দৈনিক বার্তা : পরমুখাপেক্ষী হওয়ার প্রবণতা ত্যাগ করতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের প্রতি সমন্বিত প্রচেষ্টা চালাবার আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ভৌগলিক অবস্থান ও আল্লাহ প্রদত্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হিসেবে বাংলাদেশের প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতু বন্ধনের দেশ হওয়ার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তিনি নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।প্রধানমন্ত্রী বৃহস্পতিবার সকালে বাংলাদেশ সচিবালয়ে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে কর্মকর্তাদের সঙ্গে মত বিনিময়ে এ আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বক্তৃতা করেন। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবদুস সোবহান সিকদার, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব আবুল কালাম আজাদ ও বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন সচিব খোরশেদ আলম চৌধুরী এ সময় উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ বিমানের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) জামাল উদ্দিনসহ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সংস্থার প্রধানগণ ও সিনিয়র কর্মকর্তারাও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বের দীর্ঘতম বালুকাময় সমুদ্র সৈকত ছাড়াও এ বাংলাদেশে গভীর অরণ্য, ছোট-বড় পাহাড়, সমুদ্র ও ধর্মীয় উপাশনালয়ের এক অনন্য সমন্বয় ঘটেছে। যা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে থাকে।প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাশ্চাত্যের পর্যটকদের জন্য অনন্য পর্যটন জোন হিসেবে কক্সবাজারকে গড়ে তুলতে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট অপারেটিং সুবিধাসহ কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দরে উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
তিনি জাতীয় পতাকাবাহী বাংলাদেশ বিমানের সেবার মান উন্নত করার ওপর গুরুতারোপ করে বলেন, বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশের প্রতীক হিসেবে এ বিমানকে বিবেচনা করা হয়।পর্যটন মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের শুরুতেই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা দেশকে এগিয়ে নেব। আমরা, আর কারো কাছে হাত পাততে চাই না।অন্যের কাছে হাত পাতার এই মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে।
পরমুখাপেক্ষী না হয়ে দেশকে কিভাবে উন্নয়নের কাক্ষিত লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়া যায়, সে চিন্তাই সবাইকে করার আহ্বান জানান তিনি।ভিক্ষুক জাতির ইজ্জত থাকে না- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই লাইনটি উদ্ধৃত করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ভিক্ষুক জাতি না। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি থাকার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অর্থনৈতিকভাবে আমরা মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছি।
অনুষ্ঠানের শুরুতে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন মন্ত্রণালয়ে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, এর আগে কোনো সরকার প্রধান এই মন্ত্রণালয়ে আসেনি। বেসামরিক বিমান পরিবহন এবং পর্যটন খাতের সম্ভাবনা বিকাশে কিছু বাধা রয়েছে জানিয়ে তা কাটিয়ে ওঠার কথা বলেন তিনি।
এই মন্ত্রণালয়ে নিজের প্রথম পরিদর্শনের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার প্রধান হিসাবে আমার কিছু দায়িত্ব থাকে। আর সবাই থাকলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারি।স্বাধীনতার পর পরই যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের পদক্ষেপের অংশ হিসাবে ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিমান পরিবহন বিভাগ সৃষ্টি করা হয়।
ওই বিভাগসহ জাহাজ চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় নামে একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করা হয়। বর্তমানে এটি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় হিসেবে পুনর্গঠিত হয়েছে।১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি আকাশপথে পরিবহন সংস্থা হিসাবে বাংলাদেশ বিমানের জন্ম হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ বিমানের প্রতি এতই আন্তরিক ছিলেন যে, এর লোগো তৈরি এবং চূড়ান্তকরণ তিনি নিজে তদারকি করেন।মাঝখানে ব্যত্যয় ঘটেছিল, দেখলাম ভালো লাগে না। তাই পুরনো লোগোতেই ফিরে গেছি,বলেন তিনি।১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে ডিপার্টমেন্ট অফ সিভিল এভিয়েশন (উঈঅ) এর অধীনে সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের এভিয়েশন কর্মকাণ্ডের সূচনা হয়। যা বর্তমানে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার বিমানবন্দরগুলোর মান উন্নীতকরণ, নিরাপদ বিমান অবতরণ এবং আন্তর্জাতিকমানের যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েছে।
বর্তমান অবস্থা থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আরো উন্নয়নের জন্য ৫৩১ কোটি ২৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ট্যাক্সিওয়ে লাইটিং সিস্টেম বসানো এবং বিমানবন্দরের ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হচ্ছে।এছাড়াও ১৮৮ কোটি ২১ লাখ টাকা ব্যয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রানওয়ের ওভারলে-এর প্রকল্প জুন মাসে শেষ হবে।
সরকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দ্বিতীয় রানওয়ে স্থাপনের কাজ হাতে নিয়েছে।কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করতে ৫৪৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্প হাতে নেয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এমন ব্যবস্থা নিচ্ছি, যাতে এই পর্যটন কেন্দ্রে আন্তর্জাতিক বিমান নামতে পারে।
যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে চারটি ৭৭৭-৩০০ ইআর’ উড়োজাহাজ বাংলাদেশ বিমানের বহরে যুক্ত হয়েছে। ২০১৫ সালের শেষে দুইটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলের উড়োজাহাজ সংগ্রহ করা হবে।বাংলাদেশ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সেতুবন্ধনের দেশ হতে পারে বলে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, বিমানের আরো উন্নয়নে তার সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে।সিলেট বিমান বন্দরে রি-ফুয়েলিং ব্যবস্থা দ্রুত চালু করার জন্যও নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।
বিমানের কোন কোন রুট লাভজনক হতে পারে- তা খুঁজে বের করার পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেখানেবেশিসংখ্যায় প্রবাসী বাঙালিরা থাকে সেখানেও বিমানের কার্যক্রম বাড়ানো দরকার।বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় সন্তোষ প্রকাশ করলেও তা আরো বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কারো জন্য অসামাজিক, সন্ত্রাসী ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশ ব্যবহার হোক, তা আমরা চাই না।
বাংলাদেশকে অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি হিসাবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাহাড়, সমুদ্র, নদ-নদী, ম্যানগ্রোভ বনভূমি আর সবুজেঘেরা সমতলের এমন সমারোহ বিশ্বের খুব কম দেশেই রয়েছে।
বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে ভিত্তি করে পর্যটন খাতের মাধ্যমে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করা সম্ভব বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।পর্যটন বিকাশের উদ্দেশে ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন গঠন করা হয়।
কক্সবাজারের দীর্ঘতম প্রকৃতিক সমুদ্র্র সৈকতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে আরো বিশদ পরিকল্পনা নেয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী মহেশখালীতে পর্যটকদের জন্য আবাসস্থান গড়ে তোলার পরামর্শ দেন।প্রধানমন্ত্রী বলেন, পর্যটক আকর্ষণ করতে আমরা নেপাল ও ভুটানের সাথে যৌথ উদ্যোগ নিতে পারি। সেটা কাজে লাগানো উচিত।তিনি বলেন, আমরা কিছু কিছু জায়গা বিদেশি পর্যটকদের জন্য সুনির্দিষ্ট করে দিতে পারি।সমুদ্রে সাঁতার কাটার সময়ে পর্যটকদের দুর্ঘটনা রোধে আরো সজাগ হওয়ার পরামর্শও দেন প্রধানমন্ত্রী।কে কোথায় নামতে পারবে- তা স্পষ্ট হওয়া উচিত।কোরাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের সৌন্দর্য রক্ষায় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে আরো পরিকল্পিত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশও দেন প্রধানমন্ত্রী।