দৈনিক বার্তা: রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ৭৪ শতাংশ শ্রমিক এখনও কোন কাজে ফিরতে পারেননি। এর কারণ হিসেবে প্রায় ৬৪ শতাংশ ক্ষেত্রে শারীরিক সমস্যা এবং প্রায় ২৪ শতাংশ ক্ষেত্রে মানসিক বিপর্যয়জনিত (ট্রমা) সমস্যার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া প্রায় সাড়ে সাত শতাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, নিয়োগদাতারা রানা প্লাজা ধসের শিকার এমন লোকদের চাকরি দিতে চান না। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে রবিবার বেঁচে যাওয়া মোট ১ হাজার ৪৩৬ জনের ওপর জরিপ চালিয়েছে বেসরকারী সংগঠন এ্যাকশন এইড। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলওসহ দুটি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় এই জরিপ করা হয়েছে।
এ্যাকশন এইডের জরিপ প্রকাশের ওই অনুষ্ঠানে রানা প্লাজা দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে পোশাক শ্রমিকদের জন্য একটি স্থায়ী কল্যাণ ফান্ড করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এ রকম ফান্ড করা গেলে ভবিষ্যতে ভিকটিমরা সহজেই ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন। রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে একটি কার্যকরী সমন্বয় কমিটি করারও দাবি করা হয়েছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সব সদস্যের জন্য একটি করে ব্যাংক এ্যাকাউন্ট করার কথা বলা হয়েছে যাতে সবাই ক্ষতিপূরণ পান।
সংগঠনটির প্রকাশিত জরিপটির রিপোর্টে বলা হয়, ওই ঘটনার পর বেঁচে যাওয়া মোট ১ হাজার ৪৩৬ জনের ওপর জরিপ চালিয়ে তাঁরা দেখেছেন- তাদের মধ্যে ৭৩ দশমিক ৭ শতাংশই এখনও কোন কাজে ফিরতে পারেননি। জরিপে আরও বলা হয়, ঘটনার এক বছর পার হতে চললেও ওই ঘটনার শিকার যাঁরা হয়েছিলেন তাঁরা বা তাঁদের পরিবারের সদস্যরা এখনও কোন ক্ষতিপূরণ পাননি। তবে অনেকেই প্রধানমন্ত্রীর তহবিলসহ বিভিন্ন উৎস থেকে আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশে উৎপাদিত পোশাকে ক্রেতা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড এবং আইএলওর মতো কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা রয়েছে।
সরকারের দিক থেকে নিহত শ্রমিকদের পরিবার এবং আহত শ্রমিকদের যে অর্থ দেয়া হয়েছে, শ্রমিক নেতারা বলছেন সেটি ক্ষতিপূরণ নয়। শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের জন্য আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলও’র তত্ত্বাবধানে যে ‘রানা প্লাজা ডোনার ট্রাস্ট ফান্ড’ গঠন করা হয়েছে তার মূল লক্ষ্য হচ্ছে বিদেশী পোশাক ব্র্যান্ড এবং ক্রেতাদের কাছ থেকে অর্থ উত্তোলন করা।
ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়ে বিদেশী ক্রেতাদের দিক থেকে প্রত্যাশিত সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ তুলেছে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের বাংলাদেশ শাখা। এ নিয়ে ঢাকায় তারা একটি মানববন্ধন কর্মসূচীও ইতোপূর্বে পালন করেছে।
শ্রমিক নেতারা বলছেন, শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য রানা প্লাজা ডোনার ট্রাস্ট ফান্ডে এখনও পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক অর্থও আসেনি। এই সংগঠনের নেতা রায় রমেশ বলছেন, ট্রাস্ট ফান্ডে ৪০ মিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও এখন পর্যন্ত ১৭ মিলিয়ন ডলার এসেছে। এটিকে হতাশাজনক বলে বর্ণনা করেন শ্রমিক নেতা রায় রমেশ।
রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় যাঁরা নিহত হয়েছেন তাঁদের পরিবারগুলোর ৭৮৬ জন সদস্য এবং ওই ঘটনার শিকার হয়ে যাঁরা বেঁচে গেছেন তাঁদের মধ্যে ১ হাজার ৪৩৬ জনের ওপর এই জরিপটি চালায় এ্যাকশন এইড। রানা প্লাজা ডোনার ট্রাস্ট ফান্ডের আওতায় ক্ষতিপূরণ পাওয়ার লক্ষ্যে নিহত শ্রমিকদের পরিবার এবং আহত শ্রমিকরা এরই মধ্যে নাম নিবন্ধন শুরু করেছেন। মার্চ থেকে শুরু হওয়া এই নিবন্ধন প্রক্রিয়া আগামী দুইমাস চলবে। এরপর হিসাব-নিকাশ করে অর্থ সহায়তার পরিমাণ নির্ধারণ করা হবে।
এখন পর্যন্ত ট্রাস্ট ফান্ডে যে ১৭ মিলিয়ন ডলার এসেছে তার বেশিরভাগই দিয়েছে ইউরোপীয় ক্রেতারা। আমেরিকার ক্রেতাদের মধ্যে শুধু ওয়ালমার্ট রয়েছে বলে শ্রমিক নেতারা জানিয়েছেন। গত বছর ২৪ এপ্রিল ঢাকার কাছে সাভারে রানা প্লাজা নামের বহুতল ভবন ধসে পড়ে ১১শ’র বেশি লোক নিহত হন- যাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন ওই ভবনে থাকা পাঁচটি পোশাক কারখানার শ্রমিক।
