ভ্যালেনটাইনস ডে-কে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের বিপণিবিতানগুলোতে ভালোবাসার সাজ। গোলাপি রঙের সমাহার সর্বত্র। থরে থরে সাজানো লাল টকটকে গোলাপের সারি। অবশ্য এসব গোলাপে কোনো গন্ধ নেই কিন্তু সুবাসহীন গোলাপ দিয়েই ভালোবাসার উচ্ছ্বাস বিনিময়ের কমতি নেই কোথাও। অনলাইন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর প্রযুক্তিপণ্যের এ যুগে ভ্যালেনটাইনস ডের কার্ড বিক্রিতে অবশ্য কিছুটা মন্দা। তার পরও ভালোবাসার নানা বাণী লেখা কার্ডের সমাহার দোকানে দোকানে। সহকর্মী টনি ‘হ্যাপি ভ্যালেনটাইনস ডে’ লেখা অনেকগুলো কার্ড কিনেছে। তবে, তার সঙ্গে আছে লাল খামের একটি আলাদা কার্ডও। ‘হ্যাপি ইনডিপেন্ডেন্স ডে’ লেখা লাল খামের কার্ডটি দেওয়া হবে জনাথনকে। কিছুদিন আগে বউয়ের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ায় এবারের ১৪ ফেব্রুয়ারি যেন জনাথনের স্বাধীনতা দিবস!
বাংলাদেশে ভ্যালেনটাইনস ডের প্রচলন খুব বেশিদিনের না হলেও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে এ দিনটি পালন এখন সামাজিক রীতির অংশ হয়ে গেছে। আমাদের দেশে কেবল শহুরে তরুণ-তরুণীরাই এদিন পালনে উত্সাহী হলেও মার্কিন মুলুকে প্রায় সব বয়সীরাই এ দিনটিকে বিশেষভাবে পালন করেন। অবশ্য সংগত কারণেই অল্প বয়সীদের মধ্যে এই উত্সাহ উত্সবের পর্যায়ে। চলুন, গল্পে গল্পে জেনে নেওয়া যাক যুক্তরাষ্ট্রে ভ্যালেনটাইনস ডের সাত-সতেরো।
গত ভ্যালেনটাইনস ডের সকালে হঠাত্ই ঝগড়া লেগে যায় জর্জ দম্পতির মধ্যে। কিন্তু আগে থেকেই কথা ছিল বিকেলে শহরের বাইরে লং ড্রাইভে যাওয়ার। কাউন্টি রোড দিয়ে জর্জের গাড়ি ছুটে চলেছে। গোমড়ামুখে গাড়িতে বসা জর্জের স্ত্রী। কোনো কথাবার্তা নেই। শীত-বিকেলের হেলে পড়া সোনালি রোদ। প্রকৃতিও যেন আজ বড় রোমান্টিক। সড়কপথের দুই পাশে চষে বেড়ানো গরু-মহিষের দল। নীরবতা ভেঙে জর্জের মন্তব্য, ‘এ এলাকায় দেখি তোমার অনেক আত্মীয়স্বজনের বসবাস।’ জর্জের স্ত্রীর তাত্ক্ষণিক উত্তর, ‘ঠিকই বলেছ, বৈবাহিক সূত্রে পাওয়া আমার আত্মীয়রা এ এলাকায় প্রচুর!’
মার্কিন তরুণী জেসিকার দীর্ঘ প্রেম ব্রায়ানের সঙ্গে। ভ্যালেনটাইনস ডের মধুর বিকেল বাইরে কাটিয়ে এসে গোমড়ামুখে বসে আছে জেসিকা। উত্কণ্ঠিত মায়ের জিজ্ঞাসার জবাবে জেসিকা জানায়, ব্রায়ান আজই বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে আছে। ‘ছেলেটি তো ভালোই—এ নিয়ে এত চিন্তা করছিস কেন?’ মায়ের প্রবোধ। জেসিকা বলে, ছেলেটি এমনিতে ভালোই মা, কিন্তু ও একজন নাস্তিক, নরকে ওর কোনো বিশ্বাস নেই। জেসিকার মা এবার হাসতে হাসতে বলে, ‘এটা চিন্তার কোনো ব্যাপারই না মা, বিয়ে করে ফেল। বিয়ের পর ব্রায়ান ছেলেটি টের পাবে তার বিশ্বাস কত ঠুনকো ছিল!’
