করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাতে কার্যত দিশেহারা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ ভারত। ইতোমধ্যেই দেশটিতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ। গতকাল বুধবার দৈনিক মৃতের সংখ্যাও পেরিয়ে গেছে ৩ হাজার। এ নিয়ে দেশটিতে মোট মৃতের সংখ্যাও ২ লাখ ছাড়িয়েছে। কিন্তু জনবহুল ভারতে এখনো প্রকৃত আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা জানা যাচ্ছে না বলে দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, আক্রান্ত ও মৃতের প্রকৃত সংখ্যা এর থেকে বহুগুণ বেশি। সিএনএনের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ভারতে প্রকৃত মৃতের সংখ্যা নথিভুক্ত মৃতের প্রায় ৩০ গুণ। অর্থাৎ সঠিক নথিভুক্ত হলে দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা ৫০ কোটি ছাড়াত।

নয়াদিল্লির সেন্টার ফর ডিজিজ ডায়নামিক্স ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিসির ডিরেক্টর রামনন লক্ষ্মীনারায়ণ বলেন, আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যায় যে অনেক গরমিল রয়েছে তা প্রায় সবাই জানেন। গত বছর আমরা হিসাব করে দেখেছিলাম, প্রতি ৩০ জনের মধ্যে ১ জনের সংক্রমণ পরীক্ষায় সংক্রমণ ধরা পড়েছে। মৃত্যুও অনেক কম নথিভুক্ত হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান বিজ্ঞানী সৌম্য স্বামীনাথন বলেন, এখন ভারতে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা অনেকটাই বেড়েছে। প্রতিদিন প্রায় ২০ লাখ নমুনা পরীক্ষা করা

হচ্ছে। কিন্তু এখনো সেটা সন্তোষজনক নয়। এখন ভারতে সংক্রমণের হার ১৫ শতাংশ। দিল্লির মতো কিছু শহরে সেটা ৩০ শতাংশ। এতে বোঝাই যাচ্ছে আগে নমুনা পরীক্ষা কম হতো বলে অনেক আক্রান্তের খোঁজ পাওয়া যেত না। আমরা সেরো সার্ভে করার সময় দেখেছি, অনেক মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি রয়েছে। অর্থাৎ কোনো না কোনো সময় তারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। অর্থাৎ যা নথিভুক্ত হয়েছে তার থেকে অন্তত ২০-৩০ গুণ প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা।

মৃতের ক্ষেত্রেও এ সমস্যা দেখা যাচ্ছে। হেমন্ত শেওয়ার নামের এক চিকিৎসক জানিয়েছেন, ভারতে অনেক মৃত্যুও নথিভুক্ত হয় না। কারণ হাসপাতালের থেকে অনেক বেশি মানুষের মৃত্যু বাড়িতে বা অন্য জায়গায় হয়। মৃত্যুর কারণ লিখে দেওয়ার জন্য সেখানে চিকিৎসকও উপস্থিত থাকেন না। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে হাসপাতালে শয্যার অভাব দেখা দিয়েছে। বাড়ি বা রাস্তাঘাটে অনেক আক্রান্তের মৃত্যু হচ্ছে। সেগুলো হিসাবেই থাকছে না।

মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োস্ট্যাটিসটিক্স ও এপিডেমায়োলজির অধ্যাপক ভ্রমর মুখোপাধ্যায় বলেন, এ সময় বিভিন্ন শহরে যেভাবে গণহারে কোভিড আক্রান্তদের শেষকৃত্য হচ্ছে, তাতেই বোঝা যাচ্ছে প্রকৃত মৃতের বেশিরভাগই নথিভুক্ত হয়নি। আমাদের ধারণা, নথিভুক্ত হওয়া মৃতের থেকে প্রায় ৫ গুণ প্রকৃত মৃতের সংখ্যা।

বিবিসিও এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বিস্তার অভিযোগ এসেছে যে ভারত সরকার করোনায় মৃতের প্রকৃত সংখ্যা গোপন করছে। ভারত এবং দেশটির বাইরে নির্ভরযোগ্য বহু পত্রপত্রিকায় মৃতের সংখ্যা ধামাচাপা দেওয়ার কথা প্রমাণসহ প্রকাশ করা হচ্ছে। দিল্লির এক চিকিৎসক ডা. জিসি গৌতমকে উদ্ধৃত করে নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, অনেক মৃত্যু সরকারি রেকর্ডে তোলা হচ্ছে না। সরকার চাইছে না জনমনে ভীতি তৈরি হোক।

