশিক্ষক মেজবাউল ইসলাম জরুরি কাজে ঢাকায় যাওয়ার জন্য এসেছিলেন। টিকিট না পেলেও যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ট্রেনেই উঠতে পারেননি। স্থানীয় যাত্রীরাও চরম বিপাকে পড়েছেন। বাঘা থেকে ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম জরুরি কাজে রাজশাহী আসছিলেন। তিনি বলেন, পা-চালিত ভ্যান, অটোরিকশায় করে ছয়বার গাড়ি বদল করে তাঁকে রাজশাহী আসতে হয়েছে। তিনি বলেন, সাধারণত রাজশাহীতে আসতে তার ৬০ টাকা খরচ হয়। সোমবার তার ১১০ টাকা খরচ হলো। সময় লাগলো দ্বিগুণ।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ১০টায় রাজশাহী নগরের এএইচএম কামরুজ্জামান বাস টার্মিনালের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশা। কোনো যাত্রী ছিল না। তার পরও শ্রমিকেরা গাড়িটি ভাঙচুর করে। চালককে পেটাতে পেটাতে শ্রমিকেরা নিয়ে যান। ভাঙা গাড়িটি পুলিশ থানায় নিয়ে যায়।

গত রোববার দিবাগত রাত ১১টার দিকে এএইচএম কামরুজ্জামান বাস টার্মিনালের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মোটর শ্রমিকেরা একটি ভটভটিতে আগুন লাগিয়ে দেন। এ সময় নগরের বোয়ালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গিয়ে তাঁদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে তাঁরা তার সঙ্গে তর্ক জুড়ে দেন। এরপর তাঁরা টার্মিনালের একটু পূর্বদিকে একটি পাওয়ার ট্রলিতে একইভাবে আগুন লাগিয়ে দেন ও আরও একটি ট্রলি ভাঙচুরের চেষ্টা করেন।

বোয়ালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুস সোবহান বলেন, ফোন করার পরে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ি য়ে আগুন নেভায়।ঐক্য পরিষদ ছয় দফা দাবিতে পরিবহন ধর্মঘট ডেকেছে। দাবিগুলো হলো নছিমন, করিমন, ভটভটি, পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টরসহ অবৈধ যান চলাচল বন্ধ, সিএনজি, মাহেন্দ্র, থ্রি হুইলার, হিউম্যান হলারের রুট পারমিট-বহির্ভূত এলাকায় চলাচল বন্ধ ও রুট পারমিট প্রদান বন্ধ, ইজারাকৃত বিআরটিসি ও দ্বিতল বাস উপজেলাভিত্তিক চলাচল বন্ধ, স্কেলের নামে অবৈধ চাঁদাবাজি বন্ধ, বিআরটিএর ট্যাক্স টোকেন ও ফিটনেসের বর্ধিত ফি প্রত্যাহার এবং সকল প্রকার পুলিশি হয়রানি বন্ধ করা।

বগুড়া: ৬ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে রাজশাহী বিভাগীয় পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহবানে বগুড়ায় দ্বিতীয় দিনের পরিবহন ধর্মঘট চলছে। রাজশাহীর ৮ জেলায় এই পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়। পরিবহন বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছে সাধারণ যাত্রীরা।

ধর্মঘটের কারনে বাস কোচ মিনিবাস ও ট্রাক সহ অটোরিক্সা চলাচল বন্ধ রয়েছে। মহাসড়কে আটকা পড়ছে বহু পন্যবাহী ট্রাক। সড়ক মহাসড়কে শুধু চলাচল করছে রিক্সা ও রিক্সা ভ্যান।
ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিনে সাধারণ যাত্রীদের দুর্ভোগে চরমে পৌঁছছে। বাস মিনিবাস বন্ধ থাকায় দুরযাত্রায় যাত্রীদের অবলম্বন ট্রেন। ফলে রেলস্টেশনে যাত্রীদের চাপ বেড়েছে অস্বাভাবিক। ট্রেনে সিট না থাকলেও জীবনের ঝুঁিকি নিয়ে অনেকে ট্রেনে উঠছেন। সময় বাড়ার সঙ্গে রেলস্টেশনে অপেক্ষামান যাত্রীদের ভীড়ও বাড়ছে।

বাস- অটোরিক্সা চলাচল বন্ধ থাকায় লোকজন বাধ্য হয়ে রিক্সা ভ্যানে চলাচল করছেন। আর ধর্মঘটের সুযোগে রিক্সা ও রিক্সা ভ্যানের ভাড়াও ২/৩ গুন বেড়ে গেছে।

রাজশাহী বিভাগীয় সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সহ-সভাপতি আব্দুল মান্নান মন্ডল জানান, ৬ দফা দাবি বাস্তবায়নের দাবিতে মালিক শ্রমিকদের পরিবহণ ধর্মঘট চলছে। দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট চলছে চলবে।

বগুড়ার পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হক বলেছেন, পরিবহন ধর্মঘটে মানুষের দূর্ভোগ বেড়েছে। আমরা সমস্যা সমাধানে আলোচনা করছি। আমাদের ঊর্ধর্তন কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছেন খুব তাড়াতাড়ি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তিনি আরো জানান, পুলিশের বিরুদ্ধে যে চাঁদাবাজির অভিযোগ করা হয়েছে তা অস্বীকার করে তিনি বলেন, এটা অসম্ভব। তারপরেও যদি কেউ চাঁদাবাজি করে থাকে তাহলে তাদের নামে অভিযোগ করলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর নছিমন করিমন মহাসড়কে পেলে পুলিশ সব সময় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে এখনও নিচ্ছে।

