বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল দুবাই তথা সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) ভিসা। কর্মসংস্থান বা এমপ্লয়মেন্ট ভিসা, ট্যুরিস্ট বা ভ্রমণ ভিসা এবং সব ধরনের বাণিজ্যিক ভিসা প্রদান সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রেখেছে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আয়ের দ্বিতীয় বৃহৎ উৎস দেশটি। এছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে নিজেদের বাণিজ্যিক সম্পৃক্তিকে নানাভাবে গুটিয়ে নিতে শুরু করেছে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী এ দেশ। এ কারণে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড যেমন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন দুবাই হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণকারী বাংলাদেশী নাগরিকরা। এছাড়া কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ থাকা এ দেশের দরজা এখন বাংলাদেশী শ্রমিকদের জন্য একেবারেই বন্ধ। এ পরিস্থিতির অবসানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনও পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সঙ্কটের শুরু মূলত ওয়ার্ল্ড এক্সপো ২০২০-এর ভেন্যু নির্বাচনের ভোট দেয়াকে ঘিরে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রদর্শনীর আয়োজক হওয়ার প্রতিযোগিতায় ছিল বেশ কয়েকটি দেশ। এর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, তুরস্কের ইজমির, ব্রাজিলের সাও পাওলো, রাশিয়ার একাতেরিনবার্গ ও থাইল্যান্ডের একটি শহর। এর মধ্যে প্রার্থিতার শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় থাইল্যান্ড প্রাথমিক পর্যায়েই বাদ পড়ে। প্রতিযোগিতায় থাকা দেশগুলোর মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের ভোটের ব্যাপারে সবচেয়ে আশাবাদী ছিল দুবাই। কিন্তু গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া হয়, এ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের ভোট পাবে রাশিয়ার একাতেরিনবার্গ। এমন সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে বাংলাদেশী নাগরিকদের ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে রক্ষণশীল নীতি গ্রহণ করে দুবাই ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। দুবাই ন্যাচারালাইজেশন ডিপার্টমেন্ট (ডিআইডি) কেবলমাত্র সে দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবে সম্পৃক্ত বাংলাদেশী নাগরিকদের ভিসা প্রদানের নীতি গ্রহণ করে। এছাড়া সাধারণ পর্যটক ও সাধারণ ট্রানজিট ভিসা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে যেসব বাংলাদেশী নাগরিক সংযুক্ত আরব আমিরাতের মালিকানাধীন এয়ারলাইনের (এমিরেটস, ফ্লাই দুবাই বা ইতিহাদ) যাত্রী হিসেবে বৃটেন, আমেরিকা বা কানাডা ভ্রমণ করতেন, তাদের শর্তসাপেক্ষে ৯৬ ঘণ্টার ট্রানজিট ভিসা দেয়া হতো। সমপ্রতি এ শ্রেণীর যাত্রীদেরও ট্রানজিট ভিসা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কেবলমাত্র বৃটেন, আমেরিকা বা কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাবাসরত বাংলাদেশীরা যথোপযুক্ত প্রমাণপত্র জমা দিয়ে এ ধরনের ট্রানজিট ভিসা পাচ্ছেন। সে ক্ষেত্রেও সংযুক্ত আরব আমিরাতের এয়ারলাইনসমূহের যাত্রীরাই কেবল এ সুবিধার আওতায় রয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, গত বছরের ২৬শে নভেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী ব্যুরোর ১৫৪তম সাধারণ অধিবেশন। সেখানেই ভোটাভুটির মাধ্যমে ওয়ার্ল্ড এক্সপো ২০২০-এর স্বাগতিক দেশের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশ ভোট দেয় রাশিয়ার একাতেরিনবার্গের পক্ষে। তবে শেষ পর্যন্ত গোপন ভোটাভুটিতে জিতে ওয়ার্ল্ড এক্সপো ২০২০-এর স্বাগতিক শহর নির্বাচিত হয় দুবাই। মূলত ওই ঘটনার পর থেকে বাংলাদেশী নাগরিকদের ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে অনেক বেশি কড়া অবস্থান গ্রহণ করে দুবাই তথা ইউএই কর্তৃপক্ষ। ঢাকায় দুবাইয়ের ভিসা প্রক্রিয়াকরণের দায়িত্বে থাকা অন্যতম বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সায়মন ওভারসিস। রাজধানীর গুলশানে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটির অফিসে গত সেপ্টেম্বরের আগে যে কোনও কর্মদিবসে গেলে ভিসা প্রত্যাশী মানুষদের অস্বাভাবিক ভিড় দেখা যেতো। কিন্তু গত দুই সপ্তাহ ধরে অফিসটিতে দুবাইয়ের ভিসা প্রসেসিং পুরোপুরি বন্ধ। এছাড়া ফ্লাই দুবাই বা ইতিহাদ এয়ারওয়েজের সূত্রে যেসব প্রতিষ্ঠান ভিসা প্রক্রিয়াকরণের কাজ করতো, তাদেরও একই দশা।
