দৈনিক বার্তা: যেদিন সংবাদপত্র প্রকাশনা শুরু হয়েছে, সেদিনই মনে হয়, স্বাধীন মত প্রকাশ নিয়ে মতান্তর ও বিতর্কের সূচনা। সংবাদপত্র অথবা সাংবাদিকতা (ইংরেজিতে দু’টি মিলিয়ে এক কথায় প্রেস বলা যায়) স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হতে হবে এ কথাটি কেউ অস্বীকার করেন না। প্রশ্ন হচ্ছে দু’টি। প্রথমত: স্বাধীনতা বলতে কতখানি বা সীমারেখা কি তা জানতে হবে। কোন রকমের কাজকর্ম বা দায়িত্ব পালনে কারও অবাধ ক্ষমতা থাকতে পারে না। বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে যেসব মানবাধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, সেসবেও কতিপয় আইনি সীমা নির্ধারিত আছে। সংবাপত্রের ক্ষেত্রে এই আইনি সীমারেখাটি কোথায় অবস্থিত তা নিয়েই বিভিন্ন সময়ে বিভ্রান্তি ও বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। দ্বিতীয়ত সংবাদপত্র বা সাংবাদিকতার স্বাধীনতার স্বাধীনতা, প্রেস ফ্রিডম কার আওতাধীন থাকবে। অর্থাৎ যদি ক্ষমতাসীন শক্তি বা সরকার সাংবাদিকতার উপর বিধি-নিষেধ আরোপ না করেন তা হলে নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের দায়িত্ব কার?
অপরদিকে যদি সংবাদপত্রকে স্বাধীন করার, প্রেস ফ্রিডম নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হয় তবে কি ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে? সরকার বা ক্ষমতাসীন মহল সংবাদপত্রকে সকল বিধি-নিষেধের আওতা থেকে মুক্তি দিলেই কি সাংবাদিকতা স্বাধীন হবে? এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করার আগে আমাদের চিরাচরিত ভাবনাটির যে ব্যতিক্রম ঘটেছে তা জানতে হবে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বা ফ্রি প্রেস সংক্রান্ত জটিলতা সঙ্গে এতদিন জড়িত মালিক, সম্পাদক, সাংবাদিক ও সরকার। অতীতে আমাকে বহুবার একটি প্রশ্নের মোকাবিলা করতে হয়েছে। কার স্বাধীনতা চাই? আমার উত্তর ছিল কোন ব্যক্তির বা প্রতিষ্ঠানের নয়। পেশার স্বাধীনতা চাই। তা হলে প্রেসটির নিয়ন্ত্রণ বা অবাধ পরিচালনায় মূল দায়িত্বটি কার ওপর অর্পিত হবে। আমাদের দেশে সংবাদপত্র কর্মচারী ও সাংবাদিক নিয়োগ আইনের অধীনে প্রণীত ওয়েজ বোর্ড অনুযায়ী সংবাদপত্র প্রকাশের জন্য নির্ধারিত সকল মতামত, মন্তব্য, খবর এমনকি বিজ্ঞাপন ছাপানোর সকল দায়দায়িত্ব, নীতি-নির্ধারণের ক্ষমতা সম্পাদককে দেয়া হয়েছে। এমনকি সংবাদপত্রের কর্মী ও সাংবাদিক নিয়োগ, বরখাস্ত, শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণে ক্ষমতাও তাঁর উপর আইনত অর্পিত। বাস্তবে কি সেভাবে সংবাদপত্র স্বাধীন ও স্বচ্ছ পন্থা অনুসরণ করে পরিচালিত হয়? এই প্রশ্নটির উত্তর হচ্ছে, না, সম্পাদককে সংবাদপত্র ও মালিকের স্বার্থ যাতে বিঘ্নিত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়। আবার সংবাদপত্রের পাঠকের চাহিদার কথাও ভাবতে হয়। কারণ সংবাদপত্রের প্রচার তারাই নিয়ন্ত্রিত করেন। পছন্দ হলে কিনেন ও পড়েন। অপছন্দ হলে সেই পত্রিকার প্রচার সংখ্যা হু-হু করে নামতে থাকে। তবে কোন পত্রিকার মালিকই যদি সম্পাদক বনে যান তবে চিত্রটি হবে ভিন্ন, যা নিয়ে আলোচনা দু’-এক কথায় বা দু’চারটি বাক্যে পুরোপুরিভাবে করা যাবে না।
সম্পাদক-মালিক দ্বন্দ্বের বিষয়টি অতীতকালে কেউ বিবেচনায় আনেননি। কারণ তখন সংবাদপত্র প্রধানত রাজনীতির বাহন ছিল, মিশন বা আদর্শের অনুসরণে প্রকাশিত হতো। পরে সেই মিশন বা আদর্শ থেকে জন্ম নিলো প্রফেশন বা পেশা। সাংবাদিকেরা কোন বিশেষ আদর্শের অনুসারী নয়, পেশাগত দায়িত্ব পালনকেই অগ্রাধিকার দিলেন। কিন্তু পেশা অনুসরণের মাধ্যমটি তাদের হাতে রইলো না। তাই পেশাদারীকে কাজে লাগানোর জন্য সাংবাদিকতায় ব্যবসাহারী শুরু হলো ইংরেজিতে যাকে বলে কমার্শিয়ালিজম। অপরদিকে সাধারণ মানুষের মাঝে