4
বৈঠকের পর নিজের হাতে সাংবাদিকদের চা খাওয়ালেন মুখ্যমন্ত্রী। মঙ্গলবার দুর্গাপুরে

দৈনিক বার্তা: সংঘাতের রাস্তা ছেড়ে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ মেনেই নিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে মঙ্গলবার রাতে দুর্গাপুরের একটি হোটেলে সাংবাদিক সম্মেলন করে তিনি জানিয়ে দিলেন, ঘোরতর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন এক জন জেলাশাসক ও পাঁচ জেলার এসপি-কে সরানোর যে নির্দেশ দিয়েছে, তা তিনি মেনে নিচ্ছেন। আজ, বুধবার সকালেই বদলি কার্যকর করা হবে বলে নবান্ন সূত্রে খবর। যদিও ভোট চুকলেই ওই সব অফিসারেরা নিজের নিজের পদে ফিরে আসবেন বলে এ দিন ঘোষণা করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।

সোমবার শেষ দুপুরে কমিশনের নির্দেশ জানার পরে মুখ্যমন্ত্রী ‘চ্যালেঞ্জ’ ছুড়ে দিয়ে বলেছিলেন, তিনি ওই নির্দেশ মানবেন না। প্রয়োজনে তিনি জেলে যেতেও প্রস্তুত। কিন্তু কোনও অফিসারকে সরানো হবে না। তাঁর নির্দেশে কমিশনকে তার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার আর্জি জানানো হবে বলে ঠিক হয়। সেই মতো মঙ্গলবার সকালেই মুখ্যসচিবের চিঠি পৌঁছয় দিল্লিতে, কমিশনের সদর দফতরে। দুপুরে জরুরি বৈঠকে বসে কমিশনের ফুল বেঞ্চ। বিকেলে তারা জানিয়ে দেয়, রাজ্য সরকারের আর্জি তারা মানছে না। বুধবার সকাল ১০টার মধ্যে অফিসার বদলের সিদ্ধান্ত কার্যকর না-হলে রাজ্যে ভোট স্থগিত করে দেওয়া হতে পারে বলে ইঙ্গিতও মেলে কমিশন সূত্রে। এর ফলে যে সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরি হবে, তার দায়ও যে রাজ্য সরকারের উপরে বর্তাবে সেটাও ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দেয় কমিশন।

কমিশনের জবাবি চিঠি নবান্নে পৌঁছনোর পরেই মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র পদস্থ অফিসারদের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসেন। সেখানেই ঠিক হয়, কমিশনের নির্দেশ মেনে নেওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আর্জি জানানো হবে। সেই মতো টেলিফোনে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেন শীর্ষ সচিবরা। এর ঘণ্টা দুয়েক পরেই এ দিন রাত আটটা নাগাদ দুর্গাপুরে কমিশনের নির্দেশ মেনে নেওয়ার কথা জানিয়ে দেন মমতা। বলেন, “আই রেসপেক্ট দ্য কনস্টিটিউশনাল বডি (আমি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে সম্মান করি)। কনস্টিটিউশনাল অবলিগেশন (সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা) বলে আমি মেনে নিলাম।”

মানতে যে তাঁকে হবে, সেটা মমতা এ দিন শুরু থেকেই বুঝতে পারছিলেন বলে নবান্ন সূত্রের খবর। সোমবার তিনি ‘কমিশনকে কেয়ার করি না’ বলে তোপ দাগার পরেই দল ও প্রশাসনের শীর্ষ নেতৃত্ব তাঁকে বোঝান, কমিশনের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া ছাড়া কোনও পথ নেই। না-হলে সাংবিধানিক সঙ্কট দেখা দেবে, যার দায় বর্তাবে রাজ্য সরকারের উপর। এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী আইনজ্ঞদের সঙ্গেও কথা বলেন। সেখানেও পরিষ্কার হয়, কমিশনের বিরুদ্ধে এই মুহূর্তে সর্বোচ্চ আদালতে গিয়েও লাভ নেই। পরে মমতার নিজের কথাতেও এই বাস্তবটা প্রকাশ পায়। সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, “ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোর্ট কেস নেবে না। কিন্তু আমরা গেলেই জাস্টিস পাব। কনস্টিটিউশনাল বডি বলেই যা খুশি করা যায় না। আফটার ইলেকশন, ইট উইল বি আ বিগ ইস্যু।”

মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্রের খবর, বাস্তবটা বুঝতে পেরেই এ দিন দুপুরে প্রথমে পুরুলিয়া, পরে বাঁকুড়ার বড়জোড়ার সভায় সুর নরম করেন মমতা। সোমবার তিনি যে রকম রণং দেহি মূর্তি নিয়েছিলেন, তার ঝাঁঝ বেশ খানিকটা কমিয়ে তিনি বলেন, “দিল্লির ধমকানো চমকানো সহ্য করতে রাজি নই। বাংলার অসম্মান দেখতে পারব না।” অভিযোগ করেন, “কংগ্রেসকে জেতানোর জন্য অফিসার বদল করা হচ্ছে। এখানে কোনও দাঙ্গা হয়নি। রাজনৈতিক হিংসাও নেই। এগুলো সত্যি হলে আমার আপত্তি ছিল না। এক জন জানতেই পারছে না, তার কী অপরাধ! অথচ তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল!”