গুজরাটের অন্যতম শীর্ষ দৈনিক সন্দেশ তাদের সংবাদদাতাদের রাজ্যের বিভিন্ন শ্মশান এবং গোরস্তানে পাঠিয়ে দেখেছে, সরকার মৃতের যে সংখ্যা দিচ্ছে প্রকৃত মৃত্যু তার কয়েকগুণ বেশি। গুজরাটে প্রতিদিন গড়ে ৬১০ জন মারা যাচ্ছে। একই অভিযোগ আসছে উত্তরপ্রদেশ এবং দিল্লির বেলাতেও। এক অনুসন্ধানে ভারতের টেলিভিশন নেটওয়ার্ক এনডিটিভি দেখতে পেয়েছে, এক গত সপ্তাহে দিল্লিতে সরকারের দেওয়া হিসাবের চেয়ে ১১৫০ জন বেশি রোগী মারা গেছে। দেশজুড়ে এমন অনেক অনুসন্ধানে মৃত্যু গোপন করার একই ধরনের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।

অনেক শহরে শ্মশানগুলো শব দাহ করার নজিরবিহীন চাপে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। শ্মশানকর্মীদের দিন-রাত কাজ করতে হচ্ছে। রাজধানী দিল্লির অবস্থা এতটাই সঙ্গিন যে খোলা মাঠ, পার্ক, এমনকি গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গাতেও অস্থায়ী শ্মশান তৈরির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কারণ যেসব সরকারি শশ্মান দিল্লিতে রয়েছে তারা আর চাপ নিতে পারছে না। মৃতদেহ নিয়ে গিয়ে দাহ করার জন্য তীব্র গরম আর চিতার আগুনের হলকার মধ্যে পিপিইতে মোড়া স্বজনদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে। দিল্লির সারাই কালে খান শ্মশানের ভেতর খালি জায়গায় গত কয়দিনে নতুন ২৭টি দাহ করার বেদি তৈরি করা হয়েছে। শ্মশানটির লাগোয়া পার্কে তৈরি হয়েছে আরও ৮০টি বেদি। যমুনা নদীর তীরঘেঁষা এলাকাগুলোয় অস্থায়ী শ্মশান তৈরির জন্য জায়গা খুঁজছে দিল্লি পৌর কর্তৃপক্ষ।

এদিকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ক্ষত থাকা গুজরাটে করোনা আক্রান্ত সব ধর্মের মানুষের জন্য শহরের বিভিন্ন মসজিদ খুলে দিয়েছেন মুসলমানরা। সেগুলো হয়ে উঠছে একেকটি অস্থায়ী হাসপাতাল। এগুলোর মধ্যে গুজরাটের ভাদোদারা শহরের জাহাঙ্গীরপুরা মসজিদের নাম উল্লেখযোগ্য। এটিকে সম্প্রতি ৫০ শয্যার হাসপাতালে রূপান্তর করা হয়েছে। হাসপাতালটির ট্রাস্টি ইরফান শেখ আরব নিউজকে বলেন, শহরের করোনা পরিস্থিতি ভালো নয়, মানুষ হাসপাতালে শয্যা পাচ্ছে না। তাই তাদের স্বস্তি দিতে আমরা মসজিদ খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু মসজিদ খুলে দেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে ৫০ শয্যাই পূরণ হয়ে যায়। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, হাসপাতালগুলো কী পরিমাণ চাপে রয়েছে। অক্সিজেন পেতে তাদের সমস্যা হচ্ছে। তবে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ পেলে মসজিদে আরও ৫০টি শয্যা বসানো সম্ভব।

জাহাঙ্গীরপুরার মতো সেখানকার দারুল উলুম মসজিদকেও করোনা হাসপাতালে রূপান্তর করা হয়েছে। এতে শয্যা রয়েছে ১৪২টি। সেখানে ২০ জন নার্স ও তিনজন চিকিৎসক সার্বক্ষণিক করোনা রোগীদের সেবা দিয়ে চলেছেন। মসজিদটির পরিচালনা কমিটির সদস্য আশফাক মালেক তন্দলজা বলেন, আমরা এক হাজার শয্যার হাসপাতাল বানাতে পারি, তবে অক্সিজেন সরবরাহ কম। এসব মসজিদ মুসলিমপ্রধান এলাকায় হলেও সেখানে চিকিৎসা নিতে আসছেন সব ধর্মের মানুষই। এ বিষয়ে ইরফান শেখ বলেন, আমাদের কেন্দ্রে ৫০ শয্যার ১৫টিতেই অমুসলিমরা রয়েছেন। আমরা মানবতার সেবা করি, ধর্মের নয়।