1দৈনিক বার্তা: বারো বছর আগে ভারতের গুজরাটে ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন যিনি, সেই নরেন্দ্র মোদীকেই আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে তাদের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে তুলে ধরেছে সে দেশের হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি।

নির্বাচনী প্রচারে তাঁকে তুলে ধরা হচ্ছে গুজরাটের উন্নয়নের প্রধান কারিগর হিসেবে – আর প্রাক-নির্বাচনী সব জনমত জরিপেই তাঁর নেতৃত্বে বিজেপি জোট এগিয়ে আছে।

দাঙ্গার তদন্তকারী দলও সম্প্রতি মি. মোদীকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে – কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে নেমে নরেন্দ্র মোদী কি পারছেন গুজরাটের গণহত্যার কলঙ্ক মুছে ফেলতে? দেশের সাধারণ মানুষই বা তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের সম্ভাবনাকে কী চোখে দেখছেন?

ডিমোলিশন ম্যান থেকে ডেভেলপমেন্ট ম্যান

তেষট্টি বছর বয়সী এক ধুরন্ধর রাজনীতিক দলের নির্বাচনী প্রচারসঙ্গীতে শপথ নিয়েছেন – ভারতকে কখনও মাথা নোয়াতে দেবেন না।

নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদী গত সাত-আট মাস ধরে দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত চষে বেড়াচ্ছেন অক্লান্তভাবে – এবং গুজরাটের টানা ১৩ বছরের মুখ্যমন্ত্রী এখন এগোচ্ছেন দেশের প্রধানমন্ত্রিত্বকে পাখির চোখ করে।

গুজরাটের উন্নয়নের কান্ডারী হিসেবে তাকে ঘিরে প্রচার চলছে – কিন্তু ওই রাজ্যে ২০০২-র ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার ক্ষতও কিন্তু তাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে!

কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিং মি মোদীর প্রবলতম সমালোচকদের একজন, তাঁর বক্তব্য হল তদন্তে রেহাই পেলেও দাঙ্গার সময় নরেন্দ্র মোদী যে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছিলেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর সে কারণেই প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী তাঁকে রাজধর্ম পালনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন!

“২০০৭-র পর থেকে গুজরাতের বাইরে সর্বভারতীয় নেতা হিসেবে তিনি নিজেকে তুলে ধরার চেষ্টা শুরু করলেন – আর তার হাতিয়ার করলেন গুজরাতের সার্বিক উন্নয়নের ছবিকে!”

নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়, নরেন্দ্র মোদীর জীবনীকার

কিন্তু ঘটনা এটাও, ২০১৪-র নরেন্দ্র মোদী নিজেকে সম্পূর্ণ নতুন মোড়কে পেশ করতে অনেকটাই সফল হয়েছেন – দেশের একটা বড় অংশ বিশ্বাস করছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য তিনিই যোগ্যতম।

মি মোদীর সমর্থকরা কেউ মনে করেন, গুজরাটে তিনি যে চমক দেখিয়েছেন গোটা ভারতেই সে ম্যাজিক দেখাবেন তিনি – আর উচিত শিক্ষা দেবেন পাকিস্তান-আমেরিকাকে। কেউ আবার নিশ্চিত, দেশের ভাল করার ক্ষমতা আছে একমাত্র তারই।

দাঙ্গা-কলঙ্কিত একজন রাজনীতিক থেকে দেশের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী – নরেন্দ্র মোদীর এই চমকপ্রদ উত্থানকে স্পষ্ট দুটো পর্বে ভাগ করা যায় – বলছিলেন তার জীবনীকার ও গবেষক নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়।

তিনি বলছিলেন, ”প্রথম পর্বে মি. মোদী গুজরাট দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, গুজরাতি অস্মিতা বা গর্বর কথা বলে এবং দক্ষিণপন্থী ভোটকে কনসলিডেট করেই গুজরাটের ম্যান্ডেট পান – এবং সেভাবেই ২০০২ ও ২০০৭র নির্বাচনে জেতেন।”

মি. মুখোপাধ্যায় আরও বলেন, ”দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০০৭-র পর থেকে গুজরাতের বাইরে সর্বভারতীয় নেতা হিসেবে তিনি নিজেকে তুলে ধরার চেষ্টা শুরু করলেন – আর তার হাতিয়ার করলেন গুজরাতের সার্বিক উন্নয়নের ছবিকে।”

এর মাধ্যমেই দাঙ্গা-কলঙ্কিত ‘ডিমোলিশন ম্যান’ থেকে নরেন্দ্র মোদীর রূপান্তর ঘটল উন্নয়নের কারিগর বা ‘ডেভেলপমেন্ট ম্যান’ হিসেবে – বলছিলেন নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়।