মুখ্যমন্ত্রী যখন এ দিন জনসভা করছেন, তখন নবান্ন ও দিল্লিতে তৎপরতা ছিল তুঙ্গে। এ দিন সকালেই অফিসার বদলির আদেশ পুনর্বিবেচনার আর্জি জানিয়ে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি (মেমো নম্বর: ৩৯-সিএস/২০১৪) পাঠান মুখ্যসচিব। চিঠির প্রতিলিপি দেওয়া হয় রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসার সুনীল গুপ্তকেও।

মুখ্যসচিবের চিঠি পেয়ে দিল্লিতে নির্বাচন সদনে দীর্ঘ বৈঠক করেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ভি এস সম্পত এবং রাজ্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-নির্বাচন কমিশনার বিনোদ জুৎসি। তার পর বিকেলে চিঠির জবাব পাঠিয়ে কমিশন জানায়, আর্জি মানা হচ্ছে না। প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করেই ওই সব অফিসারকে বদলি করতে বলা হয়েছে। কমিশনের মুখপাত্র ধীরেন্দ্র ওঝা পরে বলেন, “রাজ্য যে ব্যাখ্যা চেয়েছিল, কমিশন তার জবাব দিয়েছে। কমিশন চায়, অবিলম্বে বদলির নির্দেশ কার্যকর করা হোক।” কমিশনের জবাব নিয়ে মুখ্যসচিব অবশ্য প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি। তিনি শুধু বলেন, “এই ঘটনা নিয়ে কোনও মন্তব্য করব না।”

কিন্তু কমিশনের এক কর্তা বলেন, “মুখ্যসচিব বুঝতে পারছেন, নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত না মানলে সংবিধানিক সঙ্কট সৃষ্টি হবে। তা ছাড়া তিনি নিজেই এখন নির্বাচন কমিশনের অধীনে কাজ করছেন। কমিশনের সিদ্ধান্ত কার্যকর না করলে জবাবদিহি করতে হবে তাঁকেই। এবং সে ক্ষেত্রে কমিশন যদি মনে করে, মুখ্যসচিব দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ, তা হলে তাঁর ঘাড়েও খাঁড়া নামতে পারে।” মুখ্যমন্ত্রীও এই বাস্তবতাটি বুঝতে পেরেছেন বলে খবর।

সংঘাতের পথ বদলে মুখ্যমন্ত্রী এ ভাবে সন্ধির রাস্তা নেওয়ায় বিরোধীরা অবশ্য কটাক্ষ করতে ছাড়েননি। মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধান্ত বদলের আগেই বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু বলে রেখেছিলেন, “পঞ্চায়েত ভোটে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অকথা-কুকথা বলেছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনকে ধমকে-চমকে যে কিছু করানো যায় না, বুঝতে পারবেন!” আর সিদ্ধান্ত বদলের পরে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রর প্রতিক্রিয়া, “আমরা তো আগেই বলেছিলাম, তাঁর বক্তব্য সংবিধান বহির্ভূত, এক্তিয়ারের বাইরে এবং গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক। শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে এসেছেন। ওঁদের দৌড় কত দূর, আবার বোঝা গেল!” প্রদেশ কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের বক্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী তো নিজে থেকে মানেননি। এখন কমিশন ওঁদের বক্তব্য খারিজ করায় মানতে বাধ্য হয়েছেন! এর পরেও না মানলে যে পরিণতি হতো, সেটা আন্দাজ করেই পিছিয়ে এসেছেন!”

