1দৈনিক বার্তা : নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণের পর খুনের ঘটনায় র‌্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্তে গঠিত তদন্ত কমিটি নারায়ণগঞ্জের ঘটনাস্থল ও লাশ উদ্ধারের স্থান পরিদর্শন করেছে।এ সময় তদন্ত কমিটির প্রধান শাহজাহান আলী  মোল্লা সাংবাদিকদের জানান, তদন্তের প্রয়োজনের ঘটনাস্থলে আসা হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে এবং সঠিক তথ্য  বের করতে যে কোনো ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তিনি বলেন, চাপের উর্ধ্বে  থেকে তদন্তে কাজ কার  হবে।

তিনি বলেন, তদন্ত কমিটি  দেশের সর্বোচ্চ আদালত  থেকে গঠন করা হয়েছে। অনেক বিচারক যারা অনেক চাঞ্চল্যকর মামলায় ফাঁসির রায় দিয়েছেন, তারাও এ কমিটিতে রয়েছেন।সাক্ষীদের নিরাপত্তার বিষয়ে প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সাক্ষীদের যথেষ্ট নিরাপত্তা দেওয়া হবে। আর সাক্ষীরা  যেখানে নিরাপদ মনে করবেন, তাদের  সেখানে নিয়েই সাক্ষ্যগ্রহণ করা হবে।

বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টায় শাহজাহান আলী মোল্লার নেতৃত্বে সাত সদস্যের ওই তদন্ত কমিটি নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে এসে পৌঁছায়।পরে  জেলা প্রশাসক  মো. আনিসুর রহমান মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে লাশ উদ্ধারের স্থান বন্দর কলাগাছিয়ার এলাকার শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী চরনদীর  মোহনায় যান।

এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন- জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আবদুল কাইয়ুম সরকার, আবুল কাশেম  মো. মহিউদ্দিন, আইন ও বিচার বিভাগ ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব  মোস্তাফিজুর রহমান, মিজানুর রহমান খান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শফিকুর রহমান, সাঈদ মাহমুদ  বেলাল হায়দার প্রমুখ।

এর আগে আদালতের নির্দেশে বুধবার রাতে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় র‌্যাব ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ অন্যদের জড়িত থাকার অভিযোগে তদন্ত কমিটি গঠন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব  মো. শাহজাহান আলী মোল্লাকে প্রধান করে সাত সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়।জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব কাজী রওশন আক্তার স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।সেই সঙ্গে কমিটি আগামী সাতদিনের মধ্যে তদন্ত কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে হাইকোর্ট বিভাগে প্রতিবেদন দাখিল করবে।

শাহজাহান  মোল্লা বলেন, তারা সাত দিনের মধ্যে তদন্তের অগ্রগতির প্রতিবেদন আদালতকে দেবেন।নারায়ণগঞ্জের হত্যাকাণ্ডে র‌্যাবের সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠার পর হাই  কোর্ট পুরো ঘটনা তদন্তে সরকারকে একটি কমিটি গঠন করতে বলে।

বৃহস্পতিবার কমিটি বৈঠক করে তাদের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করেন। এরপর বিকালে নারায়ণগঞ্জ রওনা হওয়ার আগে সচিবালয়ে  সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন শাহজাহান  মোল্লা।  তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জের  যে স্থানে লাশ পাওয়া  গেছে,  সে স্থান আজ পরিদর্শন করা হবে,শনিবার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলা হবে।

গত ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ করা হয়, তিন দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীতে তাদের লাশ পাওয়া যায়।এই হত্যাকাণ্ডে র‌্যাবের সম্পৃক্ততার অভিযোগ এবং এতে আইনশৃঙ্খলা বা প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তার গাফিলতি ছিল কি না, তা খতিয়ে  দেখবে এই কমিটি।কমিটি গঠনের সাতদিনের মধ্যে অগ্রগতির প্রতিবেদন দিতে বলেছে হাই  কোর্ট।

মূল তদন্ত প্রতিবেদন কত দিনের মধ্যে দেয়া হবে- জানতে চাইলে শাহজাহান  মোল্লা বলেন,যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা দেয়া হবে।তদন্তে  কোন বিষয়টি প্রাধান্য দেয়া হবে- সাংবাদিকদের এই প্রশ্নে তিনি বলেন, কর্মপরিধিতে যা আছে তার মধ্যেই থেকে তদন্ত করা হবে হাই  কোর্টের নির্দেশনায়।এর আগে বৃহস্পতিবার সকালে তদন্ত কমিটি বৈঠকে বসে এই তদন্তের কার্যপ্রনালী নির্ধারণ করে।