আগামী ২৪ এপ্রিল বৃহস্পতিবার রানা প্লাজা দুর্ঘটনার এক বছর পূর্তি হচ্ছে। ওই দিন সামনে রেখে নিহত শ্রমিকদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনায় আজ সোমবার দুপুর ২টায় জুরাইন কবরস্থানে দোয়া ও মোনাজাতের আয়োজন করেছে বিজিএমইএ পরিচালনা পর্ষদ। ওই মোনাজাতে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মজিবুল হক চুন্নু, শ্রম সচিব এবং বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দের যোগ দেয়ার কথা রয়েছে। গার্মেন্টস শ্রমিক ও শিল্প রক্ষা জাতীয় মঞ্চ আগামী ২৪ এপ্রিল গার্মেন্টস শিল্পে শোক দিবস পালনের আহ্বান জানিয়েছে।
রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ নিয়ে সমন্বয়হীনতার অভাব রয়েছে বলে এ্যাকশন এইডের সংলাপে বক্তারা অভিযোগ করেন। তাদের মতে, এ বিষয় সংশ্লিষ্টরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করেননি। ফলে ক্ষতিপূরণ কেউ একাধিকবার পেয়েছে আবার কেউ কেউ কিছুই পায়নি। তাই ক্ষতিগ্রস্তদের জীবনমান উন্নয়নে একটি কার্যকরী সমন্বয় কমিটি থাকা দরকার বলে মনে করেন তাঁরা।
ভিকটিমদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে কী পরিমাণ টাকা জমা হয়েছে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করা উচিত বলে মনে করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপার্সন ড. হামিদা হোসেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ১২৭ কোটি টাকা জমা হয়েছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের দেয়া হয়েছে মাত্র ২২ কোটি টাকা। কী পরিমাণ টাকা জমা হলো আর কী পরিমাণ দেয়া হলো তা পরিষ্কার থাকা দরকার।
সংলাপে এ্যাকশন এইডের বাংলাদেশ প্রতিনিধি ফারা কবির, বিল্ডসের সহকারী পরিচালক সুলতান উদ্দিন আহমেদ, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সদস্য শিরিন আক্তার, বিকেএমইএর সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, ফায়ার সার্ভিসের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান, সিপিডি অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রতিনিধি শ্রীনিবাস রেড্ডি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল বাংলাদেশ কাউন্সিলের বাংলাদেশ প্রতিনিধি রায় রমেশ, জিআইজেডের প্রতিনিধি ড. আনিসুজ্জামান বক্তব্য রাখেন।
সংলাপে বক্তারা পোশাক শ্রমিকদের জন্য একটি স্থায়ী কল্যাণ ট্রাস্ট ফান্ড করার প্রস্তাব দেন। যাতে ভিকটিমরা সহজেই ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন। রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ নিয়ে সমন্বয়হীনতার অভাব রয়েছে বলে বক্তারা অভিযোগ করেন। এ বিষয় সংশ্লিষ্টরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করেননি। ফলে ক্ষতিপূরণ কেউ একাধিকবার পেয়েছে আবার কেউ কেউ কিছুই পায়নি। তাই ক্ষতিগ্রস্তদের জীবনমান উন্নয়নে একটি কার্যকরী সমন্বয় কমিটি থাকা দরকার বলে মনে করেন তাঁরা।
সেমিনারে এ্যাকশন এইডের জরিপে আরও বলা হয়, এখনও ৬৭ দশমিক ৭ শতাংশ শ্রমিক নিত্যপ্রয়োজন নিয়ে সমস্যা মোকাবেলা করছে। ২৬ শতাংশ শ্রমিক কিছু সমস্যায় ভুগছে, ৪ দশমিক ২ শতাংশ শ্রমিক নিত্যপ্রয়োজন মেটাতে সক্ষম নয়, ২ দশমিক ২ শতাংশ শ্রমিকের নিত্যপ্রয়োজন মেটাতে সমস্যা নেই।
এ্যাকশন এইডের জরিপে আরও বলা হয়, ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের পরিবারগুলোর দাবি এই মুহূর্তে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ১৩৫ টাকা দরকার। তবে কোন পরিবারে ২৫ হাজার থেকে ৬ লাখ টাকা এই মুহূর্তে দরকার। ৬২ দশমিক ৬ শতাংশ নিহত শ্রমিকের প্রতিনিধিরা ১ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা এই মুহূর্তে দাবি করেছে। ৪৫ প্রতিনিধি ২০-৫০ লাখ টাকা দাবি করেছে। জরিপে বলা হয়েছে, গত ১২ মাসে ৫৫টি পরিবার তাদের আয়ের উৎস খুঁজে নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
রানা প্লাজা এগ্রিমেন্ট সমন্বয় কমিটির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তবা কাজিজি বলেন, রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্ত তহবিল থেকে শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হচ্ছে। এর জন্য ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সব সদস্যের জন্য একটি করে ব্যাংক এ্যাকাউন্ট করার কথা বলেন। যাতে ক্ষতিপূরণ সবাই পান।
সিপিডি অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের হিসেবে যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা ছিল বিক্ষিপ্ত। তবে এই বিক্ষিপ্তভাবে নেয়া প্রচেষ্টাগুলোর সমন্বয়ের প্রয়োজন। তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের সবাইকে তহবিলের আওতায় আনতে হবে, যাতে কেউ বাদ না পড়ে। যে পোশাককর্মী নিহত হয়েছে অথচ তার কোন সঠিক তথ্য নেই। তবে কি ওই কর্মী ক্ষতিপূরণ পাবে না। এটা তো হতে পারে না। তাদের এই তহবিলের আওতায় আনতে হবে। যাতে ক্ষতিগ্রস্ত সবাই ক্ষতিপূরণ পেতে পারে।