তবে বাধ্যবাধকতার দায়ে কমিশনের নির্দেশ মানলেও মমতা কিন্তু তাঁর মূল বক্তব্য থেকে সরে আসেননি। পক্ষপাতের অভিযোগে যে অফিসারদের বদলির নির্দেশ দিয়েছে কমিশন, এ দিনও তাঁদের পাশেই দাঁড়িয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেছেন, “নির্বাচন কমিশন যে চিঠি পাঠিয়েছে সেখানে অফিসারদের দক্ষতা, ইন্টিগ্রিটি নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। তা হলে কেন তাঁদের সরানো হল?” এই বদলির সিদ্ধান্ত, মমতার মতে, “একেবারেই পলিটিক্যাল অ্যাজেন্ডা।” ওই ডিএম-এসপিদের নাম করে করে তিনি তাঁদের কাজের প্রশংসা করেন। ঘোষণা করেন, “ভোট শেষ হলেই ওই অফিসারেরা আবার নিজের নিজের পদে যোগ দেবে। এটা নিয়ে কর্নাটক হাইকোর্টের একটি রায় আছে। এই অফিসারদের আমি সিএমও, ডিজিও, পুলিশ ডিরেক্টরেট এই সব জায়গায় সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে নিয়ে যাব।” কমিশন চিঠিতে রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা করেই এগিয়েছে বলে যে দাবি করেছে, মমতা তা ‘মিথ্যা’ বলে অভিহিত করেন। পাশাপাশি, কমিশন যে অফিসারদের নিয়োগ করতে বলেছে, তাদের সম্পর্কেও ভাল কথাই বলেন মমতা। তাঁর দাবি, “যারা পোস্টিং পেল তারাও তো আমারই অফিসার। প্রত্যেকের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। তারাও তো আমার হয়েই কাজ করবে, মানে স্বচ্ছ (ভাবে) নির্বাচন (পরিচালনা) করবে।”

নির্বাচন কমিশনের কার্যকলাপের পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে বলে আগের দিনও অভিযোগ করেছিলেন মমতা। এ দিনও তার বদল হয়নি। কংগ্রেস ও সিপিএমের বিরুদ্ধে চক্রান্তের অভিযোগ আনার পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের গঠনতন্ত্র নিয়েও প্রশ্ন তোলেন মমতা। কমিশনের কাজকর্মকে ‘তুঘলকি আচরণ’ বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমি চাই, সব ধরনের পলিটিক্যাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট উঠে যাক। চ্যারিটি বিগিন্স অ্যাট হোম। এখানে সিপিএমের আমল থেকে কত পলিটিক্যাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। আমি সেটা ২-৩ শতাংশে নামিয়ে এনেছি। সারা দেশে এটা বন্ধ করা উচিত।… নির্বাচন কমিশনে কংগ্রেস অ্যাপয়েন্টেড লোকজন।”

বিশেষ করে মমতার আক্রমণের লক্ষ্য এ দিনও ছিলেন রাজ্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ নির্বাচন কমিশনার বিনোদ জুৎসি। মমতা বলেন, “আমরা এখনই জুৎসির অপসারণ চাই। পর্দার পিছনে কে আছে, তা পরিষ্কার করুক। রাজস্থানে একশো একর জমি নিয়ে মামলা রয়েছে। জামিন অযোগ্য পরোয়ানা রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট নিয়ে স্থগিতাদেশ নিয়ে এসেছেন। হি ইস মিসলিডিং দ্য ইলেকশন কমিশন। যদি আমার এই তথ্য ঠিক না হয়, আমি ক্ষমা চাইতে রাজি আছি।”

অর্থাৎ নির্বাচন কমিশন রাজ্যের ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ অফিসারদের সরানোর মধ্য দিয়ে নিজেই ‘পক্ষপাতী’ ভূমিকা নিয়েছে বলে মমতার দাবি। এবং তাঁর মতে, এটা কোনও নতুন ঘটনা নয়। “সিপিএম চিরকাল রিগিং করে এসেছে। আমি দিনের পর দিন অভিযোগ করে এসেছি। কোনও ফল পাইনি।” অন্য দিকে নির্বাচন কমিশনের দিকে আঙুল তোলার ঘটনাও যে নতুন নয়, সেটা বোঝাতে মমতা মনে করিয়ে দেন, “আমি তো জ্যোতিবাবুকে শেষনকে উন্মাদ বলতেও দেখেছি।”

কিন্তু ভোট প্রক্রিয়ার মধ্যে মমতা যে ভাবে কমিশনের বিরুদ্ধে তোপ দাগলেন, সেটা কি নির্বাচনী বিধিভঙ্গের আওতায় পড়বে? কমিশন সূত্রে খবর, মুখ্যমন্ত্রীর দু’দিনের বক্তব্যের সিডি দিল্লিতে পাঠিয়েছেন রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসার। কমিশনের এক কর্তা বলেন, “নির্বাচনী বিধিভঙ্গ হয়েছে কি না, খতিয়ে দেখা হবে। প্রয়োজনে, মুখ্যমন্ত্রীকে সতর্ক করা হতে পারে।”