ভোগ্যপণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধির সংবাদ মাধ্যমের প্রয়োজন বা চাহিদা বেড়ে গেল। পণ্যের বাহন হয়ে গেল সংবাদপত্র ও অন্যান্য গণমাধ্যম। সংবাদপত্র ব্যবসায়ে ব্যবসাদার বা পুঁজিবাদীরা কোটি কোটি টাকা ঢালতে লাগলেন। ফলে টাকার যে ঢল নামলো তা একদিকে যেমন সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের আর্থিকভাবে লাভবান করলো ঠিক তেমনি অর্থবানদের ইচ্ছাধীন করলো, পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলো। সাংবাদিকতা বা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নতুন হুমকি হলো এই কমার্শিয়ালিজম বা ব্যবসাহারীর প্রসার। বর্তমানে তথাকথিত বাজার অর্থনীতিতে এই নতুন উপসর্গটি আরও প্রকট হয়ে গেল।
আরও কয়েকটি উপসর্গ সংবাদপত্র জগতে অনুপ্রবেশ করলো যার একটি হলো ব্ল্যাক মানি। (১) মাননীয় অর্থমন্ত্রী খোঁজ রাখেন না বর্তমানে সংবাদপত্র প্রকাশে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে। সেই টাকা কোত্থেকে আসছে। জমি কিনতে আয়কর দিতে হয়, প্রতিটি উপার্জনের সূত্র জানাতে হয়, লগ্নি করতে গেলে রাজস্ব বোর্ডের হাজারও প্রশ্নের জবাব দিতে হয়, কোটি টাকার ছাপার মেশিনের টাকা কোত্থেকে এলো তা কেউ জিজ্ঞেস করবে না। অপরদিকে এই কোটি কোটি টাকা বাজার থেকে তুলে আনতে হবে। সেই বাজারটি যাদের দখলে তাদের স্বার্থবিরোধী কোন খবর বা প্রতিবেদন পত্রিকায় প্রকাশ করা যাবে না। সাধারণ একটি উদাহরণ দিয়ে বক্তব্যটি খোলাসা করছি। মোবাইল ফোনের সিম কার্ডে ট্যাক্স বসলে কাগজে দিনের পর দিন প্রতিবেদন ছাপা হয়। অথচ মোবাইল কোম্পানিগুলো যে উচ্চহারে কলরেট আদায় করে- সাধারণ মানুষের সেই দুর্ভোগ লাঘবে কোন পত্রিকায় কি সিরিজ ছাপা হয়েছে? কত হাজার কোটি টাকা বিদেশী কোম্পানিগুলো পাচার করছে সেই খবর কি পত্রিকায় ছাপা হয়? হয় না এবং হবে না, কারণ বছরে তারা শ’ শ’ কোটি টাকার বিজ্ঞাপন দেয়। এই বিজ্ঞাপনের টাকা জনগণের পকেট কেটে কেটে আদায় করা হচ্ছে। তা হলে জনগণের পক্ষে লেখার পূর্ণ স্বাধীনতা কোথায় সাংবাদিকের? কত কথা বলা হয় সরকারের কারও সংবাদপত্র সম্পর্কীয় কোন বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। অথচ ভোক্তা কোম্পানিগুলো কি মাল গছাচ্ছে সাধারণ ক্রেতাকে তা নিয়ে লেখালেখি নেই। পানীয় বোতলে কি খাচ্ছি আমরা, এ নিয়ে কোন অনুসন্ধানী রিপোর্ট কেউ করেন না। কারণ লেখার সেই স্বাধীনতা কোটি টাকার বিজ্ঞাপন দিয়ে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বা দেশীয় উৎপাদক কিনে নিয়েছে।
আরেকটি উদাহরণ দেবো ঢাকার জলাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা করে। ঢাকা শহরের আশপাশের জলাভূমিতে ঢাকা শহর থেকে নিষ্কাশিত পানি জমা হ’ত। মতিঝিলে ঝিল ছিল, খাল-নালা ছিল। সর্বত্র বেড়ে উঠেছে হাউজিং কোম্পানি। শুধু লেখা হয় ঢাকা শহরের খাল ভরাট করে বস্তি উঠেছে। কিন্তু খাল পরিষ্কার করে পানি বের করতে পারলে তা নিয়ে কোথায় ফেলবে? এ নিয়ে লেখা হবে না, সাংবাদিকের স্বাধীন কলমটি নয়, সেই কলমধারীকে যিনি মাসের শেষে বেতন দেন তিনি হাউজিং ব্যবসা করেন অথবা অন্য ব্যবসায়ীদের মডেল টাউনের পূর্ণ পৃষ্ঠা বিজ্ঞাপন ছাপান।
আরও কিছু অপ্রিয় কথা লেখা যায়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এখন নিয়ন্ত্রিত নয়, বিক্রি হয়ে গেছে। পশ্চিমা জগতে এখন এমবেডেড জার্নালিজমের কথা শোনা যায়। আমাদের হলো এমবেডেড সংবাদপত্র ভুবন। সরকারের চোখরাঙানি, পুলিশের পিটুনি, আর আইনি বিধিনিষেধের মোকাবিলা করে স্বাধীন সংবাদপত্র টিকে থাকবে! কিন্তু তাদের স্বাধীনতা যে বিভিন্ন স্বার্থের কাছে বাঁধা পড়ে গেছে। এ অবস্থায় পেশাদারী আদর্শের অনুসারী স্বাধীন সাংবাদিকতা নয়, পুঁজিবাদী দুনিয়ায় মুক্ত বাজারনীতিতে কতখানি স্বাধীনতার কথা বলা যাবে তা নিয়ে ভাবতে হবে।