দৈনিক বার্তা: অনেক দিন ধরেই জামেনাকে উত্ত্যক্ত করে আসছিল স্থানীয় যুবলীগ নেতা জুয়েল রানা। মাদরাসায় যাতায়াতের পথে জুয়েল কখনও তার পথ আটকাতো। কখনও জামেনাকে লক্ষ্য করে দূর থেকে অশ্লীল বাক্য ছুড়ে দিতো। জুয়েল একা নয়, সঙ্গে থাকতো তার সহযোগীরাও। প্রথমে কিছু দিন জামেনা বিষয়টি নীরবে সহ্য করে। পরে অতিষ্ঠ হয়ে পরিবারের সদস্যদের জানায়। পরিবার বিষয়টি জানায় থানা পুলিশকে। কিন্তু পুলিশ শুধু অভিযোগ গ্রহণই করেছে, না মামলা না জিডি কোনকিছু হিসেবেই নথিভুক্ত করেনি তা। লিখিত অভিযোগ নিলেও উত্ত্যক্তকারী জুয়েল রানার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। শেষে হয়রানি সইতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেয় জামেনা।
এদিকে জামেনার আত্মহননের পর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলে মঙ্গলবার রাতে জুয়েলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তবে আত্মহত্যার প্ররোচনায় নয়, জামেনার মামার দায়ের করা অপর একটি মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। অপরদিকে জুয়েল রানার বিরুদ্ধে যেন আত্মহত্যার প্ররোচনায় কোন মামলা না হয় তার জন্য স্থানীয় এক এমপি তদবির করছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
পুলিশের পল্লবী জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) কামাল হোসেন জানান, পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করছে। পহেলা বৈশাখ রাতে জুয়েল রানা ও নিহত কিশোরীর মামা আমীরের মধ্যে একটি হট্টগোল হয়েছিল। এ ঘটনায় আমীর বাদী হয়ে থানায় একটি মামলা করেছেন। মামলার মূল আসামি পল্লবী থানা যুবলীগের সেক্রেটারি জুয়েল রানা। তাকে গ্রেপ্তারের পর আদালতে সোপর্দ করে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
জামেনার পরিবারের অভিযোগের বিষয়টি স্বীকার করে এসি কামাল বলেন, প্রথম দিকে বিষয়টি আমাদের লিখিত জানালেও তারা জিডি করতে চাননি। লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করে সত্যতা পাওয়া যায়নি। কিন্তু ঘটনার পরে বিষয়টিকে বড় করে তদন্ত করছি।
গতকাল পল্লবীর বাউনিয়া বাঁধ এলাকার ২০ নম্বর রোডের ডি ব্লকের ২০/২৪ নম্বর বাসায় গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে বসে কাঁদছিলেন আর বিলাপ করছিলেন নিহত জামেনার মা ফিরোজা বেগম।
নিহতের পিতা আবদুল মজিদ বলেন, ‘আমার মেয়ে বাউনিয়া বাঁধ ইসলামিয়া আলিম মাদরাসায় ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী ছিল। ছাত্রী হিসেবে সে খারাপ ছিল না। প্রতিদিন সে মাদরাসায় যেত। প্রায় ছয় মাস ধরে পল্লবীর থানা ছাত্রলীগের সেক্রেটারি জুয়েল রানা তাকে বিভিন্নভাবে উত্ত্যক্ত করে আসছিল। অশ্লীল প্রস্তাব দিতো। কখনও আবার মোটরসাইকেলে তার পিছু নিতো। তিনি বলেন, মাদরাসা থেকে বাড়িতে আসতে পথে পথে বাধা দিতো। স্থানীয় অনেকেই বিষয়টি খেয়াল করলেও জুয়েল প্রভাবশালী হওয়ার কারণে কেউ তাকে কোন কথা বলার সাহস পেত না। অনেক দিন আমার মেয়ে বিষয়টি লজ্জায় কাউকে জানায়নি। মুখ বুজে সহ্য করে গেছে। পরে গত ১২ই এপ্রিল আমরা বিষয়টি পল্লবী থানায় জানাই। কিন্তু পুলিশ কোন অ্যাকশন নেয়নি। পুলিশ অ্যাকশন নিলে আমার মেয়েটাকে হারাতে হতো না।
তিনি বলেন, লিখিত অভিযোগটি পল্লবী থানার এসআই মো. ফারুকের কছে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ রহস্যজনকভাবে জুয়েল রানার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। বাড়ির পাশের একটি মাঠের মাটি কাটার চুক্তি নিয়ে আমার স্ত্রীর ছোট ভাই আমীর হোসেনের সঙ্গে জুয়েল রানার দীর্ঘদিন ধরে শত্রুতাও রয়েছে।