গত ভ্যালেনটাইনস ডে-তে ঘটা করে বিয়ে করেছে এলিজাবেথ। বিয়ের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বন্ধুরা দাম্পত্যের হালচাল জানতে চায়। এলিজাবেথ সংক্ষিপ্ত উত্তরে জানায়, স্টিভ যখন ছেলে বন্ধু ছিল, তখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার কথা মুগ্ধ হয়ে শুনে যেত। এখন আমি কথা বলি, সে ঘুমিয়ে পড়ে।
প্রবাসী বাঙালি এক বন্ধুর পত্নী ভ্যালেনটাইনস ডের আগের সপ্তাহে স্বামীকে বলছেন, হ্যাঁ গো জানো, বড় অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলাম। স্বামীর জিজ্ঞাসু দৃষ্টির জবাবে স্ত্রীর আহ্লাদ মেশানো উত্তর, স্বপ্নে দেখলাম, এবারের ভ্যালেনটাইনস ডে-তে তুমি আমাকে হীরার হার উপহার দিচ্ছ। এমন স্বপ্নের মানে কী গো? মৃদুভাষী স্বামীর মুখে ভালোবাসার মুচকি হাসি। ভ্যালেনটাইনস ডের আগের রাতে অফিস-ফেরত স্বামীর হাতে রঙিন কাগজে মোড়ানো উপহারের বাক্স। আনন্দে আত্মহারা স্ত্রী দ্রুতই মোড়ক উন্মোচনে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। খোদ ঢাকার বাংলাবাজার থেকে প্রকাশিত ‘সহি খোয়াবনামা’। ‘কী দেখলে কী হয়’ শিরোনামে সব স্বপ্নের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেওয়া আছে পুস্তিকাটিতে।
নিউইয়র্কের পানশালায় ভ্যালেনটাইনস ডের রাতে একাকী বসে মদপান করছিল মিগেল নামের লোকটি। দূরের টেবিলে একাকী পান করছে তরুণী এক স্বর্ণ কেশী। মাতাল হয়ে পড়া মিগেল এগিয়ে যায় স্বর্ণকেশীর দিকে। হঠাত্ই তাকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন দিতে উদ্যত হয়। ‘এক্সিউজ মি, কী হচ্ছে এসব?’ মাতাল নিগেলের উত্তর, ভ্যালেনটাউনস ডের সম্মানে তোমাকে একটি চুমু দিতে চাই। বিশ্বাস করো, তোমাকে আমার স্ত্রীর মতোই মনে হচ্ছে।’ আর যায় কোথায়! ওই তরুণী চিত্কার করে গালি-গালাজ শুরু করে। ‘ইউ স্টুপিড, বাস্টার্ড…।’ মাতাল নিগেলের সরল স্বীকারোক্তি, ‘তোমার চ্যাঁচামেচি, খিস্তি-খেউড়টাও ঠিক আমার স্ত্রীর মতোই।’
এসব হাস্যরসের গল্প তো হলোই। এদিকে, ভ্যালেনটাইনস ডের আগমন উপলক্ষে সহকর্মী জর্জের কাছ থেকে আরও কিছু মজার তথ্য পাওয়া গেল। বিখ্যাত অভিনেত্রী মেরেলিন মনরো নাকি বলেছিলেন, ‘হলিউড এমন একটা জায়গা, যেখানে হাজার ডলার ব্যয় করা হয় কেবল একটি চুমুর পেছনে। অথচ হূদয়ের জন্য, ভালোবাসার জন্য একটি কড়িও ব্যয় করা হয় না।’ আর সাবেক ফার্স্ট লেডি বারবারা বুশ তাঁর সন্তানদের বলছিলেন, ‘যে মানুষটিকে জীবনে প্রথম চুমু দিয়েছিলাম তাঁকেই বিয়ে করেছি।’ বারবারা বুশের কথা শুনে নাকি তাঁর সন্তানদের হাসতে হাসতে বমি করার উপক্রম হয়েছিল।
পশ্চিমা সমাজে প্রকাশ্যে চুমু দেওয়া সামাজিক রীতিরই অংশ। জর্জের দেওয়া তথ্যে আরও জানা গেল, চুমু দেওয়ার সময় মানবদেহে হূত্স্পন্দন নাকি মিনিটে ১০০-তে পৌঁছায়। প্রতিদিন যে স্বামী স্ত্রীকে চুমু দিয়ে ঘরের বাইরে যান, অন্যদের চেয়ে তাঁর আয়ু নাকি পাঁচ বছর বেশি হয়ে থাকে। আমেরিকায় সত্তর শতাংশ ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সীরাই ১৫ বছরে পৌঁছার আগেই প্রথম চুমুর স্বাদ গ্রহণ করে থাকে। আর গড়ে মানুষ তার জীবনের প্রায় দুই সপ্তাহ সময় চুমু দেওয়ার পেছনে ব্যয় করে থাকে।
চলচ্চিত্রে প্রথম চুমু দেওয়ার রেকর্ড ১৮৯৬ সালে। ‘দ্য কিস’ সিনেমায় জন রিসি অভিনেত্রী আইরিন উইনকে প্রকাশ্যে চুমু দিয়ে এর সূচনা করেন। জর্জ আরও জানায়, আমেরিকার টেক্সাসে ভ্যালেনটাইন নামের একটি শহর আছে। ওকলাহোমায় আছে লাভ কাউন্টি। ওহাইও এবং কলোরাডোতে আছে লাভ ল্যান্ড নামের দুটি শহর। মিশিগানের রোমিও এবং ইলিনয়েসের জুলিয়েট শহরের কথা তো অনেকেরই চেনা-জানা। বহুশ্রুত একটি প্রবাদ দিয়ে ভ্যালেনটাইনস ডের এ লেখাটি শেষ করা যেতে পারে। ‘ভালোবাসা এমন একটি খেলা, যেখানে দুই পক্ষই জয়ী হয়।’