তদন্ত কমিটির প্রধান শাহজাহান আলী  মোল্লা সাংবাদিকদের বলেন, আমরা সরকারি কর্মকর্তা। ভিকটিমদের বক্তব্যসহ আমরা সব কিছুকেই গুরুত্ব দিব।আমাদের তদন্তে নিরপেক্ষতা থাকবে।সেনাবাহিনী থেকে চাকরি হারানো র‌্যাব-১১ এর সাবেক সিও (অধিনায়ক) তারেক সাঈদ  মোহাম্মাদ সরকারের একজন মন্ত্রীর জামাতা, তার বিরুদ্ধেই গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে চাপ উপেক্ষা করে সুষ্ঠু তদন্ত ককরতে পারবেন কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তদন্ত কমিটি প্রধান বলেন, আমরা আশাবাদি। চাপের উর্ধ্বে  থেকে তদন্ত করবো।অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের কি কি বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছি তা আগামীতে জানতে পারবেন। এখনই সব কিছু বলা যাবে না।

উল্লেখ্য, ২৭ এপ্রিল ঢাকা নারায়ণগঞ্জ লিংক  রোড  থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে নাসিকের ৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও অ্যাডভোকেট চন্দন সরকারসহ  সাতজনকে আলাদাভাবে অপহরণ করা হয়। এ বিষয়ে মামলা দায়েরের তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের শীতালক্ষা নদী থেকে অপহৃত ছয় জন এবং এর একদিন পর আরও একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।

এদিকে, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় জড়িত থাকার সন্দেহে আরো তিনজনকে  গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার তিনজনের মধ্যে একজন নারী রয়েছেন। তাদের নাম জানালেও তদন্তের স্বার্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার খন্দকার মুহিদ উদ্দিন।

বৃহস্পতিবার সকালে কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ সাতজনকে অপহরণ এবং যেখানে তাদের লাশ পাওয়া গিয়েছিল ওই দুটি স্থান দেখে এসে নিজের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি।

এসপি মুহিদ জানান, বৃহস্পতিবার  ভোরে মিন্টু, মাসুমা ও টিপু নামে তিনজনকে  গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের দুজনকে নরসিংদী থেকে  গ্রেপ্তার করা হয়।চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার সন্দেহে নারায়ণগঞ্জে এর আগে ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে নূর  হোসেন ও হাজি  মো. ইয়াসিনসহ মামলার আসামিদের  কেউ এখনো  গ্রেপ্তার হয়নি।

তিনজনের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সুপার বলেন, তদন্তের স্বার্থে  বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়। স্বচ্ছ তদন্তের জন্য আমরা অনেককেই  গ্রেপ্তার করব, অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করব, অনেককে আটক করব।  সেগুলো সময়মতো আপনারা (সাংবাদিকরা) জানতে পারবেন।

তিনি জানান, নিহত আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারের জামাতা বুধবার ফতুল্লা থানায় একটি মামলা করেছেন। তবে এতে আসামি হিসেবে কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি।গত ২৭ এপ্রিল চন্দনের পাশাপাশি কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ সাতজনকে অপহরণ করা হলে নজরুলের পরিবার একটি মামলা করে, যাতে কাউন্সিলর নূর  হোসেন, আওয়ামী লীগ নেতা হাজি মো. ইয়াসিনসহ সাতজনকে আসামি করা হয়।

অপহৃতদের লাশ উদ্ধারের পর অপহরণের ওই মামলাটি হত্যামামলায় রূপান্তরিত হয়েছে। এখন দুটি মামলা একসঙ্গে তদন্ত করছে গোয়েন্দা পুলিশ।

প্রথমে ফতুল্লা মডেল থানার এসআই  ফজলুল হক তালুকদার এই মামলা তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন। পরে  জেলা  গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) আব্দুল আউয়ালকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়।হত্যাকাণ্ডে র‌্যাবের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠায় এই বাহিনীকে তদন্ত সংক্রান্ত কাজ  থেকে দূরে রাখতে বলেছে আদালত।

তবে আউয়ালের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেনের সখ্যের অভিযোগ নজরুলের পরিবার তোলার পর বুধবার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করে ডিবির ওসি মামুনূর রশীদ মণ্ডলকে এই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।পুলিশ সুপার বলেন,আমি সবচেয়ে ভালো তদন্ত কর্মকর্তা খুঁজে দায়িত্ব দিয়েছি।

আটদিনে তদন্তের উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি আছে কি না -জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি একটি বড় আকৃতির পরিকল্পিত ও চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলা। এধরনের মামলার তদন্তের সময় যথেষ্ট পরিকল্পনা করে এগুতে হয়,  যেন কোনো ত্রুটি  থেকে না যায়।আমরা রাতারাতি কোনো বিপ্লবাত্মক তদন্ত করতে পারি না। একটু সময় লাগবে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক বিষয় জোড়া দিয়ে একটি স্বচ্ছ সিদ্ধান্তে  পৌঁছাতে একটু সময় লাগে।তদন্তে যথেষ্ট অগ্রগতি হলে এখনো সিদ্ধান্ত  দেয়ার মতো কিছু হয়নি বলে জানান মুহিদ উদ্দিন।