4মা ও দুই মেয়ের কোনও সিনেমাই তাঁরা দেখেননি। এলাকায় তিন-তিন জন নায়িকা এসেছেন, এই খবরটা শুনে মঙ্গলবার দুপুর থেকেই মেজিয়ার বাগানগড়া এলাকায় পিচ রাস্তার ধারে ভিড় জমিয়েছিলেন আনন্দ কেওড়া, সুনীল কেওড়া, চন্দন পালেরা। তাঁদের মতোই আরও কয়েকশো লোক ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন আধঘণ্টারও বেশি সময়।

বিকেল পৌনে পাঁচটা নাগাদ হুডখোলা জিপটা ঢুকতেই ‘ওই যে আসছে’ বলে রব উঠল ভিড়ের মধ্যে। সবাই ছুটে গেলেন জিপের দিকে। জিপের পিছনেও কাতারে কাতারে লোক। জিপে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছেন বাঁকুড়া লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী মুনমুন সেন। দুই পাশে তাঁর দুই মেয়ে রিয়া ও রাইমা। জিপের পাশে পাশেই ছুটছিলেন আনন্দ, সুনীলরা। এঁদের চেনেন? প্রশ্নটা শুনে হাঁফ ধরা গলায় তাঁদের জবাব, “হ, চিনি।” কে বলুন তো? সুনীল বললেন, “ওই মাঝে যে নায়িকা (মুনমুন) দাঁড়িয়ে আছে, সে-ই তো উত্তম কুমারের সঙ্গে ছবি করেছে!”

জিপের পাশে থাকা ব্যান্ড পার্টি তখন আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে সুর তুলেছে ‘এই পথ যদি না শেষ হয়…’। জিপের কাছে থাকা এক তৃণমূলকর্মীর মন্তব্য, “ভাগ্যিস মুনমুনদি কথাটা শোনেননি!”

এগারো দিন পরে রোড-শো’এর মাধ্যমে মুনমুন ফের পা রাখলেন বাঁকুড়ায়। দুই মেয়েকে নিয়ে তিনি কবে আসবেন, মুনমুনের প্রার্থিপদ ঘোষণার পর থেকেই জেলার তৃণমূল কর্মীদের বড় অংশের মধ্যেই তা নিয়ে কৌতূহল ছিল তুঙ্গে। সুচিত্রা-তনয়া আসছেন দুই মেয়েকে নিয়েই, এই খবরটা ছড়িয়ে পড়েছিল মঙ্গলবার সকাল থেকেই। ফলে, মুনমুনের রোড-শো ঘিরে উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো। বাঁকুড়া শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে রোড-শো করলেও শহর থেকেও তৃণমূলের নিচুতলার অসংখ্য কর্মী মেজিয়ায় গিয়েছিলেন।

এ দিন বিকেল ৪টে নাগাদ কলকাতা থেকে সরাসরি দুই মেয়েকে নিয়ে মেজিয়া পৌঁছে যান মুনমুন। বাগানগড়া এলাকার একটি কালীমন্দিরে মায়ের সাফল্য কামনা করে পুজো দেন রিয়া-রাইমা। সামান্য বিশ্রাম নিয়েই শুরু হয় রোড-শো। মেজিয়া ব্লকের বাগানগড়া থেকে শুরু হয়ে মেজিয়া বাজার, শ্যামাপুর ঘুরে লাগোয়া গঙ্গাজলঘাটি ব্লকের দুর্লভপুরে শেষ হয় রোড-শো। মুনমুনের গোটা যাত্রাপথেরই সঙ্গী ছিল তুমুল ভিড়। সেই ভিড়ে ছেলেছোকরা যেমন ছিল, তেমনই ছিলেন বাড়ির বধূ থেকে শুরু করে কচিকাঁচা ও বয়স্করা। সবচেয়ে বেশি উৎসাহ ছিল মেয়েদের মধ্যে। মমতা শর্মা, সোনালি বাগদির মতো গৃহবধূদের কৌতূহল, “বাব্বা, কী গায়ের রং! ওঁরা এত ফর্সা কী করে?”
5
মেজিয়া বাজার ও দুর্লভপুরেও জিপ ঘিরে দৌড়তে থাকে জনতা। ভিড় সামলাতে হিমশিম খেয়ে যান জেলা তৃণমূল কো-চেয়ারম্যান অরূপ চক্রবর্তী ও জেলা যুব তৃণমূলের সভাপতি শিবাজি বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁদের সঙ্গীদের কারও প্যান্ট ছিঁড়েছে, কারও ফেঁসেছে পাঞ্জাবি। কেউ আবার ভিড়ের চাপে হারিয়েছেন জুতো।
এখানেই হয়রানির শেষ নয়। মেজিয়া ছাড়ার কিছুটা পরেই জামকুড়ি এলাকায় বিগড়ে গেল মুনমুনদের জিপই! ও দিকে ভিড় তখন এমন বেড়েছে, যে জিপ দাঁড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করেন তৃণমূলের নেতারাই। তড়িঘড়ি মা-মেয়েদের নামিয়ে তুলে দেওয়া হয় অন্য গাড়িতে। নায়িকাদের দেখতে না পেয়ে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। মুনমুন অবশ্য নিরাশ করেননি জনতাকে। বিভিন্ন জায়গায় গাড়ি থামিয়ে নামেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথাও বলেন। তাঁর দুই মেয়ে সমানে সবার উদ্দেশে হাত নেড়েছেন।

মেজিয়ার নন্দনপুরে মুনমুন কাছে ডেকে নেন দুলালি বাউরি, সারথি বাউরিদের। তাঁদের হাত ধরে বলেন, “আমার মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করুন, যাতে আমি জিতি। আমি আবার আসব আপনাদের কাছে।” গাড়ি চলে যাওয়ার সারথি, দুলালিরা বললেন, “সিনেমার নায়িকাকে ছুঁলাম, ভাবতেই এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না।” নায়িকাকে চেনেন? সমস্বরে জবাব এল, “না।”
6
ইতিমধ্যে হুডখোলা অন্য একটি গাড়ির বন্দোবস্ত করে ফেলেছেন জেলার তৃণমূল নেতারা। দুর্লভপুর আসার কিছু আগে সেই গাড়িতে চেপে ফের শুরু হয় রোড-শো। দুর্লভপুরে ততক্ষণে যেন জনসমুদ্র। যে দিকে তাকানো যায়, থিকথিক করছে মানুষের মাথা। বাড়ির ছাদে, বারান্দায়, রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির মাথায় সর্বত্র লোক। অত্যুৎসাহী কিছু লোক পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে গাড়িতে ওঠার চেষ্টা করতেই বাধা দিলেন গঙ্গাজলঘাটি পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি জিতেন গরাই। বললেন, “চিন্তা করবেন না। উনি ভোটে জিতে আবার আপনাদের কাছে আসবেন।” কিন্তু, এ সব কথা শুনছে কে? জনতা শুধু ছুঁতে চাইছিল তিন জনকে।