হিন্দুত্ব আর জনপ্রিয়তা

আসলে নিম্নবিত্ত গুজরাটি পরিবারের একটি ডাকাবুকো ছেলে – ছাত্র হিসেবে সাদামাটা, রেল ক্যান্টিনে চা-বেচে যার অনেকটা সময় কাটত – সেই সাধারণ ছেলেটিই যে অসাধারণ মুন্সিয়ানায় নিজেকে ভারতের পরিত্রাতা হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছেন তা কেউই অস্বীকার করতে পারছেন না।

যদিও নিন্দুকেরা বলেন, তার ভাবমূর্তি নির্মাণের ইমারতে অনেক ভেজাল আছে, ফেকু বা জালিয়াত বলে কম গালিগালাজও কম শুনতে হচ্ছে না নরেন্দ্র মোদীকে।

 

বিজেপি-র প্রচারে সর্বত্রই শুধুই মোদী

তার শিক্ষাদীক্ষা, অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও চলছে ব্যঙ্গবিদ্রূপ। তিনি নিজে কিন্তু নির্বিকার – এবং তার জনপ্রিয়তাও ক্রমবর্ধমান।

বিজেপি-তে তাঁর সতীর্থ নেতা অরুণ জেটলি যেমন বলছিলেন, ”সব জনমত জরিপেই মি. মোদী তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে বিরাট ব্যবধানে এগিয়ে। কাজের লোক হিসেবেই তাঁর পরিচয়। দলের কর্মীরা তাঁকে দেখেই সবচেয়ে উদ্বুদ্ধ হয়। ফলে বিজেপি তাঁকে যে ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরেছে, সেটা কিস্তিমাত করা একটা সিদ্ধান্ত!”

কট্টর হিন্দুত্ববাদী হিসেবে গোড়ায় জনপ্রিয়তা পেলেও এই নির্বাচনে সচেতনভাবেই হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে চলছেন নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু যেভাবে তিনি হিন্দুদের পবিত্র তীর্থস্থান বারাণসী থেকে ভোটে লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন – তাতে বার্তাটা মোটেও অস্পষ্ট নয়।

তবে উগ্র হিন্দুত্ব আর দাঙ্গার ছায়া মি. মোদীর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে কোনও বাধা কি না, সেই প্রশ্নে ভারত কিন্তু দ্বিধাবিভক্ত।

চাঁদনি চকের প্রবীণ মুসলিম পানওলার মতে, সমাজের জন্য তা মোটেও ভাল হবে না, কারণ যে লোক দাঙ্গায় মানুষের ভাল চায়নি সে কীভাবে দেশের ভাল চাইবে?

দিল্লির তরুণী আইটি প্রফেশনাল আবার মনে করছেন, শুধু দাঙ্গার ইস্যু খুঁচিয়ে তুলে লাভ নেই – কারণ ভারতে সব রাজনীতিকেরই ওরকম অতীত আছে।

দলের চেয়েও বড়?

এই বিতর্ক আর বিভক্তিরই যেন আর এক নাম নরেন্দ্র মোদী। প্রশাসক আর রাজনীতিক হিসেবে যার ভাবনাচিন্তা, কাজের ধারাও একেবারে আলাদা ধাঁচের – বলছিলেন জীবনীকার নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়।

 

মোদীর দাপটে বিজেপি-র প্রবীণ নেতারা এখন কোণঠাসা

”তিনি অনেকটা ইন্দিরা গান্ধীর মতোই স্বৈরতন্ত্রী স্বভাবের, অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী, প্রাতিষ্ঠানিক রীতিনীতি বা দলকেও মানেন না – খুব ঘনিষ্ঠ আস্থাভাজনদের নিয়ে নিজস্ব টিম তৈরি করে চলেন”, বলছিলেন মি মুখোপাধ্যায়।

আর নরেন্দ্র মোদীর কাজেকর্মেও রয়েছে ভীষণ গোপনীয়তার ব্যাপার – তাঁর দলের সদস্যরাও জানেন না অন্যদের কাজ বা দায়িত্ব ঠিক কী, ব্রিফ কী! আর তাঁর এই গোপনীয়তার কায়দাটা ঠিক আরএসএসের মতোই।

কিশোর বয়স থেকে আরএসএস বা সঙ্ঘের এই প্রচারক দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন কি না, তার উত্তর এখনও জানা নেই।

যেটা জানা আছে, নরেন্দ্র মোদীর রাজনৈতিক পরিচয়ে গুজরাত দাঙ্গার অধ্যায়টা রয়েই যাবে – সে তিনি যতই নিজেকে দেশের সেবক হিসেবে তুলে ধরুন না!

 

বিবিসি বাংলা