জঙ্গিবাদকে বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সবাইকে ঐক্যদ্ধভাবে এ সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে। তা না হলে আবার অন্ধকার যুগে ফিরে যেতে হবে।শনিবার জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় আয়োজিত ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) ১৩৬তম অ্যাসেম্বলির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।

সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা এবং বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে ঢাকায় শুরু হয়েছে ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) ১৩৬ তম সম্মেলন।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্ধ্যায় বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় পাঁচ দিনব্যাপী এই সম্মেলন উদ্বোধন করেন।এবারের সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য হলো ‘সমাজের বৈষম্য নিরসনের মাধ্যমে সবার মর্যাদা ও মঙ্গল সাধন। শিশুর অধিকার বিষয়ে কাজ করে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কৈলাস সারথি সম্মেলনে এ বিষয়ে একটি মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন।১৯৭২ সালে আন্তর্জাতিক এই ফোরামে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর এই প্রথমবারের মতো বিশ্বের আইন প্রণেতাদের দীর্ঘদিনের পুরোনো এই সংগঠনের সম্মেলনের স্বাগতিক দেশ হয়েছে বাংলাদেশ।

বিশ্বের ১৩১টি দেশের ৬৫০ জন সংসদ সদস্য, ৫৩ জন স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার এবং ২০৯ জন নারী পার্লামেন্টারিয়ানসহ মোট ১ হাজার ৩৪৮ জন প্রতিনিধি এই বৃহৎ সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন। তাঁরা বৈষম্য নিরসন, নারীর ক্ষমতায়নে সংসদের ভূমিকাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করবেন।সম্মেলনের অন্যান্য কর্মসূচি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের ৫টি ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হবে। আইপিইউর একজন মুখপাত্র দিনের কর্মসূচি শেষে মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের ব্রিফ করবেন। সম্মেলনে যোগ দিতে আসা অতিথিরা নগরের ১৫টি হোটেলে থাকবেন।সম্মেলন শেষ হবে ৫ এপ্রিল বুধবার। আইপিইউ প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেন চৌধুরী শুক্রবার জানিয়েছেন, সম্মেলন উপলক্ষে কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি বলেন, এই সম্মেলন বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এর গুরুত্ব তুলে ধরতে বাংলাদেশের জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্ব নতুন এক উপদ্রবের মুখোমুখি হয়েছে। সন্ত্রাস এবং জঙ্গিবাদ নিরীহ মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে। মানুষের শান্তি বিনষ্ট করছে। জঙ্গিবাদ আজ কোনো নির্দিষ্ট দেশের সমস্যা নয়, এটি বৈশ্বিক সমস্যা। আমাদের সকলকে ঐক্যদ্ধভাবে এ সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে। তা না হলে আমরা আবার অন্ধকার যুগে ফিরে যাবো।বৈশ্বিক জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন ফোরামে আলোচনার প্রসঙ্গ তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি এই মহৎ সমাবেশের সামনে বিষয়টি আরেকবার উত্থাপন করছি এ কারণে যে, এই পরিবর্তনের ফলে আমরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি। এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে পরিত্রাণের জন্য যে সহায়তার প্রতিশ্রুতি বিভিন্ন ফোরামে দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন প্রত্যাশা করছি। শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্ব আজ এগিয়ে যাচ্ছে। দৃশ্যমান অগ্রগতি সাধিত হয়েছে বৈশ্বিক ক্ষুধার ক্ষেত্রেও। তবুও, বিশ্বের প্রায় ৮০০ মিলিয়ন মানুষ এখনও অপুষ্টিতে ভুগছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর এক বিরাট সংখ্যক শিশু পুষ্টির অভাবে সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না। অসুখে-বিসুখে চিকিৎসার সুবিধাবঞ্চিত তারা। সুযোগ পাচ্ছে না বিদ্যালয়ে যাওয়ার। অথচ প্রাচুর্যে ভরা এই বিশ্বে মানবজাতির বেঁচে থাকার সব ধরনের রসদ বিদ্যমান। একটু সহানুভূতি, সহযোগিতা, পরস্পরের প্রতি মমতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ বিশ্বকে এক নিমিষেই ক্ষুধামুক্ত করতে পারে।বাংলাদেশে একটি দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত, ন্যায়-ভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলার জন্য তার সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে বলে বক্তব্যে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।বক্তব্যের শুরুতেই অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া অতিথিদের উষ্ণ অভিনন্দন ও স্বাগত জানান প্রধানমন্ত্রী।তিনি বলেন, আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য নিয়ে গর্বিত। আমরা গণতন্ত্রকে শুধু একটি ব্যবস্থা হিসেবে দেখি না, বরং গণতন্ত্রকে মানুষের সমৃদ্ধি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বাহন হিসেবে গণ্য করি। বাংলাদেশে গণতন্ত্র অর্জনের পথ কখনই মসৃণ ছিল না উল্লেখ করে তিনি বাংলাদেশের মানুষের স্বাধিকার আদায় ও স্বাধীনতা অর্জনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন এবং দেশগড়ার পথে তার পরবর্তী লড়াই ও নির্মম হত্যাকান্ডের কথাও তুলে ধরেন।প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় নিজে নির্যাতিত-নিপীড়িত-কারাবন্দি হওয়ার কথাও তুলে ধরেন বক্তৃতায়। একইসঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ত্যাগ-তিতীক্ষার উপস্থাপন করেন আইপিইউ অ্যাসেম্বলিতে অংশ নেওয়া অতিথিদের সামনে।প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি মনে করি একমাত্র গণতন্ত্রই মানুষের মৌলিক অধিকারসমূহ পূরণ করে উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে পারে।

গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অতন্দ্র প্রহরী স্বাধীন এবং সপ্রতিভ গণমাধ্যম উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের গণমাধ্যম একদিকে যেমন বিকশিত হয়েছে, তেমনি নিশ্চিত করা হয়েছে অবাধ স্বাধীনতা। তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন এবং তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।সরকারের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। এসময় তিনি দারিদ্র্য হার হ্রাস, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির কথা তুলে ধরেন। শেখ হাসিনা বিশ্বের জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশে বলেন, বাংলাদেশ এরইমধ্যে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি লাভ করেছে। এখন আমাদের লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম-আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশের মর্যাদা লাভ করা। এ লক্ষ্যে সরকার এমডিজি বাস্তবায়ন করে এসডিজি বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।অ্যাসেম্বলির বিষয়ে প্রত্যাশা করে ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আশা করি দারিদ্র্য বিমোচন, বিশ্ব শান্তি স্থাপন এবং সর্বোপরি মানবতার কল্যাণে আপনারা বাস্তবধর্মী সুপারিশমালা প্রণয়ন করবেন। নিজ নিজ দেশে সেগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ নেবেন। তবেই আমাদের-আপনাদের পরিশ্রম স্বার্থক হবে। মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত হবে। বক্তৃতার শেষে প্রধানমন্ত্রী আইপিইউ’র অ্যাসেম্বলির উদ্বোধন ঘোষণা করেন।সন্মেলনের উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে উদ্বোধন করা আইপিইউ ওয়েব টিভির।উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, আইপিইউর সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী ও সেক্রেটারী জেনারেল মার্টিন চুংগং অংশ নেন। এছাড়া অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা , জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ , মন্ত্রীসভার সদস্য , বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতসহ সহস্রাধিক অতিথি অংশ নেন।