দৈনিক বার্তা-টাঙ্গাইল, ৫ এপ্রিল, ২০১৪: তাঁত আর মিষ্টি চমচমের জেলা হিসেবে সুপরিচিত টাঙ্গাইলে আরও একটি সম্ভাবনাময় শিল্প ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে, তাহলো বাঁশ ও বেতের মাধ্যমে তৈরি করা কুটির শিল্প। স্বল্প পুঁজি নিয়ে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার বর্নী গ্রামে কুটির শিল্পের ব্যবসা করে অনেকের জীবনে এসেছে স্বচ্ছলতা। তাদের তৈরি বাঁশ ও বেতের এসব পণ্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে দেশ ও দেশের বাইরে। উল্লেখ করতে হয় যে, কারুশিল্পী শাহ আলম মিয়া পাল্টে দিয়েছেন পুরো বর্নী গ্রামের চিত্র। এ গ্রামের বাঁশ বেত শিল্পীরা এক সময় বাজার হারাতে হারাতে পেশা ছেড়ে দিতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু শাহ আলম তাদের দেখিয়েছেন নতুন ঠিকানা। এখন তার দেখানো পথে সবাই কর্মব্যস্ত। বাঁশ বেতের নিত্য নতুন পণ্যসামগ্রী তৈরি করে সবাই সচ্ছল।
টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার ডুবাইল ইউনিয়নে বর্নী গ্রাম। এই গ্রামের দুই শতাধিক পরিবার বংশ পরম্পরায় বাঁশ বেতের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তারা সাধারণত কুলা, ধামা, পলো ইত্যাদি তৈরি করতেন। কিন্তু দিন দিন এসব পণ্যের চাহিদা কমে আসছিল। ফলে দুর্ভোগের মধ্যে পড়ে এ গ্রামের কারুশিল্পীরা। অনেককেই অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাতে হত। পেটের দায়ে অনেকে দিনমজুরিসহ অন্য পেশায় চলে যেতে শুরু করে। মাত্র কয়েক বছর আগেও দেলদুয়ার উপজেলার বর্নী, বারপাখিয়া, বাথুলী, কোপাখীসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের অধিকাংশ মানুষ ছিলেন বেকার।
পরিবর্তনের হাওয়া লাগে এভাবে, গ্রামের মৃত সেফাত উল্লাহর ছেলে শাহ আলম মিয়া স্কুলে লেখাপড়ার পাশাপাশি শখের বসে গ্রামের অন্যদের দেখে নিজেও বাঁশ বেতের কাজ শিখে ফেলেন। ’৮৯ সালে এইচএসসি পাস করার পর এক সময় শখের বশে শেখা বাঁশ বেতের কাজকেই পেশা হিসেবে নেন শাহ আলম। গ্রামের অন্যদের মতো তিনিও কুলা, ডালা, পলো, মাথাল ইত্যাদি গৃহস্থালি সামগ্রী তৈরি করে স্থানীয় বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি করতেন। কয়েক বছর এ কাজ করার পর শাহ আলম লক্ষ্য করলেন দিন দিন এসব পণ্যের চাহিদা কমে যাচ্ছে। কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখলেন আধুনিক প্লাস্টিক সামগ্রী ক্রমেই বাজার দখল করে নিচ্ছে। বাঁশ বেতের চেয়ে অধিক টেকসই হওয়ায় মানুষ এসবের দিকে ঝুকছে। শাহ আলম বলেন, ‘তখন থেকেই আমার মাথায় চিন্তা ঢুকে, নতুন নতুন সামগ্রী তৈরি করতে হবে। তবেই নিজে এই পেশায় টিকে থাকতে পারবো। গ্রামের অন্যরাও খেয়ে পরে বাঁচতে পারবে।’ ’৯৩ সালের দিকে একদিন শাহ আলম ঢাকার একটি অভিজাত কারুপণ্যের দোকানে গিয়ে কথা বলেন। তারা তাকে বাঁশের তৈরি ট্রে ও বেতের তৈরি টেবিল ম্যাটের ডিজাইন দিয়ে বলেন, এগুলো তৈরি করে দিতে পারবেন কিনা। বাড়ি ফিরে এসে কাজে লেগে যান শাহ আলম। পাঁচ দিনের মধ্যেই সেই ডিজাইনের ট্রে ও টেবিল ম্যাট তৈরি করে ঢাকায় নিয়ে যান। শাহ আলমের তৈরি আইটেমগুলো পছন্দ হয় তাদের। তারা শাহ আলমকে এসব পণ্য নিয়মিত সরবরাহ করতে বলেন।
তারপর থেকেই শাহ আলম নতুন নতুন ডিজাইনের বাঁশ বেতের হস্তশিল্প তৈরি ও সরবরাহ শুরু করেন। শুরুতে নিজে একা তৈরি করে সরবরাহ করতেন। অন্যরা তেমন আগ্রহ দেখাতেন না। শাহ আলম প্রথমে আশপাশের দু’একজনকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে নিত্যনতুন পণ্য তৈরি করতে শেখান হাতে-কলমে। তৈরিকৃত পণ্য ঢাকায় বিক্রিরও ব্যবস্থা করে দেন। নতুন পণ্য বিক্রি করে ভাল লাভ পেতে থাকেন তারা। ঢাকায় তাদের পণ্যের চাহিদা বাড়তে থাকে। আস্তে আস্তে সবাই শাহ আলমের কাছে কাজ শিখে এবং তার দেয়া ডিজাইন মতো নতুন নতুন পণ্য উৎপাদন শুরু করেন। বর্নী গ্রামের শাহজাহান মিয়া বলেন, ‘প্রথম প্রথম আমাগো নতুন নতুন জিনিস তৈরির আগ্রহ আছিল না। শাহ আলম যখন বুঝাইলো এগুলো তৈরি করলে ভাল টাকা পাওয়া যাব, তহন আমরা তার কথামতো কাজ শুরু করলাম।’ এই গ্রামেরই বাসিন্দা শুকুরি বেগম বলেন, ‘এহন আমরা সবাই শাহ আলমের শেখানো কাজ করি। এতে ভাল পয়সা পাওয়া যায়। আমাগো আর অভাব নাই।’ বর্নী গ্রামে এখন প্রতিটি বাড়িতেই ছেলে, বুড়ো, নারী সবাই বাঁশ বেতের কাজ করছেন। অনেক বাড়িতে গৃহবধুরা গৃহস্থালি কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাঁশ বেতের বিভিন্ন পণ্য তৈরি করছেন। জয়নাল আবেদিন (৬৫) বলেন, ‘এক সময় খুব দুরাবস্থার মধ্যে চলতে হতো। এখন খুব ভাল আছি। জিনিষ তৈরির সাথে সাথে বিক্রি হয়ে যায়।’ বর্নী গ্রামের সিুফিয়া ওমর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক কালিদাস চন্দ্র মন্ডল বলেন, আগে এ গ্রামের লোকেরা বাঁশ বেতের কাজ করে খুব কষ্টে দিনতিপাত করতেন। এখন তাদের পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। তাই তারা খুব ভালো আছেন।
বর্তমানে বর্নী গ্রামে বাঁশ-বেতের কাজে উৎপাদন তালিকায় আরও নতুন নতুন পণ্যযোগ হচ্ছে। বাঁশের ট্রে, বেতের টেবিল ম্যাটের পর যোগ হয় পেপার ঝুড়ি, লন্ড্রি ঝুড়ি, টেবিল ল্যাম্প, ফ্লোর ল্যাম্প, জুয়েলারি বক্স, ফটোস্ট্যান্ডসহ নানা ধরনের শো-পিস। বর্তমানে শাহ আলম বাঁশ বেতের গহনা ও জুতো তৈরি করেছেন। এগুলো বাজারজাতকরণের অপেক্ষায় রয়েছে। ইতিমধ্যেই শাহ আলম বাংলাদেশ কারুশিল্প পরিষদের ‘শীলু-আবেদ কারুশিল্প পুরস্কার’ লাভ করেছেন।