দৈনিক বার্তা: বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ, এ উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রায় নেমেছে মানুষের ঢল। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই মিলেছে প্রাণের উৎসবে। রঙ-বেরঙের দেশীয় পোশাক আর লোকজ ঐতিহ্য নিয়ে সমৃদ্ধির পথে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন। বাংলা নতুন বছরকে বরণ করে নিতে সোমবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শুরু হয় পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বর্ণাঢ্য এই শোভাযাত্রার শুভ উদ্বোধন করেন। মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিতে সকাল থেকে মানুষর ঢল নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছাপিয়ে ওপারে দোয়েল চত্বর থেকে এপারে পরীবাগ- সব দিক একাকার হয়ে যায় মানুষের উৎসবমুখর পদচারণায়।
আশেপাশের সকল রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ থাকায় জনারণ্যে পরিণত হয়েছে রমনা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, টিএসসি, শাহবাগসহ গোটা এলাকা। চৈত্র সংক্রান্তি শেষে বর্ষবরণের এ উৎসবে কেউ এসেছেন পরিবার পরিজনদের সাথে নিয়ে, কেউ কেউ এসেছেন যুগলভাবে। আবার অনেকেই এসেছেন দলবেঁধে। যে যেভাবেই আসুক না কেন দেশীয় পোশাক-পরিচ্ছদে সবাই বিশেষ পরিপাটি। বিশেষ করে তরুণ-তরুণী এবং শিশুরাই সেজেছে রঙিন সাজে। পঞ্জিকা গণনায় রোববার চৈত্র বিদায় নিলেও প্রকৃতিতে তার আধিপত্য রয়ে গেছে ষোলো আনাই। সকালের রোদেও কাবু হয়ে গেছেন কেউ কেউ। তারপরও প্রাণের এই উৎসবে উৎসাহের কমতি নেই। নারীরা সাদা জমিনে লাল পেড়ে শাড়ীতে খোপায় সাদা ফুল, আর পুরুষদের লাল-সাদা পাঞ্জাবি-পাজামার সাজের অনুকরণে শিশু-কিশোরেরাও সেজেছেন সেভাবে, যেন এক বর্ণিল বাংলাদেশ। সকাল নয়টায় চারুকলার সামনে থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রাটি শুরু হওয়ার কথা থাকলেও কিছুটা বিলম্ব ঘটে। কিন্তু তার আগেই চারুকলা প্রাঙ্গণ মুখর হয়ে উঠে দেশীয় বাদ্যের বাজনায়। ঢাক-ঢোল, খোল-কর্তাল, মন্দিরা, খঞ্জনির তালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং শোভাযাত্রায় অংশ নিতে আসা তরুণ-তরুণীরা নেচে-গেয়ে মাতিয়ে তোলে এই প্রাঙ্গণ। শোভাযাত্রাটি হয়ে উঠে ভিন্ন ব্যঞ্জনার। তবে কয়েক বছর ধরে প্রচলন ঘটা ভুভুজেলার বিকট শব্দে বারবারই ম্লান করে দিচ্ছিল দেশীয় বাদ্যযন্তের সুর-ছন্দ। ‘জাগ্রত করো উদ্যত করো নির্ভয় করো হে’ -এই স্লোগান এবার শোভাযাত্রার। শোভাযাত্রার সম্মুখভাগে বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্যের দিনটিতে রঙ-বেরঙের মুখোশ, শোলার পাখি, পেঁচা, প্রজাপতি, খরগোশ ও টেপা পুতুল, ঢাল-ঢোল-বাঁশি, লাঠি-বর্শা, তীর-ধনুক নিয়ে অংশ নেন মঙ্গলের যাত্রীরা। অতীতের দিনগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতা আর যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিতে উত্তপ্ত রাজপথে এবার কিছুটা স্বস্তি। এখন স্থিতিশীল বাংলাদেশ, এগিয়ে যাচ্ছে সমৃদ্ধির পথে। প্রতি বছরই একটি নির্দিষ্ট কাঠামোতে শোভাযাত্রার আয়োজন থাকে। গত বছর ফোক মোটিভ ছিল একটি দানবীয় সরীসৃপ, যাকে অশুভ শক্তি তাড়ানোর প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়েছিল। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগের আন্দোলনের সময়ই সরীসৃপটি তৈরী হয়েছিল। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের জন্ম শতবছর উদযাপন আর অতীতের জঞ্জাল ছাপিয়ে সমৃদ্ধির পথে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবার একটু ভিন্ন আঙ্গিকে এই শোভাযাত্রা। একটি বিশালাকতির হাঁস ছাড়াও স্ট্রাকচারে ১১টি মোটিভ ব্যবহার করা হয়েছে। শোভাযাত্রায় প্রধান ফোক মেটিভ বিশালাকৃতির হাঁস, সঙে মাছের ঝাঁক, মা ও শিশু, লক্ষ্মী পেঁচা- এগুলোকে সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে ধরা হয়েছে। বরাবরের মত লোকজ ঐতিহ্যের চিহ্ন থাকছে এবারের শোভাযাত্রায়। বিড়ালের মুখে চিংড়ি, দুটি বিশালাকৃতির বাঘের মুখোশ আর শখের হাড়ি- লোকজ ঐতিহ্যেরই প্রতীক। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ নতুন লক্ষ্য নিয়ে এগুতে গিয়ে যাতে পথ হারিয়ে না ফেলে সেজন্য দুঃসময়ের কাণ্ডারি হিসেবে রয়েছে গাজী ও বাঘ। বাংলাদেশের প্রতিটি ধুলিকণাও পবিত্র, আর পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে রয়েছে শিশু হরিণ। অপার সৌন্দর্যের এই বাংলাদেশ, আর বাংলাদেশের সৌন্দর্যকে শোভাযাত্রায় ফুটিয়ে তুলতে প্রতীক হিসেবে থাকছে ময়ূর। উন্নত শান্তি, সমৃদ্ধি এমন সব কিছুতেই যেন এক নম্বরে থাকে বাংলাদেশ, আর সেজন্য গাণিতিক ‘১’র প্রতীক একটি তুহিন পাখি থাকবে নববর্ষের শোভাযাত্রার সঙ্গী।