নিহতের ভাবী রোজিনা বেগম জানান, ‘জামেনা তার ব্যক্তিগত বিষয়গুলো আমার কাছে সব খুলে বলতো। সবাইকে বলতো না। প্রায় ১ মাস আগে সে আমাকে জানায়, জুয়েল ও তার পোলাপানে তাকে বিরক্ত করে। অবৈধ প্রস্তাব দেয়। যা বলার ভাষা নেই। বিষয়টি পরিবারের কর্তাদের কাছে আমাকে সে জানাতে বলে। কিন্তু আমি লজ্জায় কয়েকদিন ধরে কাউকে কিছু বলতে পারি না। প্রায় ১০ দিন আগে আমি আমার স্বামী (জামেনার ভাই) কে বলি। এরপর বিষয়টি থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়।
নিহতের মামা আমীর হোসেন জানান, ‘প্রায় ছয় মাস আগে বাড়ির পাশের একটি মাঠের মাটি কাটার টেন্ডার আমার নামে হয়েছিল। আমি কোন দলের সঙ্গে জড়িত নই। ওই টেন্ডার আমার কাছ থেকে বাগিয়ে নেয়ার জন্য পল্লবী থানার যুবলীগের সেক্রেটারি জুয়েল রানা বিভিন্নভাবে চাপ দিতে থাকে। কিন্তু, কোন লাভ হয়নি।
তিনি আরও বলেন, ‘কিছুদিন আগে জুয়েল আমাকে তার একটি রিভলভার মাথায় ঠেকিয়ে বলে ‘তুই আমার টেন্ডার ছিনতাই করছস। তোর ভাগ্নি জামেনাকে আমি ধর্ষণ করে প্রতিশোধ নেবো। আমার কিছুই হইবে না। সরকারি দলের লোক। পারলে কিছু করিস। তখন থেকে জুয়েল রানা ও তার সহযোগীরা আমার ভাগ্নি জামেনা আক্তারের পিছনে লেগে থাকতো। মাদরাসায় গেলে তারা অশ্লীল কথা বলতো। জামেনা মুখ বুজে সব সহ্য করতো। কিন্তু, কারও কাছে কিছু বলেনি। জুয়েলের ইভটিজিং সইতে না পেরে আমার ভাগ্নি আত্মহত্যা করেছে।
তিনি আরও জানান, ‘পহেলা বৈশাখ রাতে আমার সঙ্গে জুয়েলের কথা কাটাকাটি হয়। এ সময় সে আমাকে হত্যার হুমকি দেয়। এ ঘটনায় ওই দিন রাতেই আমি থানায় হত্যার হুমকি দেয়ার অভিযোগে একটি মামলা করি। তাকে ওই মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমার ভাগ্নিকে ইভটিজিং করে আত্মহত্যার প্ররোচনা দেয়ার অপরাধে আরেকটি মামলা আজ বুধবার (গতকাল) রাতে করবো।
স্থানীয় বাসিন্দা ও কাঁচামাল ব্যবসায়ী হাসমত আলী মোল্লা অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার এক প্রতিবেশীর মেয়ে জামেনা। অত্যন্ত নম্র মেয়ে ছিল। সে যে এভাবে মারা যাবে কেউ তা কল্পনা করতে পারেনি। তিনি আরও বলেন, ‘পল্লবীর যুবলীগের সেক্রেটারি জুয়েল রানা ও তার লোকজনের জ্বালায় বসবাস করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাদক ব্যবসা, এলাকায় বিভিন্ন চাঁদাবাজি, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার নেতৃত্ব দিতো জুয়েল রানা। স্থানীয় এমপির সঙ্গে জুয়েলের ভাল সম্পর্ক থাকার কারণে কেউ কোন কথা বলার সাহস পেতো না। তিনি জুয়েল ও তার সহযোগীদের বিচার দাবি করেন।
বাউনিয়া বাঁধ ইসলামিয়া আলিম মাদরাসা অধ্যক্ষ সৈয়দ আবু সুফিয়ান জানান, ‘জামেনা ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়তো। এ শ্রেণীতে মোট ৩৭ জন শিক্ষার্থী ছিল। তার মধ্যে জামেনার রোল নম্বর ছিল ১৭। জামেনা অত্যন্ত ভদ্র ও নম্র ছিল। দৌড়ঝাঁপ করতো না। ক্লাসে এসে চুপ করে বসে থাকতো। অত্যন্ত লাজুক ছিল। তিনি বলেন, ঘটনার পর মাদরাসার সকল শিক্ষক তাকে দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাই। মাদরাসার সামনে ক্ষমতাসীন দলের কিছু পোলাপান সবসময় আড্ডা দেয়। তাদের রোষানলে না পড়ার জন্য কিছু বলতে পারি না। তবে শিগগিরই এ বিষয়ে মাদরাসা কমিটির পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।