1দৈনিক বার্তা : নারায়ণগঞ্জের আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও কাউন্সিলর নজরুলসহ সাতজনকে অপহরণের পর পরই তাঁদের মাথায় আঘাত করা হয়। এরপর তাঁদের গলায় রশি  পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার পর লাশ যাতে  ভেসে না উঠে,তাই নাভির নিচে ফুটো করে  দেওয়া হয়েছে। এসব হত্যার ঘটনায় এটাই স্পষ্ট হয়েছে খুনিরা  পেশাদার, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত।

নিহত ব্যক্তিদের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জেলা সিভিল সার্জন দুলাল চন্দ্র  চৌধুরীর কাছে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন দাখিল করেন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক  বোর্ডের প্রধান নারায়ণগঞ্জ জেলা হাসপাতালের আবাসিক চিকিতসক মো. আসাদুজ্জামান মিয়া।

জেলা সিভিল সার্জন দুলাল চন্দ্র  চৌধুরী জানান, ৩০ এপ্রিল রাত  থেকে সকালের মধ্যে সাতটি লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। ময়নাতদন্ত করার ৪৮  থেকে ৭২ ঘণ্টা আগে তাঁদের হত্যা করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন একটি বন্দর থানায় ও অপরটি  জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে পাঠানো হবে। জেলা সিভিল সার্জন আরও জানান, দক্ষ  পেশাদার ও প্রশিক্ষিত  লোকজন ছাড়া এমন হত্যাকাণ্ড সম্ভব নয়।

গত ২৭ এপ্রিল দুপুরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড  থেকে অপহূত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন। এর তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যায় একে একে ভেসে ওঠে সাতজনের মরদেহ।এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নূর  হোসেনকে প্রধান আসামি করে মামলা করেছে নজরুলের পরিবার।

প্রতিবেদন  পেয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সবাইকে ২৭ এপ্রিল বিকেলে অপহরণ করা হয়, তাই ধারণা করা হচ্ছে অপহরণের পর পরই তাদেরকে মাথায় আঘাতের পর গলায় রশি  পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। হত্যার আগের অজ্ঞান করার জন্য মাথায় আঘাত করা হয়। লাশ যাতে  ভেসে না উঠে তাই লাশের  পেট নাভীর নিচে ফুটো করে  দেয়া হয়েছে।৩০ এপ্রিল দুপুরের পর  থেকে শীতলক্ষ্যা নদী  থেকে অপহৃত ছয়জন এবং ১  মে সকালে বাকি একজনের মরদেহ একই নদী  থেকে উদ্ধার করা হয়।

এ ঘটনায় মহাসড়ক অবরোধ ও ৪৮ ঘণ্টার কর্মবিরতিসহ রোববার নারায়ণগঞ্জে হরতাল পালন করে  জেলা আইনজীবী সমিতি।অপহরণ ও হত্যার জন্য স্থানীয় র‌্যাব-১১- কে দায়ী করেন নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম ওরফে শহীদ  চেয়ারম্যান।

তিনি অভিযোগ করেন, ছয়  কোটি টাকার বিনিময়ে সাতজনকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়েছে। প্রধান আসামি কাউন্সিলর নূর হোসেন র‌্যাব ১১  কে ওই টাকা দিয়ে অপহরণ ও খুন করান বলে অভিযোগ করেন তিনি।তার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। মঙ্গলবার অভিযুক্ত তিন র‌্যাব সদস্যকে চাকরিচ্যুত করা হয়।এ ঘটনায় এ পর্যন্ত  মোট ১৬ জনকে  গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

এদের মধ্যে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী  মোফাজ্জল হোসেন  চৌধুরী মায়ার জামাতা  লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মাহমুদও রয়েছেন।তারেক সাঈদ র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক ছিলেন। সাতজনকে অপহরণের পর তাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে সরিয়ে এনে ওই দিনই সেনাবাহিনীতে ফেরত পাঠানো হয়েছিল।চাকরিচ্যুত অন্য দুজন হলেন- সেনাবাহিনীর  মেজর আরিফ  হোসেন এবং  নৌবাহিনীর  লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এমএম রানা। এই দুজনও নারায়ণগঞ্জে র‌্যাব-১১ এ কর্মরত ছিলেন।

হত্যাকাণ্ডে র‌্যাবের কেউ জড়িত থাকলেও ছাড় না দেয়া হবে না বলে মন্ত্রীদের বক্তব্যের মধ্যে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) বুধবার তিনজনকে অবসরে পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।আইএসপিআরের সহকারী পরিচালক (সেনা) রেজাউল করিম বলেন, সকালে সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্ট বিভাগ  থেকে তারেক এবং আরিফের অকালীন অবসরের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।তবে দুপুর পর্যন্ত আইএসপিআর  কোনো প্রজ্ঞাপন পায়নি বলে জানান তিনি।

এমএম রানাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়ার বিষয়টি নৌবাহিনী বাহিনী মৌখিকভাবে নিশ্চিত করলেও প্রজ্ঞাপন  দেয়া হয়নি বলে জানান আইএসপিআরের সহকারী পরিচালক ( নৌ) তাপসী রাবেয়া  লোপা।

গত ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুল, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ সাতজনকে র‌্যাব পরিচয়ে অপহরণ করা হয় বলে অপহৃতদের পরিবার অভিযোগ তোলে।

সেদিন র‌্যাব-১১ এর তৎকালীন অধিনায়ক তারেক সাঈদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তারা কাউকে আটক করেননি এবং এই ঘটনার সঙ্গে তার বাহিনীর  কোনো সংশ্লিষ্টতাও নেই।অপহরণের চাঞ্চল্যকর এই ঘটনার দুদিন পর নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার, দুটি থানার ওসির পাশাপাশি র‌্যাবের এই কর্মকর্তাদেরও প্রত্যাহার করা হয়।র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান সেদিনই বলেছিলেন যে লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদকে  সেনাবাহিনীতে  ফেরত পাঠানো হয়েছে।

এর পরের দিনই শীতলক্ষ্যা নদীতে অপহৃতদের লাশ ভেসে ওঠে, যাদের অপহরণের পরপরই হত্যা করা হয়েছিল বলে ময়না তদন্তকারী চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।

নিহত নজরুলের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম এরপর অভিযোগ তোলেন, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নূর হোসেন র‌্যাবকে ৬  কোটি টাকা দিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।

শহীদুল নাম উল্লেখ না করে চাঁদপুরের সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রিসভার এক সদস্যের স্বজন এক র‌্যাব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। ওই মন্ত্রীর এক ছেলে এই অর্থের লেনদেনে ছিল বলে তার অভিযোগ।গুরুতর এই অভিযোগ ওঠার পর র‌্যাব নিজ বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর তদন্ত করতে হাই কোর্টও সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে।স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, তদেন্ত যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হবে, তাদের ছাড়  দেয়া হবে না। র‌্যাবের মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান মঙ্গলবার সংসদীয় কমিটিকে আশ্বস্ত করেছেন, দোষী সদস্যদের রক্ষার  কোনো  চেষ্টা র‌্যাব করবে না।

প্রতিবেদক/জিএম/ফোকাস বাংলা/১৫০০ ঘ.