images জেনেভায় জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় গত মাসে প্রথমবারের মতো সরাসরি আলোচনায় বসে সিরিয়ার সরকার ও বিদ্রোহীরা। যদিও এ আলোচনায় কোনো ফল আসেনি। ১০ ফেব্র“য়ারি আবারও বসতে যাচ্ছে উভয়পক্ষ। তবে জেনেভা শান্তি আলোচনাকে কাজে লাগিয়ে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ তার সরকার ও শাসনামলের বৈধতাকে আরেকটু পাকাপোক্ত করে নিচ্ছেন বলেই মনে করা হচ্ছে। সিরিয়ার এই শান্তি আলোচনা মন্ট্রিল থেকে ২৪ জানুয়ারি জেনেভায় স্থানান্তরের পর নাটকীয় মোড় নেয়। এ আলোচনার ভেতর দিয়ে তিন বছরের গৃহযুদ্ধ থামানোর যে আশা, তা হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে বসেছে।
এ নাটকের শুরু হয় ইরানকে শান্তি আলোচনার প্রথম ধাপে অংশগ্রহণের আহ্বান জানানোর মধ্য দিয়ে। আহ্বানটি জানিয়েছেন স্বয়ং জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন। যদিও পরদিনই এ আহ্বান তিনি প্রত্যাহার করে নেন। সিরিয়ার বিরোধীদলীয় প্রতিনিধিরা এ ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তারা আলোচনার শেষ মুহূর্তেই কেবল অংশ নিতে রাজি হয়েছেন। তারা ইরানকে বয়কট করবে বলে জানিয়েছিলেন। কারণ তেহরান সিরিয়ার এই চলমান সংঘাতে প্রকাশ্যে বাশারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ২০১২ সালের জুনে জেনেভা আলোচনায় গৃহীত পরিকল্পনাটি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত ইরানকে বয়কট করার ঘোষণা দেয় বিরোধীরা। ওই পরিকল্পনাটি ছিল আসাদ সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তরের রোডম্যাপ।

বান কি মুন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাবেদ জারিফের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। মহাসচিবের মনে হয়েছিল, ইরান বুঝি এই রোডম্যাপ মেনে নিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ভিন্ন পরিস্থিতি দেখা দিলে বান কি মুন সেই আমন্ত্রণ প্রত্যাহার করে নেন। মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের চাপেই আমন্ত্রণ প্রত্যাহার করা হয়। তেহরানকে নিয়ে এই দোটানা, আহ্বান ও প্রত্যাহার একটা বিষয় বেশ স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, শান্তি আলোচনার পেছনে নানা স্ববিরোধিতা কাজ করছে।

আলোচনার একটা বড় লক্ষ্য সিরিয়ায় একটি অন্তর্র্বতীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়ালিদ মুয়াল্লেমের নেতৃত্বে সিরিয়া সরকারের পাঠানো প্রতিনিধি দল এবং তাদের প্রধান মিত্র রাশিয়া কারোই এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখা যায়নি।

এই অন্তর্র্বতীকালীন শাসন ব্যবস্থা মানে আসাদ সরকারকে উৎখাতের পরোক্ষ ইঙ্গিত। ২২ জানুয়ারি মুয়াল্লেম ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘সিরিয়ার নাগরিক ছাড়া অন্য কেউই প্রেসিডেন্টকে বৈধতা দেওয়া বা কেড়ে নেওয়ার অধিকার রাখেন না।’ এর দু’দিন আগে বাশার আল আসাদ এজেন্সি ফ্রান্স প্রেসকে জানিয়েছেন, আলোচনা হওয়া উচিত সিরিয়া কীভাবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়বে কেবল তা নিয়ে। আসাদ সরকার বিরোধীদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করবে এটা ‘অবাস্তব কল্পনা’। বরং এ বছর শেষে জনগণ যদি তাকে সমর্থন দেয়, তাহলে আরও একদফা ক্ষমতায় থাকবেন বলে জানিয়েছেন বাশার আল আসাদ। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেছেন, আসাদ সরকারের প্রতি রুশ সরকারের বিশেষ কোনো দুর্বলতা নেই। সিরিয়া যেন টিকে থাকে, তেমন একটা ব্যবস্থাই শুধু রুশ সরকার চায়। একই সঙ্গে তারা কোনোভাবেই চায় না, রাষ্ট্রটি জিহাদিদের হাতে পড়ূক। কিন্তু বাস্তবে রাশিয়া আসাদ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে সবকিছু করে চলেছে। ১৭ জানুয়ারি গোয়েন্দা বিভাগ ও সমরাস্ত্র উৎপাদন শিল্পের দোহাই দিয়ে রয়টার্স একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, আসাদ সরকারকে সামরিক সহযোগিতা দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছে রাশিয়া। সিরিয়ায় নজরদারির সামরিক সরঞ্জাম, রাডার, ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালানোর সামগ্রী, হেলিকপ্টারের খুচরা যন্ত্রাংশ, বিমান বিধ্বংসী গাইডেড বোমাসহ অন্যান্য সরঞ্জাম সরবরাহ করছে। সিরিয়ার সরকারি বাহিনীকে বিদ্রোহীদের ঘাঁটিগুলোর খোঁজ দিতে রাশিয়ার পরামর্শক, আর গোয়েন্দারা সারাক্ষণই ইউএভির (ড্রোন) মাধ্যমে বিদ্রোহীদের ওপরে নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র বিদ্রোহীদের সমর্থন করলেও অস্ত্রশস্ত্র দেওয়ার ব্যাপারে এক পা এগিয়ে দুই পা পেছায়। সৌদি আরব আর কাতার থেকে ঠিকই অঢেল অর্থকড়ি আর বিপুল অস্ত্রসহায়তা পাচ্ছে বিদ্রোহীরা। যুক্তরাষ্ট্রের ভয়, এসব সমরাস্ত্র হয়তো আল কায়দাসংশ্লিষ্ট জিহাদি আল-নুসরা, ইরাক ইসলামি প্রজাতন্ত্র, আর আল-শামের হাতে গিয়েই পড়বে। ‘যুদ্ধ করে এর সমাধান হবে না’ এমন কথা বলে পশ্চিমা প্রতিনিধিরা কূটনৈতিক সমাধানের ওপরই জোর দিয়ে যাচ্ছেন। বাশার আল আসাদ এ সুযোগটি নিতে চান।

সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের জিহাদি গ্র“প ও উদারপন্থি গ্র“পের মধ্যে যুদ্ধের খবরও রয়েছে। এ সুযোগে বাশার আল আসাদ সন্ত্রাস নির্মূলের নামে তার শত্রুদের সন্ত্রাসী ঘোষণা করার মাধ্যমে একেবারে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। আসাদ সরকার বেশ দক্ষতার সঙ্গেই সুযোগগুলো কাজে লাগাচ্ছে। রাশিয়ার মধ্যস্থতায় রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংসের চুক্তির ফলে আসাদ সরকার নিজেকে এই কর্মসূচির একজন অংশীদার হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে নিজের স্বীকৃতি আদায় করে ছেড়েছে। এর মধ্য দিয়ে তার সরকারের বৈধতাকে আরও এক ধাপ দৃঢ় করে নিয়েছেন। লন্ডনভিত্তিক স্ট্র্যাটেজিক স্টাডির একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সিরিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ এমিল হোকায়েম বলেন, এ অঞ্চলে পশ্চিমা বিশ্বের প্রতি হুমকি হচ্ছে জিহাদি ও সন্ত্রাসী গ্র“প। বিদ্রোহীরাই সেসব সন্ত্রাসীর দল। আসাদ মনে করছেন, এমন উচ্চবাচ্যে বুঝি কাজ হচ্ছে। তিনি নিজেকে আল কায়দার সবচেয়ে বড় বিরোধী এবং পশ্চিমাদের জন্য গোয়েন্দাভিত্তিক গোপন তথ্যের বড় এক উৎস মনে করেন। সিরিয়া, ইরাক ও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত রায়ান ক্রোকার বলেছেন, সিরিয়া আল কায়দার শক্তিশালী ঘাঁটি হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। সে তুলনায় আসাদ সরকার নিশ্চয় মন্দের ভালো।

ক্রোকারের ভাবনা ক্রমে পায়ের তলে মাটি পাচ্ছে। ২০১১ সালে বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর পরই আসাদ সরকার বলে আসছিল, বিদ্রোহীদের হাত শক্তিশালী করতে জিহাদি-সন্ত্রাসীদের সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। আর এ কথা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আসাদ একটা পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন করেছিলেন। তথাকথিত ক্ষমা ঘোষণার নামে তিনি রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধে লিপ্ত জিহাদি ও আল কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে সন্দেহ রয়েছে এমন হাজার খানেক অপরাধীকে মুক্তি দিয়েছিলেন। সম্প্রতি একটি রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আল-নুসরাসহ জিহাদি গোষ্ঠীগুলো তাদের দখলে থাকা এলাকার তেল ও গ্যাস বিক্রি করে অর্থনৈতিকভাবে অনেক শক্তিশালী হচ্ছে। বিদ্রোহীরাও জানিয়েছে, সরকারি বাহিনী বিদ্রোহীদের তুলনামূলকভাবে অধিক উদার অংশকে আক্রমণ করছে।

সিরিয়ায় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানোর ব্যাপারে আলোচনা করার ক্ষেত্রে সিরিয়ার সরকারি প্রতিনিধিদের আপত্তি ছিল না। আসাদ যে একজন ভালো লোকথ এমন একটা নীল-নকশাই তৈরি হয়েছে এবারের শান্তি আলোচনায়। এর ভেতর দিয়ে আসাদ নিজেকে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে একজন গ্রহণযোগ্য আবশ্যক অংশীদার হিসেবে তুলে ধরার সুযোগ পেলেন। কারণ আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে, জাতিসংঘ বা রেডক্রসের ত্রাণকর্মীদের নিজ দেশে প্রবেশের কেবল বৈধ কোনো সরকারই অনুমোদন দিতে পারে। আসাদ সরকার যে প্রস্তাবই দিক, পশ্চিমারা তা অস্বীকার করতে পারবে না। ফলে আসাদ সরকারের সঙ্গে কাজ করার মধ্য দিয়ে তার সরকারকেই শক্তিশালী করবে। আসাদ আশা করছেন, পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে যারা তার সরকারের প্রতি সংবেদনশীল তাদের সঙ্গে অচিরেই বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হবেন তিনি। দ্য ইকোনমিস্ট, বিবিসি, আলজাজিরা অবলম্বনে।