নীলফামারী : ধর্মঘটে সৈয়দপুরের লিচুর বাজারে ধস নেমেছে। যান চলাচল বন্ধ থাকায় সৈয়দপুরের বাইরে লিচু যাচ্ছেনা। এতে দাম যেমন কম অন্যদিকে বাইরের কোন ব্যবসায়ীদের ভীড় লক্ষ্য করা যায়নি। এর ফলে বাগান মালিকসহ ব্যবসায়ীদের গুনতে হচ্ছে লাখ লাখ টাকা লোকসান।

সৈয়দপুর পরিবহণ শ্রমিক ইউনিয়নেসর সভাপতি মোঃ আখতার হোসেন বাদল জানান, গতকাল রবিবার থেকে শুরু হয় অনির্দিষ্টকালের জন্য পরিবহন ধর্মঘট। প্রথমদিন থেকেই দূরপাল্লার কোন যানবাহন চলাচল করেনি। এছাড়া গত রবিবার সাপ্তাহিক ছুটি ছিল সৈয়দপুর থেকে ঢাকামুখী নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেন। ওইদিন সৈয়দপুর থেকে বাইরের জেলাগুলোতে বাস বা ট্রাক চলাচল না করায় বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হয়েছে লাখ লাখ টাকা। আজ সোমবারও সারাদিন বন্ধ থাকায় ক্ষতির পরিমাণ দ্বিগুণ হতে পারে বলে জানান তিনি।

সৈয়দপুর বণিক সমিতির সভাপতি ইদ্রিস আলী, বঙ্গবন্ধু কল্যাণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক স.ম. জিয়াউল হক বিপ্লবসহ বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা আম ও লিচু ব্যবসায় ধর্মঘটের আওতামুক্ত রাখতে যান মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। গতকাল সোমবার সকালে ১ নং রেল গুমটি সংলগ্ন লিচুর পাইকারী বাজারে গিয়ে দেখা গেছে রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা ও গ্রাম থেকে পিকআপ, ভ্যান, রিক্সা, নছিমনসহ বিভিন্ন যান বাহনে করে ব্যবসায়ী ও মালিকেরা লিচু নিয়ে আসেন। কিন্ত তারা জানতেন না অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট চলছে। একারণে ক্রেতা নেই বললেই চলে। গত শনিবার যে লিচু তারা বিক্রি করেছেন ৩ শ’ টাকায় সেই লিচু তাদের বাধ্য হয়ে বিক্রি করতে হয়েছে ১ থেকে দেড় শত টাকায়।

মফিজ নামের এক বাগান মালিক বলেন, ধর্মঘট চলছে মুই জানোনা। জানিলে কি আর মুই লেচু বেচের আইসো? যতুলা লেচু আনছু এ্যাতে দশ থাকি বারো হাজার টাকা লাভ হবার কথা আছিল। কিন্তক এ্যালা তাবতই লস হইবে।

আড়তদার ফারুক জানান, গত শনিবার মাঝারি ধরণের ১০০ লিচু বিক্রি করেছেন ২শত টাকায়। আর ভাল লিচু বিক্রি হয়েছে ৩ থেকে সাড়ে ৩ শত টাকায়। শুধুমাত্র ধর্মঘটের কারণে পানির দামে লিচু বিক্রি করতে হচ্ছে। মজনু নামের অপর এক আড়তদার জানান, প্রতিদিন কমপক্ষে ৪ পিকআপ এবং ঢাকাগামী বাসের ছাদে শত শত খাচা ভর্তি লিচু সৈয়দপুর থেকে পাঠানো হতো ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য জেলাগুলোতে। কিন্ত হঠাৎ পরিবহণ ধর্মঘটের কারণে বাগান মালিকসহ ব্যবসায়ীদের নিয়ে আসা লিচু বাইরে পাঠাতে না পারায় লসের ধাক্কায় কোমর বাকা হওয়ার সামিল হয়েছে। তারা বলছেন, পরিবহণ ধর্মঘট যদি অনির্দিষ্টকালের জন্য হয়ে থাকে তাহলে সৈয়দপুর, বদরগঞ্জ, খাগরাবন্ধ ও দিনাজপুরের লিচু ব্যবসায়ী ও বাগান মালিক যেমন লোকসান গুনবেন তেমনি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য জেলার মানুষের ভাল লিচু খাওয়ার শখ, শখই থেকে যাবে।

পাবনা ঃ অননুমোদিত ও ফিটনেসবিহীন নসিমন, করিমন, ভটভটি, পাওয়ারটিলার, টাক্টরসহ অবৈধ যান চলাচল বন্ধসহ ছয় দফা দাবিতে রাজশাহী বিভাগে দ্বিতীয়দিনের মতো চলছে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট।

রোববার সকাল ৬টা থেকে শুরু হওয়া ধর্মঘটের আওতায় পাবনাতেও বন্ধ রয়েছে বাস চলাচল। ধর্মঘটের কারণে রাজধানী ঢাকার সাথে উত্তরাঞ্চলের সড়ক পথে যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়েছে। সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন দুরপাল্লার যাত্রীরা। তবে পাবনায় বাস চলাচল বন্ধ থাকলেও বেশকিছু ট্রাক ও সিএনজি চলাচল করতে দেখা গেছে।গত ২১ মে এক সমাবেশ থেকে ৬ দফা দাবিতে ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম ঘোষণা করেছিল রাজশাহী জেলা বাস-ট্রাক মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। তার অংশ হিসেবে রোববার থেকে এ ধর্মঘট শুরু হয়।