স্বাভাবিক সময়ে বাংলাদেশ থেকে প্রতিমাসে গড়ে প্রায় ৫ হাজার মানুষ বিভিন্ন কারণে দুবাই ভ্রমণ করতো। বিরাট এ যাত্রী সংখ্যাকে ঘিরে ঢাকা-দুবাই রুটে লাভজনকভাবে চলাচল করতো বেশ কয়েকটি এয়ারলাইনের অনেকগুলো ফ্লাইট। এর মধ্যে কেবলমাত্র এমিরেটস এয়ারলাইন এককভাবে সপ্তাহে ২১টি ফ্লাইট পরিচালনা করতো। গত তিন মাসে পর্যায়ক্রমে কমিয়ে এখন সপ্তাহে মাত্র ১৪টি ফ্লাইট পরিচালনা করছে এয়ারলাইনটি। তারপরও বেশির ভাগ ফ্লাইটে ৫০ শতাংশেরও বেশি আসন খালি যাচ্ছে। এ কারণে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এমিরেটস-এর ফ্লাইট সংখ্যা আরও কমে যেতে পারে। এছাড়া ফ্লাই দুবাই চট্টগ্রাম থেকে সপ্তাহে ৭টি এবং ঢাকা থেকে ৪টি ফ্লাইট পরিচালনা করতো। তাদের ফ্লাইট সংখ্যাও ইতিমধ্যেই অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে।
দুবাই ও ইউএইর ভিসা প্রক্রিয়াকরণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের সূত্রে জানা গেছে, গত নভেম্বর মাসের পর থেকে দুবাই তথা ইউএই সরকার বাংলাদেশী নাগরিকদের ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে অতিমাত্রায় কড়াকড়ি আরোপ করতে থাকে। এ অবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকে যথাসময়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হলে পরিস্থিতিটা এতটা জটিল হতো না। সূত্রগুলো জানায়, সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিভিন্ন রাজ্যে সব মিলিয়ে প্রায় ২৩ লাখ বাংলাদেশী রয়েছেন। সৌদি আরবের পর সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশ আছেন দেশটিতে। এ কারণে রেমিট্যান্স আয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস ইউএই। সেখানে শ্রমজীবীসহ বিভিন্ন রকম পেশায় কর্মরত মানুষের সংখ্যা বেশি হলেও অনেক বাংলাদেশীর বড় রকমের ব্যবসাও রয়েছে। বর্তমান ভিসা জটিলতার কারণে তারা গুরুতর সমস্যায় পড়েছেন। ইতিমধ্যেই তাদের ব্যবসার যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে। দুবাইয়ে রিয়েল এস্টেট সেক্টরে বিনিয়োগকারী বাংলাদেশের একজন ব্যবসায়ী মানবজমিনকে বলেন, সরকারের হঠকারিতার কারণে ইউএইতে থাকা লাখ লাখ বাংলাদেশী এখন ভাগ্য বিপর্যয়ের মুখে। অথচ ওয়ার্ল্ড এক্সপো ২০২০-এর স্বাগতিক দেশ হিসেবে দুবাইকে সমর্থন দেয়ায় নেপাল ৩ লাখ শ্রমিক পাঠানোর সুযোগ পাচ্ছে। দুবাইকে সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশও এর চেয়ে বেশি সুযোগ নিতে পারতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের সরকার সে পথে অগ্রসর হয়নি।
বিষয়টি সম্পর্কে এনআরবি সেন্টারের প্রেসিডেন্ট সেকিল চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, ভিসা জটিলতার কারণে ইতিমধ্যেই ইউএইতে অবস্থানকারী বাংলাদেশীরা বৈরী পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন। এর প্রভাব ক্রমশ মধ্যাপ্রাচ্যের অন্য দেশসমূহে থাকা বাংলাদেশীদের ওপরও পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করেন তিনি। তার মতে কেবল সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমেই এ সঙ্কটের সুরাহা হতে পারে। তা না হলে জটিলতা দিন দিন ঘনীভূতই হবে।
দুবাইয়ের ভিসা প্রক্রিয়াকরণকারী প্রতিষ্ঠান সায়মন ওভারসিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাইমেন সালেহ মানবজমিনকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে দুবাইয়ের ভিসা প্রক্রিয়াকরণ সম্পূর্ণ বন্ধ। সে কারণে আমাদেরও ব্যবসা নেই। ইতিমধ্যেই আমরা এ কাজের জন্য নিয়োজিত কর্মীদের অনেককে ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছি। কিছু কর্মীকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছি।